নিউজ

‘উন্নয়নের রোল মডেলের হাতে ভিক্ষার থালা

সেই আইএমএফ-র কাছেই ধর্ণা

  • দেউলিয়াত্ব থেকে বাঁচাতে “বেইল আউট” : আন্তর্জাতিক মিডিয়া
  • ঋণ পাওয়া কঠিন হতে পারে: ড. রেজা কিবরিয়া
  • আরো তিন বিলিয়নের আবেদন অন্যদের কাছে : আলী রীয়াজ
  • বেইল আউট’ বলা জাতিগত অপমান : প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব

|| আরিফ শামস ||
লণ্ডন ৪ আগস্ট : বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ’কে নির্বিচারে গালাগাল করা হলো গত ১০ বছর। পদ্মা সেতু দুর্নীতির অভিযোগ করায় করে ঋণ প্রত্যাহারের কারণে হাসিনা সরকার ওই সীমাহীন গালাগালি করেছিলেন।। অবশেষে সেই আইএমএফের কাছেই ঋণের থালা হাতে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা সরকার। উন্নয়নের রোল মডেল দাবিদার বাংলাদেশকে তার সরকার ভিক্ষার থালা হাতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে। আইএমএফ’র সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ডক্টর রেজা কিবরিয়া বলছেন, হাসিনা সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি ও লুটপাটের অর্থনীতি কায়েমের কারণে এই ঋণ পাওয়া কঠিন হতে পারে। অন্যদিকে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বনামধন্য একাডেমিক ডক্টর আলী রীয়াজ বলছেন, শুধু আইএমএফ নয়, অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের কাছেও সরকার আরো তিন বিলিয়ন ঋণ চেয়েছে। কেন এই ঋণ চাইতে হয়েছে, সেটা নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর কাছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়েছে। এই ঋণ চাওয়ার বিষয়টি শুরুতে সরকারের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হলেও আইএমএফ জানায়, বাংলাদেশ থেকে ঋণ চেয়ে তাদের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব গিয়েছে। ‘এই মুহূর্তে আইএমএফ এর ঋণের প্রয়োজন নেই’ অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এমন বক্তব্য দেওয়ার কয়েকদিন পরই ঋণ চাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নেন। অর্থমন্ত্রী এখন বলছেন, আইএমএফের কাছে ঋণ চাওয়ার মানে এই নয় বাংলাদেশের অর্থনীতি খারাপ অবস্থায় আছে।

অন্যদিকে, আইএমএফ এর কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়টিকে ‘বেইল আউট’ থেকে বাঁচার প্রয়াস হিসেবে দেখানোর বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে জাতিগত অপমানের শামিল বলে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেছেন, বেইল আউট বা দেউলিয়া হওয়া থেকে বাঁচতে নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় যে বাণিজ্য ঘাটতি হয়েছে, সেটি মেটাতেই আইএমএফ এর কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব এমন কথা বললেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশের ঋণ চাওয়ার বিষয়টি নিয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলোতে ঘুরেফিরেই আসছে ‘বেইল আউট’ শব্দদ্বয়।

অর্থনীতি বিষয়ক বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের জন্য (যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক) বিশ্ববিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গ এ অ্যান্ডি মুখার্জি “বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে, কিন্তু এখন তাকে প্রতিবেশীর কাছ থেকে শিখতে হবে” শিরোনামে তার কলামে লিখেছেনঃ ঢাকা ক্রমবর্ধমান ধুকছে তবে দেশটি তার অর্থনীতিকে আরও ঠিক করতে আইএমএফ এর বেইল আউটকে কাজে লাগাতে পারে। গত বছর জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু জাতীয় আয় ভারতের চেয়েও বেশি। কিন্তু, উদযাপনের বিষয়টি ব্যাহত হয়েছে একটি কড়াঘাতে। বাংলাদেশ এখন কঠিন মুদ্রা ঘাটতির সম্মুখীন যা থেকে বের হতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বেইল আউট প্রয়োজন।

প্রভাবশালী বৃটিশ পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের শিরোনামেই ছিল বেইল আউট কথাটি। “বেইল আউটের আবেদনের পর আইএমএফের সঙ্গে আলোচনায় বসছে বাংলাদেশ” শীর্ষক প্রতিবেদনে পত্রিকাটি শুরুতেই লিখেছেঃ দেশে নগদ অর্থের অভাব ঠেকাতে বেইল আউটের আবেদনের পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মহামারী চলাকালীন প্রায় ৯০ টি দেশ আইএমএফের কাছে সাহায্য চাইলেও মাত্র কয়েকটি দেশ ঋণ খেলাপি হওয়া বা বিল পরিশোধ করতে অক্ষম হওয়ার জন্য বেইল আউট চাইতে বাধ্য হয়েছে বলেও উল্লেখ করে গার্ডিয়ান।

