জামায়াতে থেকে পরিবর্তন সম্ভব নয় তাই পদত্যাগ করেছি: ব্যারিস্টার রাজ্জাক
এবি পার্টি যুক্তরাজ্য শাখার আহবায়ক কমিটি গঠিত
।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ৭ সেপ্টেম্বর : সাবেক শীর্ষ জামায়াত নেতা, নবগঠিত আমার দেশ পার্টির (এবি পার্টি) প্রধান উপদেষ্টা, বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল রাজ্জাক সোজাসাপ্টাই বলেছেন, জামায়াতে থেকে পরিবর্তন সম্ভব নয় তাই পদত্যাগ করেছি। অতঃপর তিনি যোগ করেন, আমরা এখন পরিবর্তিত বিশ্বে বসবাস করছি। নতুন প্রেক্ষাপটে নতুন দল ছাড়া পরিবর্তন সম্ভব নয়। আমি যখন দেখলাম আমার পুরাতন বলয়ে থেকে কোনো ধরণের পরিবর্তন সম্ভব নয় তখনই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিই। ৩৩ বছর জামায়াতে ছিলাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, সাধারণত জামায়াত থেকে রেজিগ্নেশন গ্রহণ করা হয় না। আর রেজিগ্নেশন গ্রহণ করা হলেও তা পাবলিকলি প্রকাশ করা হয় না। কিন্ত আমারটা গ্রহণ করা হয়েছে। আর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের প্রধান আইনজীবী হিসেবে ডিফেণ্ড করা প্রসঙ্গে বলেন, ডিফেন্স যে কোনো মানুষের রাইট থাকে, তাই আমি ডিফেণ্ড করেছি। এ প্রসঙ্গে তিনি আরো উল্লেখ করেন, ব্যারিস্টার একে ব্রোহী পাকিস্তানী নাগরিক হয়েও শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকেও ডিফেণ্ড করেছিলেন।
সাপ্তাহিক সুরমার পক্ষ থেকে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের কাছে প্রশ্ন ছিলো — তাদের এবি পার্টির যে মূলনীতি ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ (যা মুক্তিযুদ্ধেরও মূলনীতি) দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দীর্ঘদিন জামায়াতের সাথে থাকাকালীন একজন শীর্ষ নেতা হিসেবে তাঁর কেন এসব প্রতিষ্ঠার উপলব্ধি হলো না? তাছাড়া তিনি যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত জামায়াত নেতাদের ডিফেন্ট করার পর এবং তাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর কেন তিনি উপলব্ধি করলেন যে, ৭১-এ জামায়াতের সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো এবং এ জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিৎ ছিলো? শেষোক্ত বিষয়ে — ডিফেন্স মানুষের অধিকার সেটি বললেও তাঁর দেরীতে উপলব্ধির বিষয়ে কিছু বলেননি।
এছাড়া এবি পার্টির কাছে আরো প্রশ্ন ছিলো যে, প্রবাসে দেশীয় রাজনীতি সম্পর্কে নানা কারণে এখানকার কমিউনিটি অনেক নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছে তারপরও তারা কেন এই চর্চা করতে যাচ্ছেন এবং তাদের ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে তাদের দলীয় চিন্তাভাবনা কী? জবাবে বলা হয়, এই বিলেতে তথা বিদেশে অনেক সুশিক্ষিত ও বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ অনেক বাংলাদেশী রয়েছেন তারা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ চলমান অপরাজনীতির পরিবর্তে দেশকে ইতিবাচক রাজনীতিতে উত্তরণে ভূমিকা রাখতে পারবেন, তাই তাদের ইউকে কমিটি গঠন। তবে আপাতত ছাত্র রাজনীতির ব্যাপারে তাদের কোনো চিন্তা নেই জানানো হয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে নতুন যাত্রা শুরু করা রাজনৈতিক দল এবি পার্টির যুক্তরাজ্য শাখার আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়েছে। গত ৬ সেপ্টেম্বর, সোমবার পূর্ব ল-নের হোয়াইটচ্যাপেরে একটি রেস্টরেন্টে উক্ত পার্টির যুক্তরাজ্য শাখার আহবায়ক কমিটির আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন এবং সেমিনারের আয়োজ করা হয়। এবি পার্টির যুক্তরাজ্য শাখার আহবায়ক কমিটির পরিচিতি উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন ও সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
