গ্রন্থ আলোচনা

শিল্প-সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘মনোজ’: নতুন স্বর ও সাহসিকতার গতিময় দ্যুতি

।। নাহার আলম ।।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক

অর্জন নয়, বরং ব্যর্থতা কাঁধে নিয়েই এগোতে হয় একজন ছোটকাগজ সম্পাদককে। স্বার্থচিন্তার বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণরূপে অলাভজনক, অবাণিজ্যিক একটি ভিন্ন জগতের সাক্ষ্য বয়ে নেবার এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞের নাম সাহিত্যের ছোটকাগজ। একটি সমাজের তথা দেশের দর্পণ হল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। এবং এ মাধ্যমকে জানা বা চেনা মানেই হলো সেই নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবৃত্তগ্রস্ত পরিবেশের সে সময়ের এবং সমাজের স্বরূপকে চেনা-জানা। যেখানে সামাজিক, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক নানা ঘাত-প্রতিঘাত, সংঘর্ষ কিংবা সংঘাতের চিত্রকে খুব স্পষ্টাক্ষরে তুলে আনে কবি-লেখকরা তাদের সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। জাতীয় দৈনিকগুলোয় পরিসরের স্বল্পতা ও দায়বদ্ধতার সাথে থাকে নানারকম সীমাবদ্ধতা। যার ফলে এ কাগজগুলো চাইলেও শতভাগ সৎ সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। সম্ভব নয়। এবং প্রায় সমহারে পাশাপাশি অনিবার্যভাবে এসেই যায় স্বজনপ্রীতি, আদর্শগতপ্রীতি। ছোটকাগজে সেসব একেবারেই যে থাকে না, তা বলছি না। সুযোগ নেই। তবে, বৃহৎ পরিসরের তুলনায় তা নেহাতই কম। ছোটকাগজকে বলা হয় কবি-লেখকের আঁতুরঘর। মূলত, তাই-ই সত্য। আজ যাঁরা সমাজের প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক তাঁদেরও হাতেখড়ি এই ছোটকাগজ দিয়েই। তাঁরা চাই স্বীকার করুন বা না-ই করুন— এটিই সত্য এবং সত্য। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, এটি নবীনদের জন্যে এক খোলা ময়দান। সারাদেশব্যাপী গ্রাম, শহর, মফস্বল থেকে প্রকাশিত অসংখ্য ছোটকাগজের আবির্ভাব— শিল্প-সাহিত্যের অঙ্গনের এই জোয়ার সাহিত্যের জন্যে নিশ্চিতভাবেই সুখবর। সম্পাদকের সুশীল চিন্তা, শ্রম-ঘাম-ধ্যানের বিনিয়োগের সাথে সমকালীক বৈদগ্ধ্য মননশীল সৃজনোন্মুখ কবি-লেখকের সুষম সৃষ্টিসমূহের মঞ্চায়নই হল ছোটকাগজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। সেক্ষেত্রে ছোটকাগজ তার নিজস্ব গতিতেই চলমান এবং চির তারুণ্যের প্রতীক। সাহিত্য সংশ্লিষ্ট কাজটির আয়ু নির্ভর করে তার নিজস্ব শিল্পগুণের মহিমায়। সম্পাদক কিংবা কবি-লেখক— উভয়ের ক্ষেত্রেই একথা সমভাবে প্রযোজ্য বলে মনে করি আমি।

মূল কথায় ফিরছি— প্রায় নতুন শিল্প-সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘মনোজ’ এর চতুর্থ সংখ্যাটি (সেপ্টেম্বর সংখ্যা)। শিরোনাম ‘মনোজ’ এর বিস্ময়কর তাৎপর্যের ব্যাখ্যাটি ‘মনে জাত’। মানে মন থেকে যা আসে। প্রাসঙ্গিকতার সমন্বয়ে নান্দনিক একটি নাম। শুরুটা হয়েছে কাহলিল জিবরানের চমৎকার একটি বাণীতে। এ সংখ্যার বর্ণাঢ্য সূচিতে আছে: পনেরো জনের গুচ্ছ কবিতা, পরভাষার কবিতা একজন, হাইকুতে একজন, প্রবন্ধে দু’জন, গল্পে চারজন, কাব্যালোচনা ও গ্রন্থালোচনায় যথাক্রমে এক ও দু’জন, কবিস্মরণে দু’জন, মুক্তগদ্যে একজন এবং আরও আছে ছোটকাগজ নিয়ে অনুবাদ রচনা।