বেইল আউটের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল কোথায় ব্যয় করা হয় সে সম্পর্কে স্বচ্ছতার উপর অতীতে আইএমএফ কর্মকর্তারা জোর দিয়েছিলেন বলেও প্রতিবেদনে বলা হয়।

শ্রীলঙ্কান ইংরেজি দৈনিক ডেইলি মিরর এ “বাংলাদেশ কেন আইএমএফ এর বেইল আউট চাচ্ছে?” এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেয়েছেন পি.কে. বালাচন্দ্র। তিনি লিখেছেনঃ ২০২১ সালের মে মাসে, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কারেন্সি সোয়াপ (মুদ্রা বিনিময় প্রথা) সুবিধা দিয়েছিল যাতে বৈদেশিক মুদ্রার গুরুতর রকম ঘাটতিকে মোকাবিলা করা যায়। কিন্তু এক বছর পর, বাংলাদেশ নিজেই বাজেট এবং বেলেন্স অফ পেমেন্ট সহায়তার জন্য আইএমএফ এর কাছে ৪.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেইল আউট প্যাকেজ চাইছে।

ভারতের উইওন নিউজ এর এক প্রতিবেদনের শুরুতেই উপস্থাপিকা বলেনঃ বেইল আউট নিয়ে আলোচনা করা যাক। দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি দেশের টাকা দরকার। শ্রীলঙ্কা দিয়ে শুরু হয়েছিল, এরপর পাকিস্তান, এখন বাংলাদেশও আইএমএফ এর দ্বারে সাহায্য প্রার্থনা করছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশজুড়ে এমনকি ১৩ ঘন্টা পর্যন্ত ব্ল্যাকআউট (বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে অন্ধকারে ডুবে যাওয়া) হচ্ছে উল্লখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়ঃ বাংলাদেশের জন্য এই (আইএমএফ এর) ঋণ পাওয়াটা এখন প্রয়োজনীয়। কারণ দেশটির অর্থনৈতিক মানদন্ডগুলো ভালো ঠেকছে না। বিগত মাসগুলোতে বাংলাদেশের আমদানি লাফিয়ে বেড়ে ৩৯% হয়েছে। যেখানে রপ্তানি বেড়েছে ৩৪%। তাছাড়া, বাংলাদেশের টাকার মান ডলারের বিপরীতে ২০% কমেছে।

অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ঋণের আবেদন : ড.আলী রীয়াজ

ড. আলী রীয়াজ তাঁর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে লিখেছেন,বাংলাদেশের চাওয়া সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ‘বেইল আউট’ নিয়ে আইএমএফ’-এর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। প্রায় নয় দিন ধরে আলোচনার পর এই অগ্রগতির ফলে এখন দ্বিতীয় প্রতিনিধি দল ঢাকা আসবে। ইতিমধ্যেই আই এম এফ-এর শর্তগুলো সম্পর্কে কিছু ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। সেখানে যা বলা হচ্ছে সেগুলো নতুন কিছু নয় এই অর্থে যে এগুলো নিয়ে  দেশের ভেতরে গত কয়েক বছর ধরেই বলা হচ্ছিলো। যারা বলছিলেন তাঁদের কথা সরকার শোনেন নি, সরকার সমর্থকরা এই বক্তব্যগুলোকে ‘দেশ বিরোধী’ ‘উন্নয়ন বিরোধী’, এমন কি  ‘রাষ্ট্র বিরোধী’ বলেও অভিহিত করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক যে, যাদের এই প্রশ্নগুলো করা দরকার ছিল সেই অর্থনীতিবিদদের এক বড় অংশ এই প্রশ্নগুলো এড়িয়ে গেছেন।

