দিল্লীর আদলে ঢাকায়ও সরকারি থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক: ৪২ সাবেক সচিবের উদ্যোগ ।। নেপথ্যে কারা ।। প্রশাসনে তোলপাড়
।। বিশেষ প্রতিবেদক ।।
গত এক দশকে প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ৪২ জন সাবেক সচিব দিল্লিতে বিজেপির থিঙ্কট্যাঙ্ক বলে পরিচিত অবজারভার ফাউণ্ডেশনের আদলে বাংলাদেশে একই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। গত ২৮ জানুয়ারী ঢাকায় সরকার ঘনিষ্ঠ সাবেক সচিবদের বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। যদিও সাবেক সচিবদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে কর্মজীবনে তাদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগাতে বৈঠকে একটি ফোরাম বা সংগঠন করার বিষয়ে একমত হয়েছেন সরকারের এই অবসরপ্রাপ্ত শীর্ষ কর্মকর্তারা। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও তার ফলাফলকে ত্বরান্বিত করতে তাঁদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞাকে কাজে লাগাতে চান তাঁরা। এ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সাবেক সচিব শৈলেন্দ্রনাথ মজুমদার।
চিঠি দিয়ে বৈঠকটি আহ্বান করেছেন দুদকের চেয়ারম্যান। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদসহ ৪২ জন সাবেক সচিব এই বৈঠকে অংশ নেন। সোমবার বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির এক সভাকক্ষে এই বৈঠক ডাকা হয়। ইংরেজি নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে দেওয়া এ চিঠিতে ইকবাল মাহমুদ বলেন, জীবনের এক বড় সময় আপনি দেশ ও
জাতির সেবায় নিয়োজিত থেকেছেন। এ সেবা দেওয়ার সময় অর্জন করেছেন বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা, গ্রহণ করেছেন দেশে-বিদেশে নানা প্রশিক্ষণ, প্রত্যক্ষ করেছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাঁকবদল। এ ছাড়া আপনার রয়েছে চমৎকার শিক্ষাগত যোগ্যতার পটভূমি। এসবের মিথস্ক্রিয়ায় আপনি ধীরে ধীরে হয়েছেন ঋদ্ধ, পরিণত ও প্রাজ্ঞ। আপনার অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞা দেশের নীতি প্রণয়ন, বাচ্চবায়ন ও তার ফলাফলকে ত্বরান্বিত করতেও পারে। দেশ ও জাতি এগিয়ে যেতে পারে সবার ইতিবাচক সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য দিয়ে।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত একজন সাবেক আমলা বলেছেন, এই উদ্যোগটি গত কয়েকদিন ধরেই সরকারের প্রিয়ভাজন কয়েকজন সাবেক সচিব আলোচনা করছিলেন। যথাসম্ভব তারা এই প্রস্তাবনা যাদের কাছ থেকে পেয়েছেন, তারা দিল্লীর অবজারভার ফাউন্ডেশন এর মত একটি প্রতিষ্ঠান করার কথাই বলেছেন। অবজারভার ফাউন্ডেশন কি এবং কেন, তাদের মধ্যে এব্যাপারে অনেক আলোচনা পর্যালোচনা হয়েছে।
সাবেক সচিবদের বৈঠক সম্পর্কে ঢাকায় আমাদের সহকর্মীরা বলছেন, এই সম্মিলিত প্রয়াসের উপায় ও ধরন কী হওয়া উচিত বা সাবেক সচিবদের সমন্বয়ে কোনো একটি প্ল্যাটফর্ম করা যায় কি না, তা আলোচনার দুদক চেয়ারম্যান এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। বৈঠকে ৭৩,৭৭, ৭৯,৮১, ৮২ ও ৮২ (বিশেষ), ৮৪ ব্যাচের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যায়।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, সাবেক সচিব নজরুল ইসলামকে আহ্বায়ক ও হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনকে সদস্যসচিব করে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের অবসরপ্রাপ্ত সচিবদের জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দেশ ও সমাজের কল্যাণে কাজে লাগানোর জন্য এ সংগঠন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি হবে একটি গবেষণা ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান।
বৈঠকটি গোপন ছিল কি না জানতে চাইলে আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব বলেন, না, আমরা এ বিষয়ে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। আমার স্বাক্ষরে একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি তথ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। এখন তারা গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে কি না, তা আমার জানা নেই।ৃপ্রসঙ্গত, তথ্য অধিদপ্তর সরকারের