সচরাচর ‘সম্পাদকীয়’ শব্দের পরিবর্তে ‘মনোজ কথা’র সুবিস্তর যুক্তিনির্ভর কথাগুলো ভেতরের সারবস্তু জানার আগ্রহকে জাগিয়ে তুলল যেন। কিছু কথা কোট না করে পারলাম না। যেমন: ‘আমাদের স্বপ্ন, সমাজ-পৃথিবী, বেদনা কোন রাস্তা ধরে আগায়? ব্যক্তি বা বৃহত্তম সমাজচক্ষু যেন প্রকৃত অর্থে দেখতে পায় না কতশত সত্য! দেখতে পায় না দেশে দেশে মানুষের কষ্ট, শোষণ-নিপীড়ন, যুদ্ধ, মৃত্যু!…মানুষেরই মাঝে বহুকাল ধরে বহুলাংশে ভদ্রতার মুখোশে প্রভুত্ব করছে শয়তান-মানুষ, গোঁড়ামি, বর্বরতা।…ফাঁপা মানুষের ভিড়ে, অন্ধকারে মিলিয়ে যায় প্রকৃত মানুষের স্বপ্ন, আলোর ঝিলিক।…শতাব্দ একবিংশে বৃহত্তর মানুষ কোনও বৃহৎ শুভেচ্ছারেখায় ঐক্যবদ্ধ/স্থির হতে পারল না; বরং এখানে-ওখানে অস্ত্রের ঝনঝনানি, কবজিবাজি, মৃত্যুমৃত্যু খেলা। প্যান্ডেমিক, যুদ্ধ-মৃত্যু, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ আরও নানাবিধ কারণে বিপর্যস্ত পৃথিবী’। শিল্প-সাহিত্যের কাগজে উল্লিখিত কথাগুলোরও একটি সমীচীন ব্যাখ্যা দিয়েছেন সম্পাদক ফয়জুর রহমান ফয়েজ এভাবে: ‘শিল্প-সাহিত্যের মানুষ শুধু সাহিত্যশিল্পালাপই করে না, কারণ— তারাও পৃথিবীর বাসিন্দা-মানুষ।…মানুষ, মানুষের সমাজ তথা দুনিয়াদারি নিয়েও শিল্পী-সাহিত্যিকের কারবার।…মানুষের জন্য মানুষ, মানুষের জন্য শিল্পসাহিত্য।…শিল্পসাহিত্য আদৌ মানুষকে অকল্যাণের পথে হাঁটার ইঙ্গিত দেয় না, বরং মানুষকে আত্মোন্নয়নে উদ্বুদ্ধ করতে চায় আর বলতে চায়Ñসুন্দর হও, নিজেকে জানো, মানুষকে জানো, মানবিক হও’।

ভেতর পাতার কথায় আসা যাক এবার: ছোটকাগজের অনিবার্য অধ্যায় হলো কবিতা। গুচ্ছ গুচ্ছ কবিতায় আছেন— শিমুল মাহমুদ, হোসনে আরা কামালী, মুহম্মদ ইমদাদ, ফজলুররহমান বাবুল, ওয়ালি মাহমুদ, সৈয়দ আফসার, আবু মকসুদ, বেলাল আহমেদ, নুসরাত সুলতানা, প্রমুখ। ফিলিস্তিনের কবি ফাদওয়া তুকানের কবিতার ভাষান্তরে অনন্ত নিগার। গল্পে: কামাল রাহমান, প্রশান্ত মৃধা, শেখ লুৎফর, নাজমুল হক নাজু। প্রবন্ধে: হাফিজ খান রশিদ, ওয়াহিদ রোকন। গুচ্ছ হাইকুতে মালেকুল হক। কাব্য ও গ্রন্থালোচনায়: মোস্তাক আহমাদ দীন, জাহেদ আহমদ, অনুপম হাসান। মুক্তগদ্যে শিমুল মাহমুদ। প্রয়াত কবি ফজলুল হক ও দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুর স্মরণে কলম ধরেছেন: মঈনুস সুলতান ও মোহাম্মদ জায়েদ আলী। টি এস এলিয়টের ছোটকাগজ বিষয়ক ধারণা নিয়ে লেখার অনুবাদে আছেন পার্থসারথি ভৌমিক।

