বাংলাদেশী কম্যুনিটি এবং বিলাতের রাজনীতিতে সম্পৃক্ততা (দ্বিতীয় পর্ব)
|| ইমরান চৌধুরী বিইএম ||
লেখক: গবেষক, ইতিহাসবিদ, পাবলিক স্পিকার
(পূর্ব প্রকাশনার পর……)
কন্সারভেটিভ পার্টির প্রণীত আইন ১৯৬২ সালের সবচে বেশী লাভবান আভিবাসী গোস্টীদের মাঝে পূর্ব পাকিস্থান (বর্তমান) বাংলাদেশিরা । সিলেট অঞ্চলে বিশ্বনাথ, জগন্নাথপুর, থেকে শুরু করে সেই গভীর হাওর অঞ্চলের মানুষজন এই আইনের সুফল
গ্রহণ করতে থাকে। সিলেট শহর বাদে সকল মহকুমাগুলো সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সিলেট সদর মহকুমা থেকে হাজার হাজার মানুষ আসতে শুরু করেন বিলাতে। তৎকালীন সময়ে শুধু পুরুষরাই আসতে থাকেন একাকী। লন্ডন, লুটন,
বার্মিংহাম, ম্যানচেষ্টার, ওল্ডহ্যাম, ব্রাডফোর্ড,শেফিল্ড, লিডস, লিভারপুলসহ সকল প্রধান প্রধান শহর, বন্দর, নগরীগুলোতে মেস বানিয়ে দেশ থেকে আসা অভিবাসীরা থাকতে থাকেন এবং বিভিন্ন মিল, ফ্যাক্টরি, ইটের ভাটা, হোটেল, রেস্টুরেন্ট এবং
গারমেন্ট ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করেন। অত্যন্ত মিতব্যায়ী জীবন যাপন করেন ওনারা।
বিলাত আসার ব্যাপারে অনেকেই ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন ; তাই প্রথম কর্তব্য ছিল ঋণ পরিশোধ করা এবং তারপর পরিবারের হাল ধরা। তাই ওনাদের পক্ষে বিলাসিতা বা প্রাচুর্য ছিল এক ধরনের দুঃস্বপ্ন এবং ঐ সকল নব্য আগমনকারী ব্যক্তিগন তাদের দেশে অবস্থিত ভাই, আত্মীয়,পাড়া প্রতিবেশীদের জন্য বিলাতের কর্মদাতাদের নিকট থেকে ‘’ভাউচার‘’ নিয়ে দেশে পাঠান। নিজস্ব লোকেরা যাতে বিলাতে এসে এই সুবর্ণ সুযোগটা গ্রহণ করে নিজেদেরকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারে । সিলেট শহরে পাকিস্তানী বৈষম্যকারী শোষক সরকার অনেক চাপের মুখে উপায়ান্তর না পেয়ে সিলেট শহরের শেখঘাট এলাকায় খুলতে বাধ্য হন আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস; কিন্তু ওরা আমাদের সিলেটের যুবক, কৃষক,ছাত্র, অফিস আদালতের কর্মচারীদের পর্যাপ্ত পরিমাণ পাসপোর্ট দিতে গড়িমসি এবং তালবাহানা করার ফলে কাজের ভাঊচার থাকা সত্ত্বেও অনেক সুযোগ্য লোকবল পাসপোর্ট না পাওয়াতে আসতে পারে নাই। সিলেট শহর রাতারাতি হয়ে উঠে একটি বিশাল ব্যস্ত বন্দর নগরীতে – রাত্রিযাপন করার জন্য গড়ে উঠে মাশরুমের মত হোটেল এবং আহারের জন্য রেস্টুরেন্ট।বাস,ফার্স্ট ক্লাস(ব্ল্যাক সিডান ট্যাক্সিকে এই নামেই ডাকতো),বেবিট্যাক্সি ভরপুর হয়ে যায় শহর। উন্নয়নের এক নব্য জোয়ার দেখা দেয়। সেই ঘুমন্ত- নীরব -অপূর্ব নৈসর্গিক নয়নাভিরাম জনপদ রূপান্তরিত হয় এক নগরীতে ।
সকল বৈষম্য এবংপাসপোর্ট প্রাপ্তির বাধা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে রক্ষণশীল(কন্সারভেটিভ) পার্টি দ্বারা আনীত আইনের আওতায় অনেকে অভিবাসনের ক্ষেত্রে সহজ সুযোগ গ্রহণ করে । ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত বৃটেন ছিল কন্সারভেটিভ পার্টির সবচেয়ে সুবর্ণ সময়। দেখা যায়, ঐ সময়ে যখন নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবার অভিপ্রায়ে বাঙ্গালীরা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা খুলতে অভিপ্রায় গ্রহণ করে। বৃটেন এর অধিকাংশ কাউন্টি, বর্যা কাউন্সিল, ডিসট্রিক্ট কাউন্সিল,প্যেরিস কাউন্সিল গুলোই কন্সারভেটিভ দল এর নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং ঐ সময়ে বাঙ্গালী অভিবাসীদের ব্যবসা খোলার সময় ওরা ঐ সব লোকাল গভমেণ্ট এর রাজনৈতিক নেতাদের নিকট থেকে অনেক সাহায্য পায়। কিংবদন্তি আছে এই বাঙ্গালী অভিবাসী আগমনের স্রোত চলতে থাকে ১৯৬২ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত।
সকলের মনে একই অভিপ্রায় কয়েক বছর একা একা থাকবো বিলাতে যখন গ্রামে কয়েক কিয়ার (বিঘা) বা কয়েক হাল (কয়েক একরে এক হাল) জমি কিনে ফেলতে পারবো, সিলেট বা মহকুমা শহরে একটা বাড়ী (যাহাকে বাসা নামে ডাকা হয়) এবং গ্রামে কয়েক বিঘা জমি নিয়ে প্রাসাদোপম অট্টালিকা বানানো হয়ে যাবে এবং পাকিস্তান ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক জিন্দাবাজার ব্রাঞ্চে কয়েক লক্ষ টাকা জমিয়ে ফেলতে পারবো তৎক্ষণাৎ ফিরে যাবো দেশে। বিদেশের সব ঝামেলা চুকিয়ে বিলাত থেকে যাত্রা করবো চিরতরে। দেশে নিজের জমিনের চাল, নতুন বাড়ীর পুকুরের মাছ ( গ্রামের বাসস্থান) আসবে সংলগ্ন নিজস্ব পুকুরে থেকে, আর ছেলেমেয়েদের জন্য নির্মিত বাসাতে (শহরে থাকার বাড়ী ) তে থাকবে ওরা। লেখাপড়া করবে।আর আভিবাসী ব্যক্তি টেট্রনএর লুঙ্গী পরে, প্রিন্টের সুতি সার্ট গায়ে দিয়ে, পায়ে পামশু’ পরে পান সুপারি, চুন – খয়ের আর সাথে হাকিমপুরী জর্দা দিয়ে এক খিলি পান চিবাবে আর মনের সুখে টেপ রেকর্ডারে ‘’ হাসন রাজার ‘’ গান শুনবে-’’ পরের জা’গা, পরের জমি- ঘর বানাইয়া আমি রই, আমি তো সে’ঘরের মালিক নই‘’।
কিন্তু, নিয়তি মনে হয় তখন একটা বঙ্কিম হাসি হেসেছিল তাদের অগোচরে মনের অজ্যান্তে। চলবে…