এবি পার্টি, যুক্তরাজ্য শাখার সদস্যসচিব ব্যারিস্টার সাইফ উদ্দিন খালেদের পরিচালনায় স্বাগত বক্তব্য রাখেন আহবায়ক মুহাম্মদ হারুনুর রশীদ। কীনোট স্পীকার ছিলেন ড. শাহেদ চৌধুরী। কীনোট বক্তব্যে বাংলাদেশের বর্তমান হালচাল তুলে ধরে শাহেদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের প্রফেশনাল প্রবাসীরা আশা হারিয়ে ফেলেছে। সবাই চেঞ্জ চায়। ডিফেন্স যে কোনো মানুষের রাইট থাকে, তাই আমি ডিফেন্স করেছি। সাম্প্রতিক পরীমনিসহ বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, কিন্তু এসব কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। আর এর ফাঁকে মাফিয়া গ্রুপের স্থায়ী হয়ে গেছে। প্রতিপত্তিশালীরাই নতুন প্রজন্মের আইডল হয়ে যাচ্ছে। অতীতে কে কি করলো না করলো এসব নিয়ে সরব বাহাসের উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে এখন পশ্চাদপদমুখী রাজনীতি চলছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য এখন দরকার ফরওয়ার্ড থিংকিং পলিটিক্স।
ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পঞ্চাশ বছরের উল্লেখ করে বলেন, এই পঞ্চাশ বছরে যে কিছু হয়নি তা নয়, অনেক উন্নতি হয়েছে। প্রত্যেক সরকারেরই নেগেভিট ও পজেটিভ দিক রয়েছে। প্রত্যেক সরকারই কিছু কিছু কন্ট্রিবিউট করেছে। রাস্তাঘাট হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে সম্প্রসারণ লাভ করেছে। ইমপাওয়ারমেন্ট ফর দ্যা উইমেন হয়েছে। এনার্জি সেক্টর ডেভেলাপমেন্ট হয়েছে। সে হিসেবে আমাদের ব্যালেন্স শিটে পজেটিভ কম নয়। কিন্তু এসব পজেভিটস নেগেটিভ কর্মকা-ের মাধ্যমে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। যে গণতন্ত্রের জন্য মানুষ সবসময় আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে সেই গণতন্ত্র আজ বিপন্ন।
তিনি ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ, তিতুমীরের আন্দোলনকে গণতন্ত্র ও স্বাধিকারের আন্দোলন বলে উল্লেখ করে বলেন, সবসময়ই স্বাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চলমান ছিলো।
আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশের বড় সমস্যা হলো সামাজিক অবক্ষয়। এসব অবক্ষয়ের সাম্প্রতিক কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এ থেকে দেশ ও জাতিকে উত্তরণের জন্য ন্যাশনাল কনশাসনেস ছাড়া একটা পলিটিকেল পার্টি কিছু করতে পারবে না। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশী জাতির ক্ষতি বা খারাপ যেটা হয়েছে তা হলো শিক্ষিত মানুষ রাজনীতি থেকে দূরে চলে গেছে। রাজনীতি এখন চলে গেছে এমন সব মানুষের যারা রাজনীতির মাধ্যমে নিজেদের আখের গোঁজাতে ব্যস্ত। দেশ এবং জাতির কল্যাণ সাধনের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।
