আসমান উপন্যাস: পর্ণ-প্রগতির গালে কষে মারা চড়
|| আহমদ ময়েজ ||
রক সাউণ্ড আর গাজার বোটকা গন্ধে ডুবে আছে দুই তরুণ। তারা নিজেদের সব চে’ অগ্রসরমান নাগরিক মনে করে। ৯০-এর দশকের শেষ সময়। ওমার ও রুশো। দুই বন্ধুর নামের মধ্যে রয়েছে সম্যক সাংস্কৃতিক ব্যবধান। রুশোর গুরু হয়ে ওঠার উদগ্র বাসনা। তথাকথিত প্রগতিশীলদের জনমনে কোনো বন্ধু থাকে না, তথাপি তারা সকলের ঠিকাদারী নিয়ে কথা বলে। ওমার ও রুশোর অবস্থাও এমন। তারা প্রতিদিন সব কিছু অস্বীকার করার মধ্যদিয়ে নিজেদের ভাবনা ও ধারণাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে বসে আছে। কেউ তা মানলো কী মানলো না, সে নিয়ে তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এমনি দুটো চরিত্র ও প্রাসঙ্গিক আরো কিছু চরিত্রের উপখ্যান ‘আসমান’। লেখক লতিফুল ইসলাম শিবলীর ‘আসমান’ সমসাময়িক ঘটনার নির্যাস নিয়ে একটি ছোট্ট উপন্যাস। পৃষ্ঠায় কতোটা বর্ধিত তা বিবেচনার বিষয় নয়, কলেবর কিংবা আয়তনেও নয় বরং কাঠামোগত পরিচিতিই তার উপন্যাস হয়ে ওঠার দিকনির্দেশনা করে। অর্থাৎ কাহিনীর বিস্তৃতির মাধ্যমে বিশাল ক্যানভাস তৈরি করেছেন লেখক। গল্পের সংকোচিত উইণ্ড বলা যাবে না। বরং বৃহত্তর চিন্তা-ভাবনার ভেতর ‘আসমান’ উপন্যাসের আধার নির্মিত হয়েছে।
‘আসমান’ এ সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ। ভাষায় ও দর্শনে সমৃদ্ধ একটি উপন্যাস। যে কারোর কাছে ত্রিলার গল্প বলে ভ্রম হতে পারে। কিন্তু লেখক মূল চরিত্রকে ধীমান করে তোলার কারণে এবং বিশ্ববীক্ষণ ধারা আবর্ত হওয়ায়, এটি সময়ের এক দালিলিক উপন্যাস হয়ে ওঠেছে। গ্রন্থটিকে আলাদাকরণের মধ্যে রয়েছে তার ভাষারীতি ও সাংকেতিক উপমা। বাক্যের আঁটসাঁট গ্রন্থি অথচ ভারহীন সুখকর পাঠ্য হয়ে ওঠেছে। পাঠককে এক লহমায় টেনে নিয়ে যাবে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। কাহিনীর পটভূমি বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, গোয়েন্তানামো বে পর্যন্ত বিস্তৃত।
বাংলাসাহিত্যের ইতিহাসে গল্পনির্মাণ কেবল একটি কৌশলিক ব্যপার নয়। বৃটিশযুগ থেকে যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমরা লক্ষ্য করছি, এর প্রত্যক্ষ ফসল হচ্ছে রক্তশূন্য সাংস্কৃতিক ভাবনা ও চর্চা। ‘আসমান’ উপন্যাস এসব আধিপত্যবাদীদের কোথায় যেন একটা চড় কষে দিয়েছে। আমরা উপন্যাসের মূল বিষয়ে প্রবেশ করলে বুঝতে পারবো, লেখক শিবলী স্রোতের উজানে কেন দাঁড় টানছেন। আমরা বুঝতে পারবো, বহমান সময়ে আমরা কতোটা কৃত্রিম সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেছি যা ভাঙতে হলে স্পর্ধিত সাহস নিয়ে সবকিছু ঢালাই করে সাজাতে হবে। তবেই নতুন প্রজন্ম মুক্তির পথ নির্মাণ করবে।