তথ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন একটি বিভাগ। এই অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, কোনো বেসরকারি ব্যক্তি বা সংগঠনের খবর পিআইডি প্রচার করতে পারে না। পিআইডির কাজ সরকারের খবর প্রচার করা।
এছাড়া প্রতিষ্ঠানের গঠনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক এসডিজিবিষয়ক (সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল) মুখ্য সমন্বয়ক ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদকে প্রধান করে ওই সংগঠনে গঠনতন্ত্র তৈরির জন্য আরেকটি কমিটি করা হয়েছে। গঠনতন্ত্রের বিষয়ে জানতে চাইলে আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতাকে রাষ্ট্রের কাজে লাগাব। তাই সব সাবেক সচিবের অংশগ্রহণেই হবে এ সংগঠন। প্রথমে একটি খসড়া তৈরি করে সবার ই-মেইলে দেওয়া হবে। তারপর সবার মতামত নিয়ে এর গঠনতন্ত্র তৈরি করা হবে।
প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, এ ধরনের ফোরাম গঠনের উদ্দেশ্য হতে পারে সরকার ও প্রশাসনের বিভিন্ন কাজে ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করা।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবের গুরুতর প্রশ্ন?
এই সভা ও দুদক চেয়ারম্যানের চিঠি দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেন, প্রথমত, দুদক চেয়ারম্যানের এ ধরনের চিঠি দেওয়া অনৈতিক। দ্বিতীয়ত, তাঁরা সব সাবেক সচিবকে আমন্ত্রণ জানাননি। ফলে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যে এই সভা করা হয়েছে, তা পরিষ্কার।
চিঠির বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, তিনিও অবসরপ্রাপ্ত একজন সচিব। আর এটা ছিল পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সাবেক কয়েকজন সচিব গণমাধ্যমকে বলেছেন, ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রাক্কালে এ ধরনের বৈঠক, সাদা কাগজে দুদক চেয়ারম্যানের আমন্ত্রণ এবং একই আদর্শে বিশ্বাসী সব সচিবকে এক হওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাঁরা বলেছেন, যাঁরা সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন, তাঁরাই উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সচিব সোহরাব হোসাইন, মিজানুর রহমান, এ এস এম রশিদুল হাই, আতাউর রহমান, সিরাজুল হক, ইব্রাহীম হোসেন খান, সি কিউ কে মুশতাক, মোহাম্মদ মইনুদ্দিন আবদুল্লাহ, এম এ কাদের সরকার, মিকাইল শিপার, সেলিনা আফরোজ, শহিদুল হক, কাজী আখতার হোসেন, মাহবুব আহমেদ, আবদুল হান্নান প্রমুখ।
দিল্লির অবজারভার ফাউণ্ডেশন কানেকশন:
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত একজন সাবেক আমলা বলেছেন, অনেকে ভাবতে পারেন এটা মনে হয় আওয়ামী লীগের একটা ইনোভেটিভ উদ্যোগ। আসলে তা নয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিজয় শংকর ভারতে ওআরএফ নামে রিটায়ার্ড সেক্রেটারিদের একটি প্রতিষ্ঠান করেছেন। ওআরএফ এর পুরো নাম হল – অবজারভার রিসার্চ ফাউণ্ডেশন। এক্ষেত্রে তারা একটি চাতুরতার পরিচয় দিয়েছে। নব্বইয়ের দশকে একই নামে প্রতিষ্ঠিত একটি অখ্যাত এনজিওকে তারা বছর দুয়েক আগে কব্জা করে বিজেপির ফিলোসফির আদলে সাজিয়েছে। এই উদ্যোগটি গত কয়েকদিন ধরেই
সরকারের প্রিয়ভাজন কয়েকজন সাবেক সচিব আলোচনা করছিলেন। যথাসম্ভব তারা এই প্রচ্চাবনা যাদের কাছ থেকে পেয়েছেন, তারা দিল্লীর অবজারভার রিসার্চফা ফাউন্ডেশন এর মত একটি প্রতিষ্ঠান করার কথাই বলেছেন। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন কি এবং কেন, তাদের মধ্যে এব্যাপারে অনেক আলোচনা পর্যালোচনা হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত সচিবদের বেশ কয়েকজনের ঘনিষ্ঠ এই আমলা বলেন, দিল্লিতে প্রতিষ্ঠিত একটি পুরনো উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং বিভিন্ন পর্যায়ের সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের এবং নিরাপত্তা ও অন্যান্য বিষয়ে বিজেপির জন্য কাজ করে তাদেরকে দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা শুরু করে। বর্তমানে অবজারভার ফাউন্ডেশন হচ্ছে বিজেপির প্রধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান। বিজেপিকে আরএসএস এবং শিব সেনার মত উগ্রবাদী হিন্দুদের ইমেজ থেকে বের করে আনার জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে চলেছে। এই সাবেক আমলা আরও বলেন, এই প্রতিষ্ঠানটি গবেষণার চেয়ে অনেক বেশি বেশি রাজনীতি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভূমিকা রাখছে। এই প্রতিষ্ঠানটিকে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির জন্য দায়ী রাষ্ট্রের অর্থায়নে পরিচালিত হওয়ার অভিযোগও করছেন দিল্লির সিভিল সমাজের একটি বড় অংশ। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা বিশ্বেরবিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে কাজ করে থাকে। দিল্লিতে অবজার্ভার ফাউণ্ডেশন ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে ওই দেশটির নীতি-নির্ধারণী সংস্থায় পরিণত হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই সাবেক আমলা আরও মনে করেন, গত এক দশকে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ভারতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু করেছিলেন মুলত এই সাবেক আমলারা। এখন এই থিংকট্যাংক এর মাধ্যমে প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সকল বিষয়ে ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশটির স্বার্থ রক্ষার জন্য এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে কাজ করে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
একসময়ের প্রশাসনে অত্যন্ত প্রভাবশালী এই আমলা আরও বলেন, অবজারভার রিসার্চ ফাউণ্ডেশন বিভিন্ন নামে ও পরিচয়ে দেশে-বিদেশে সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে। অনেকটা ইংল্যান্ডের চাথাম হাউস এর মত। সম্প্রতি তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশে তাদের একটি স্থায়ী পরিকাঠামো দরকার। এর জন্য তারা বেছে নিয়েছে বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাকে। তিনি সাবেক হয়ে ও গত কয়েক বছর যাবত একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকারি শীর্ষ পদ দখল করে আছেন। রাজনীতি ও ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ, শত শত কোটি টাকার প্রশাসনিক চাঁদাবাজি এবং সরকারি দপ্তর ব্যবহার করে ত্রাস সৃষ্টির মতো অভিযোগ রয়েছে এই দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। অনির্বাচিত সরকারের কয়েকটি বিশেষ এজেন্ডা বাচ্চবায়নের জন্যই তাকে নিয়োগ করা হয়েছিল এবং তিনি অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তার মিশন অব্যাহত রেখেছেন। তার নেতৃত্বেগ গতনির্বাচনের আগে ৬৪ জন সাবেক সচিব ৬৪ জেলায় সার্কিট হাউজে অবস্থান করে স্থানীয় প্রশাসনকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। নির্বাচনের আগের রাতে যে ভোট হয়েছে, এতে এই সচিব নামধারী দালাল কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা রয়েছে বলে এই সাবেক আমলা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপন করেন। শিগগিরই দেখা যাবে এই দালালদের মাধ্যমে সরকার গবেষণার নামে হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। এই কর্মকর্তা আরো বলেন, প্রশাসন ক্যাডারকে সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, ত্রাস সৃষ্টি, ভোট জালিয়াতি – ভোট ডাকাতি এবং তৃতীয় শ্রেণীর রাজনৈতিক কর্মীর
ভূমিকায় নামিয়ে আনার জন্য চরম দুর্নীতিবাজ এই সাবেক সচিবসহ আরো কয়েক ডজন সাবেক সচিবের নামে অসংখ্য অভিযোগ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে সংরক্ষিত আছে। প্রশাসনে এসব নিয়ে চলছে তোলপাড়। প্রশাসন ক্যাডার সহ অন্যান্য ক্যাডারের সৎ কর্মকর্তারা এসব দুর্নীতিবাজ ও দলীয় কর্মীর আবরণে তথাকথিত সচিবদের বিরুদ্ধে ধীরে-ধীরে সংগঠিত হচ্ছেন বলেও এ কর্মকর্তা আভাস দিয়েছেন।