বিচার ব্যবস্থা বিষয়ে তিনি বলেন, জুডিশিয়ারি হচ্ছে একটা দেশের প্রাণ। আজকে যে পাশ্চাত্য সভ্যতা টিকে আছে তা আল্লাহ তাআলা ভালো জানেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, তার অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে জুডিশিয়ারি। জুডিশিয়ারির প্রধান দুটি দিকের উল্লেখ করে তিনি বলেন, আনফরচুনেন্টলি আমাদের জুডিশিয়ারির দুটিই আমরা ক্রস করেছি। বাংলাদেশে জুডিশিয়ারির ইনডিপেণ্ডেন্স নেই মন্তব্য করে তিনি বলেন, পঞ্চাশ বছরেও আমাদের দেশে চীফ জাস্টিস কে হবে সে সম্বন্ধে কোনো আইন নেই। এক্ষেত্রে সব সরকার স্বেচ্ছাচারিতা করে যাচ্ছে।
বিভাজনের রাজনীতির প্রসঙ্গে বলেন, দেশে চরম বিভাজনের রাজনীতিতে চরম চলছে। এতো বিভেদ বিভাজনের মধ্যে দেশকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের জাতি কতোটা যে বিভক্ত হয়েছে এ প্রসঙ্গে তিনি একটি উদাহরণ দিয়ে বলেন, তিনি আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই শীর্ষ নেতার সাথে আমেরিকান এম্বেসিতে এই বৈঠক শেষে যখন কথা বলছিলেন তখন আওয়ামী লীগ নেতা বলেছিলেন যে, তিনি বিএনপির একজনের জানাজায় যাওয়ার জন্য কাপড় পড়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কিন্তু খবর আসলো যে, জানাজায় যাওয়া যাবে না। এসব থেকে বাঁচতে হলে আমাদের নতুন রাজনীতি ছাড়া উপায় নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই নতুন রাজনীতি হচ্ছে রিরোধীদলকে একটি রেসপন্সিবল পার্টি হতে হবে। দেশ ও জাতি যে জায়গা থেকে দূরে সরে গেছে সেখান থেকে ফিরে আসতে হবে। বিদ্যমান এই বিভাজন থেকে উত্তরণ যদিও লং ওয়াক বা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ বিষয় তবু দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার জন্যই এবি পার্টি যাত্রা শুরু করেছে।
এদিকে, বিভিন্ন দল থেকে আগত রাজনীতিক, সলিসিটর, ব্যারিস্টারসহ স্ব স্ব অঙ্গনে মেধাবী পেশাজীবীদের সমন্বয়ে আহবায়ক কমিটি গঠন করেছে যুক্তরাজ্য এবি পার্টি। তাদের কেউ কেউ ডাকসু ও জাকসু‘র নির্বাচিত কমিটির সদস্য হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অনেকেই জাসদ, সর্বহারা পার্টি, ছাত্রলীগ ও জামায়াত-শিবিরের মাধ্যমে জাতীয় রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। রয়েছেন নারী সদস্যও। ২৪ সদস্যের ঘোষিত কমিটির আহবায়ক হলেন মুহাম্মদ হারুনুর রশীদ এবং সদস্যসচিব ব্যারিস্টার সাইফ উদ্দিন খালেদ। তাছাড়া যুগ্ম আহবায়করা হলেন যথাক্রমে ব্যারিস্টার খান গোলাম আজম, ব্যারিস্টার সাঈদ হাসান, আবদুল আউয়াল মামুন, আব্দুল মুমিত ঝুরু। অতিরিক্ত সদস্যসচিব ব্যারিস্টার মুহাম্মদ নুরুল গাফফার, এডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম, সাঈদ বাকী ও সৈয়দ জুলকারনাইন আহমদ জুম্মা। সাংগঠনিক সম্পদকগণ হলেন মো. মহিব উল্লাহ, সলিসিটর মুনসাত হাবীব চৌধুরী, ব্যারিস্টার একেএম সিফাত উল্লাহ, আজাদ করিম ও কবির আলী। সহকারী সদস্যসচিব কবির হোসাইন ও উম্মে হাবীবা। প্রযুক্ত বিষয়ক সম্পাদক রেজাউল ইসলাম সাজু। তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক বসিরুজ্জামান বাবু। সদস্য যথাক্রমে এনামুল হক, জালাল পাটোয়ারী, ব্যারিস্টার মাহমুদ হাসান, ব্যারিস্টার আব্বাস ইসলাম খান ও মিজানুর রহমান শিপু।
আহবায়ক কমিটিকে পরিচয় করিয়ে দেন আহবায়ক মুহাম্মদ হারুনুর রশীদ। কমিটির উপস্থিত সদস্যরা পরিচিতিসহ সংক্ষেপে পেশা এবং পূর্ব কার্যক্রম তথা রাজনৈতিক সম্পৃক্ত ও অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।