‘আসমান’ উপন্যাসে চিন্তাগতভাবে দুটি পর্ব রয়েছে। প্রথম পর্ব, পর্ণ-প্রগতিবাদ আর দ্বিতীয়টি চিন্তার মুক্তি। এ দু’য়ের দ্বন্দ্ব থেকে আমরা খুঁজে পাবো গ্রন্থের মূল চরিত্র ওমারের দর্শন।
‘আসমান’ উপন্যাসের শুরুতে মনে হবে উচ্ছেন্নে যাওয়া দুই তরুণের অযথা বকবকানী। দ্বিতীয় পরিচ্ছদে প্রবেশ করার সাথে সাথে বদলে যাবে সকল ভাবনা। কেবল মনে হবে কোথায় এর পরিসমাপ্তি, কীভাবে লেখক টেনে নিয়ে যাবেন এতো বড় এক দ্বান্দ্বিক ঘূর্ণনকে। ভাষার গাম্ভীর্য ও চিন্তাগত জিজ্ঞাসাগুলোর জট খুলতে খুলতে পাঠক নিজেই একসময় আবিষ্কার করবেন জঞ্জালময় পৃথিবীতে পরাশক্তি কীভাবে মানুষকে কৃতদাসে পরিণত করে তুলেছে। ওমারের ক্রোধ, ভালোবাসা, মমতা ও সকল কিছুর উর্ধ্বে তার আত্মনিয়ন্ত্র পাঠককে বিস্মিত করবে। পাঠক নিজেরও আত্মপরিচয় খুঁজে পাবেন প্রতিটি চিন্তাশীল বাক্যের গভীরে।
আসমান উপন্যাস শুরু হয়েছে ফ্ল্যাসব্যাক দিয়ে এবং এমন একটি সংলাপ দ্বারা যা বাংলা সাহিত্যে সচরাচর চোখে পড়ে না।
‘হৃদয় আল্লাহর ঘর। …’ এর পর সংলাপের মাধ্যমে এর একটা ব্যাখ্যাও আমরা পাই। মধ্যযুগের দার্শনিক কবি সৈয়দ শাহনূর লিখেছিলেন, ‘আল্লাহ-নবীর ঘরখানা শয়তানের কাচারি’। এই শয়তানের কাচারি কথাটা কী অর্থে তিনি বলেছিলেন তারও একটা ব্যাখ্যা রয়েছে যা তিনি পরবর্তী অন্তরায় উল্লেখ করেছেন। সেই ব্যাখ্যাও আমরা অন্যভাবে পাই ধানমণ্ডি আট নম্বর রোডের জামে মসজিদের বৃদ্ধ পেশ ইমাম ইসহাক আব্দুর রহমানের কণ্ঠে। শত শত বছর পূর্বে যেভাষা, যে চিন্তা এই বঙ্গভূমে প্রোথিত হয়ে আছে, যে ভাষা, সহজিয়া ও মরমী ভাবদ্বারা আদৃত – বর্ণগোষ্ঠী ভ্রাহ্মন্যবাদ তা আমাদের ভুলিয়ে দিতে বসেছে কয়েকশ বছর ধরে। আমরা ক্রমশঃ সংস্কৃতবর্ণবাদীদের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছি। লেখক লতিফুল ইসলাম শিবলী সেটা ভাঙার পথ তৈরি করছেন।
অন্যদিকে বিপরীত এক চরিত্র রুশো। রুশোর মাধ্যমে বাংলায় ব্যাণ্ডসঙ্গীতের একটি ধারাক্রম খুঁজে পাই। এটি নতুন প্রজন্মের ক্রেজ। একজন রুশো নিজেকে কীভাবে জীম মরিসের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে পায়। নিজেকে যুগের নবী ভাবার স্পর্ধা দেখায়, এসব বর্ণনা লেখক ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে পাঠককে অবগত করান। রুশো ও ওমার একে অপরের ভরসার কেন্দ্রস্থল হয়ে ওঠলেও শেষ পর্যন্ত ওমার লামিয়া নামক তরুণীর আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়ার নতুন জীবন খুঁজে নেয়। এখানে