‘তৃতীয় জাগরণের পথে বাঙালি ও বাংলা কবিতা’ শিরোনামের হাফিজ রশিদ খানের প্রবন্ধটি ভালো লাগলো। গুচ্ছ গুচ্ছ গদ্য কবিতাগুলোর রসবোধ আচ্ছন্ন করে রাখে। অনুবাদ কবিতা ভিন্ন দ্যোতনার আনন্দ জুগিয়েছে। মোস্তাক আহমাদ দীনের হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ‘আমার সাহস’ কবিতাটির নিখুঁত বিশ্লেষণ, জাহেদ আহমেদের লেখা ফজলুররহমান বাবলুর কবিতার বই ‘তুমি তেমনই বৃক্ষ (২০২০) এবং অনুপম হাসানের লেখা জওয়াহের হোসেনের কবিতার বই ‘যুবিভাব সঙ্গ’ আলোচনা পাঠমুগ্ধ করল। ভিন্নতর স্বাদ খুঁজে পেলাম কবি জহির হাসানের লেখার ওপর কথ্যভাষায় লিখিত শিমুল মাহমুদের মুক্তগদ্যটি। মঈনুস সুলতান ও মোহাম্মদ জায়েদ আলীর স্মৃতিকথায় কবি ফজলুল হক এবং দেলোয়ার হোসের মঞ্জু সম্পর্কে জানা গেল অজানা কিছু। গল্পগুলোতেও আছে আনন্দের যথেষ্ট খোরাক। যা পাঠককে অবলীলায় বুঁদ করে রাখে। পরিশেষে অনুবাদক পার্থসারথি ভৌমিকের টি এস এলিয়টের ‘সাহিত্য পত্রিকা’ বিষয়ক লেখাটি একযোগে সম্পাদক, লেখক, সমালোচক ও পাঠক সবাইকে উপকৃত করবে। এবং এ লেখার মাধ্যমেই শেষ হয় ১৩৬ পৃষ্ঠার ছোটকাগজ ‘মনোজ’ এর চতুর্থ সংখ্যাটি।

প্রবীণের পাশাপাশি নবীনের সৃষ্টিশীলতার একটি সুষম ক্ষেত্র তৈরি করাই ছোটকাগজের মূল লক্ষ্য এবং বৈশিষ্ট্যও। শুরুতে বলা কথাটিই আবার বলছি, পরিস্থিতির শত প্রতিকূলতাকে থোড়াইকেয়ার করে এমনকি অলাভজনক জেনেও কেবলমাত্র শুদ্ধ চিন্তার পুষ্টিময় চাষের আশায় একজন সম্পাদক এগিয়ে আসেন এই মহতী উদ্যোগে। এসেছেন ফয়জুর রহমান ফয়েজও। সত্যজিৎ রাজনের নান্দনিক প্রচ্ছদ, উন্নত কাগজ, মুদ্রণপ্রমাদহীন, এবং সূচির গোছানো ক্রমধারায় ‘মনোজ’এর এ সংখ্যাটিতে সম্পাদকের রুচি ও মননশীলতার বহিঃপ্রকাশ সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে, একটি ছোটকাগজকে এগিয়ে নেয়ার বিশাল কর্মযজ্ঞ কখনোই একার কর্ম নয়, হতে পারে না। প্রচ্ছদশিল্পী, অক্ষরবিন্যাস, প্রম্নফ রিডারসহ আরও অনেকের সমন্বিত কর্মের ফল ছোটকাগজ। কারো অবদানই কম কিছু নয়। তাই আমি মনে করি তাদের (যেমন: অক্ষরবিন্যাস, প্রম্নফরিডার, প্রকাশন) নামও যুক্ত করা হলে ভালো হয়। এতে তাদের কাজের স্বীকৃতির পাশাপাশি স্পিরিটও বাড়বে বই কমবে না। (এটি আমার নিজস্ব আভিমত)। বর্তমান সময়ের উদ্ভুত নানা সমস্যা, সঙ্কট, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির চাপের কুপ্রভাব শিল্প-সংস্কৃতির ওপরেও মারাত্মকভাবে পড়ছে। ব্যহত হচ্ছে, হতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে কোনোটি মাঝপথে থেমে যাচ্ছে। এমন বিরূপ সময়ে তাঁর এই উদ্যোগে শুভেচ্ছা ও সাধুবাদ জানাচ্ছি। প্রায় চলতে শুরু করা এই চৌকস ছোটকাগজ ‘মনোজ’ পাঠক সমাদৃত হোক এবং সফলতায় এগিয়ে যাক আরও বহুদূর।

Sheikhsbay
Back to top button
Close
Close