আইএমএফের প্রাথমিক শর্তগুলোর মোদ্দা কথা হচ্ছে দুর্নীতি, বেহিসেবি ব্যয় এবং অবাধ লুন্ঠনের যে মহোৎসব চলেছে তা বন্ধ করতে হবে।  ঠিক এই ভাষায় আইএমএফ বলতে পারেনা, তাঁদের সেই এখতিয়ার নেই; ফলে তাঁদের ভাষায় এখন হিসেব চাওয়া হয়েছে জ্বালানী খাতে দেয়া ভর্তুকি কোথায়  কীভাবে ব্যয় হয়েছে, কোভিড মোকাবেলায় প্রণোদনার নামে যে টাকা দেয়া হয়েছে তার হিসেব কোথায়, আর মেগা প্রকল্পে ‘অতি-মুল্যায়ন’ — সহজ ভাষায় অতিরিক্ত ব্যয় কেনো হয়েছে। এগুলোতে স্বচ্ছতার কথাও বলা হয়েছে। এই সব শর্ত আলোচনার প্রথম ধাপেই এসেছে, সামনে আর কী কী তাতে যুক্ত হবে আমরা তা জানিনা। 

শর্তগুলোর যৌক্তিকতা আছে কীনা সেটা বিবেচনা করুন।  আইএম এফ-এর কাছে অর্থ নেয়ার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে কেনো সেটা ভাবুন। আর এটাও মনে রাখুন সরকার কেবল যে আইএমএফ আর বিশ্বব্যাংকের কাছেই টাকা চেয়েছে তা নয়, ইতিমধ্যেই বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদারদের কাছেও বাংলাদেশ অর্থ চেয়েছে। তার পরিমাণ তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি। গত বছরগুলোতেও বাংলাদেশ এই ধরণের ঋণ নিয়েছে।  অথচ বলা হয়েছে উন্নয়নের রেলগাড়ী বুলেট গতিতে এগুচ্ছে। 

একটি অস্বচ্ছ ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে এই সব ঋণ নেয়া হচ্ছে। এর জবাবদিহিতার ব্যবস্থা নেই। এমন কি সাজানো সংসদে এই নিয়ে কোনও ধরণের আলোচনা পর্যন্ত হচ্ছেনা। এইসব হচ্ছে এমন এক সময়ে যখন আমরা জানি যে ইতিমধ্যে যে ঋণ আছে সেগুলোর কারনে আগামী তিন বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দ্বিগুন হবে। এই সব অর্থ ফেরত দেয়ার দায় জনগণের। আগামীতে প্রতিটি পয়সা হিসেব করে ফেরত দিতে হবে। কিন্ত এই নিয়ে তাঁদের জানানোর পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা নেই। সংকটের মাত্রাটা বোঝা দরকার, সামনে কী ধরণের পরিস্থিতির সূচনা হতে পারে সেই বিষয়ে ভাবা দরকার।

ঋণ পাওয়া কঠিন হতে পারে : ড. রেজা কিবরিয়া

 বর্তমান সরকারের ব্যাপক দুর্নীতির কারণে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সব শর্ত পূরণ করে ঋণ পাওয়া বাংলাদেশের পক্ষে কঠিন বলে মন্তব্য করেছেন আইএমএফের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. রেজা কিবরিয়া।

“আইএমএফ যদি কোনো দেশকে অর্থ ঋণ দেয়, তবে তারা ঋণ ফেরত দিতে পারে কিনা তা পরীক্ষা করে। তাই, আইএমএফ দেশের রিজার্ভের হিসাব চায়, কারণ তার অর্থ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসে। তাই তারা যে কোনো দেশকেই সহজে ঋণ দিতে চায় না। বর্তমান সরকারের রিজার্ভ নিয়ে আইএমএফের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে”। রবিবার (৩১ জুলাই) গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র আয়োজিত এক আলোচনায় তিনি বলেন, প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত দেশের সংকট সমাধান হবে না।

 আইএমএফের সাবেক এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ দেশের সব সংকটের মূলে রয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি। তিনি আরও দাবি করেন, দেশে মূল্যস্ফীতির হার ১২ শতাংশের বেশি হলেও সরকার তা আড়াল করছে।  ড. রেজা কিবরিয়া উল্লেখ করেন যে সরকার নিজেই আশা করেনি যে এত তাড়াতাড়ি রিজার্ভ কমে যাবে এবং আইএমএফের কাছে ঋণ চাইতে হবে।

আইএমএফ থেকে টাকা নেওয়া খুব একটা ভালো জিনিস নয়, কারণ আইএমএফ তখনই ঋণ দিতে চায় যখন একটি দেশ মোটেও চলতে পারে না। সরকার এই অবস্থায় আছে কারণ বিকল্প নেই। বাংলাদেশ এখন বড়ো ধরণের অর্থনৈতিক সংকটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close