নিয়ামক হিসেবে কাজ করেন ওমারের মায়ের মাধ্যমে ধানমণ্ডির সেই চিন্তাশীল ইমাম। ভাববাদের সঙ্গে বস্তুবাদের সংঘাত নির্ধারণ করে দেয় ওমারের পরপবর্তী জীবন। এটি একটি অনিবার্য সংঘাত। টুটতে বাধ্য করে বস্তুবাদের ভোগবাদী দর্শন। এভাবে রুশো ক্রমশঃ একা হয়ে যায়। কিন্তু ওমারের প্রতি তার টান কমে না। যেখানে ওমার নামাজের জন্য মসজিদে প্রবেশ করে সেখানে সিড়িতে বন্ধুর জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারা কেউ কাউকে তিরস্কারও করে না। বরং দৃষ্টির ভেতর মমত্ববোধ ধরে রাখে। ওমারের ধারনা রুশোও একদিন সত্য খুঁজে পাবে। উপন্যাসে লেখক সে আভাস দিয়ে রাখলেও আমরা রুশোর শেষ পরিণতি জানতে পারিনি। লেখক এই ভাবনাটা পাঠকের জন্য রেখে দিয়েছেন। রুশো সম্বন্ধে তার শেষ ধারনা ছিলো, ‘জুনায়েদ জামশেদের মতো এতো বড় আর জনপ্রিয় পপস্টার যদি বদলে যেতে পারে তবে রুশোও নিশ্চয় বদলাবে’।
‘হৃদয় আল্লাহর ঘর’ বলে যে উপন্যাসের শুরু সেটি অনেক জল ঘোলা করে সেই ঘরের সন্ধান পায় ওমার।
ধানমণ্ডি মসজিদের বয়োজ্যাষ্ঠ এক ইমামের চিন্তাভাবনা কতোটা দূরবর্তী তা বুঝা যায় যখন তিনি আলাপচারিতায় উল্লেখ করেন, ‘না, কথাটা ডারউইন বলেননি। ডারউইনের দি অরিজিন অব স্পেসিস পড়ার পর তার ব্যাখ্যায় ইংরেজ দার্শনিক এবং বায়োলজিস্ট হারবার্ট স্পেনসার প্রথম বলেছিলেন বাক্যটা, সারভাইভাল অব দা ফিটেস্ট।’
হ্যা, ওমার চমকে ওঠেছিলো। কারণ, প্রথমে ভেবেছিলো তিনি সাধারণ কোনো ইমাম যার কেতাবী জ্ঞান অনেক সীমাবদ্ধ। কিন্তু ইমামের বহুমুখী প্রতিভা তাকে মুগ্ধ করে এবং আস্তে আস্তে সে তাঁর দিকে ধাবিত হতে থাকে।
রুশো, ইমাম, মমতময়ী মা, ঢাকার রাজপথ, ওলি-গলি, বুড়িগঙ্গার প্রাণজ জল সব ছেড়ে একদিন তাবলিগ জামাতের এক অর্ধশিক্ষিত আনোয়ারের সঙ্গ নিয়ে ওমার পৌঁছে যায় রাইওয়াণ্ড যেখানে পাকিস্তানে তাবলিগ জামাতের মারকাজ। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে লেখক কী করে একটি আধুনিক চিন্তাশীল ওমারকে একটু ট্রিপিক্যাল টাইপের আনোয়ারের প্রতি উৎসাহিত করে তুললেন? এর কোনো সরাসরি ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না কিন্তু ওমারের চরিত্রে এর অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা পরিচ্ছন্নভাবে লেপটে আছে। এককথায় ওমারের কৌতুহলী মন দ্বারা ব্যাখ্যা করলে খুবই সাধারণ একটা কার্যকারণ দাড়িয়ে যায়। কিন্তু ওমারের কৌতুহল সাধারণ কার্যক্রমের সঙ্গে দেখলে তার চিন্তা গভীরতা উপলব্ধি করারযাবে না। ওমাররনামক চরিত্রটি লেখক এমন সব উপাদান দ্বারা নির্মাণ করেছেন যা স্থুল কৌতুহলে নির্ভাপ হবার নয় বরং আরো অনুসন্ধিৎসু করে তুলে এবং নিজেকেই এক সময় প্রশ্নবিদ্ধ করে ছিড়েফেলে। তাবলিগের মতো বিশাল ইজতেমা তাকে বিশ্বভ্রাত্তিত্বের সন্ধান এনে দেয়। বহুবর্ণ ও বহুভাষী মানুষ তাকে আকৃষ্ট করে এবং নতুন নতুন জিজ্ঞাসা তৈরী করে। এখানেই স্মার্ট যুবক আফগান যোদ্ধা খালেদের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। এভাবে গল্পটি মূল উপত্যকায় পৌঁছতে থাকে।
খালেদের মাধ্যমে খ্রীস্টপূর্ব থেকে কিছু ঘটনার প্রশ্ন আজও অমীমাংসিত। কেন আফগান বারবার আক্রান্ত হয়? আলেকজাণ্ডার থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত এ জাতি বহিঃশক্তির সঙ্গে কেবল লড়াই করে যাচ্ছে। যেখানে কয়েক বছরের যুদ্ধে কোনো দেশ স্থিতিশীল হতে কয়ে প্রজন্ম লেগে যায়, সেখানে খ্রীষ্টপূর্ব ৩শ বছর ধরে যুদ্ধ করে আজও টিকে আছে। এই যুদ্ধের অনিবার্য প্রতিরোধকারীদের কেন সন্ত্রাসী বলা হবে? কেন তারা মুক্তিযোদ্ধা নয়? এর সঠিক উত্তর পশ্চিমারা যতো দিন দিতে পারবে না ততোদিন তারা সভ্য হয়ে ওঠবে না। কেবল বিজ্ঞানে অগ্রসরমান, চন্দ্র ও মঙ্গলগ্রহ ভ্রমন করলেই সভ্য হওয়া যায় না – এমনি এক উপলব্ধি ‘আসমান’ উপন্যাস আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে।
ওসমান নিজেকে কাফনে আবৃত্ত করেও আত্মজিজ্ঞাসা তার নির্ভাপ হয়নি এই উপলব্ধি পাঠকের না হলে বিভ্রান্ত হবার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এটা কিন্তু লেখক শিবলীর দায় নয়। পাঠক নিজেকে ঋদ্ধ করার দায় রয়েছে। লেখক উপলব্ধির সংঘাতকে মুখোমুখী দাড় করিয়ে ওমারের মাধ্যমে প্রশ্ন রেখেছেন, এক পক্ষ অন্যপক্ষকে ‘আল্লাহ হু আকবার’ বলে হত্যা করার নাম কি জেহাদ?
একটি পাহাড়ী উপত্যকার নির্জন কুটিরে বসে চরমভাবে আহত হয়ে ওমারের চিন্তা জগত আরো অধিক চিন্তাবাণে বিদ্ধ হতে থাকে। কবি রুমীর কাব্যজগৎ ও একজন সেবিকার নির্লিপ্ত অথচ অনুকম্পিত ছায়ায় আত্মনিয়ন্ত্রিত প্রেম ওমারকে কিছু সময়ের জন্য ভাবুক করে তুলে। কিন্তু কোনো স্খলন ঘটেনি। এটা উপন্যাসের ভাবগাম্ভীর্যতার সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে নেয়ার মতো বিষয়ও বটে।
ওমারের চরম পরিণতি, ইন্টেলিজেন্টদের হাতে বন্দী ও গোয়েন্তেনামো বে’র অন্ধকার কারাগারে নির্যাতিত হয়ে ১০ বছরের জীবন আমাদের জন্য আরো নতুন দীক্ষা রেখে গেছে। নির্যাতনের মধ্যেও প্রতিপক্ষকে কীভাবে মনোস্তাত্ত্বিকভাবে ঘায়েল করেছে, সে এক যৌক্তিকভাবে সুফিচিন্তার ভাষা ব্যবহারের মধ্যে পাওয়া যায়।
‘আসমান’ উপন্যাস আকাশের মতো এক বিশাল ক্যানভাস যা বাংলাসাহিত্যের জন্য নতুন দিকনির্দেশনা।
লণ্ডন, ৯ আগস্ট ২০২২।।