অন্তর্বর্তীকালীন নয় বিপ্লবী সরকার চান প্রবাসীরা
- সামরিক ক্যু’র চেষ্টা।
- জুডিশিয়াল ক্যু’র চেষ্টা।
- সিভিল ক্যু’র চেষ্টা।
মিনহাজুল আলম মামুন, লণ্ডন, ২১ আগস্ট- অজস্র ছাত্র-জনতার আত্মাহুতি ও রক্ত ঢেলে দেয়ার মধ্য দিয়ে স্বৈরাচার, ঘাতক, প্রতারক ও ফ্যাসিস্ট জালেম হাসিনাশাহীর পতন ঘটেছে। আগষ্টের ৫ তারিখে মানুষ নতুন এক বাংলাদেশ পেয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয়েছে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে পরাজিত হয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ তার পুরো ক্যাবিনেট পালিয়েছে। মানুষের মতামত ও সমর্থনের বিষয়টি আবারো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। শাসন ও রাজনীতি করতে গেলে এখন জনমতকে গুরুত্ব দিতে হবে। অস্ত্রের ভাষায় জনমতকে দমিয়ে দিয়ে দেশশাসন ও রাজনীতি করার ধারা হাসিনা রেজিমের পতনের সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। দীর্ঘ পনেরো বছর যাবৎ জগদ্দল পাথরের ন্যায় জনগণের কাঁধে চেপে বসে থাকা নিকৃষ্ট স্বৈরাচার অবশেষে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে গেছে।
তবে এই ত্যাগ ও রক্তের পথ মারিয়ে অর্জিত বিপ্লবকে ব্যর্থ করে দিতে ফ্যাসিবাদের ক্রীড়নকরা আজও সক্রিয় রয়েছে। ফ্যাসিবাদের সাজানো প্রশাসন, বিচার বিভাগে বসানো দলদাসরা এখনো নিজ নিজ আসনে রয়েছে। মিডিয়ায় ফ্যাসিবাদের সহযোগি গুম, খুনে উস্কানিদাতারা এখনো নিজ নিজ জায়গায় বহাল তবিয়তে। এখনো পতিত স্বৈরাচারের দোসরেরা রাষ্ট্রীয় সব প্রতিষ্ঠানে শেকড় গেড়ে বসে আছে। স্বৈরশাসকের সুবিধাভোগীরা ছড়িয়ে আছে সবখানে। এরাও জনতার সঙ্গে মিশে নানান অঘটন ঘটাচ্ছে, অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করছে, উস্কানি দিচ্ছে।
ইতোমধ্যে তিনটি ক্যু’র প্রচেষ্টা ঠেকানো গেছে। সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসারকে দিয়ে সামরিক ক্যু করানোর চেষ্টা ঠেকানো গেছে। ভারতের ইন্ধনে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে জুডিশিয়াল ক্যু’র চেষ্টা ছাত্র-জনতা এবং আইনজীবীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ-সুনামিতে নস্যাৎ হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় ক্যু-এর চেষ্টা নস্যাৎ হওয়ার পর সিভিল ক্যু’র একটি চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে গেছে।
ছাত্র জনতার গণঅভ্যূত্থানে দেশ থেকে পালানো শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার মন্ত্রী-এমপিদের বেশির ভাগই বিদেশে পালিয়েছেন। যারা রয়ে গেছেন তাদের অনেকেই ধরা পড়ছেন। তবে হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসররা প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়ে গেছেন। সচিব থেকে শুরু করে বিসিএস ক্যাডার এবং পুলিশ, র্যা ব, সেনাবাহিনী, এমনকি অধিদপ্তর পরিদপ্তরে কর্মরতদের বেশির ভাগই শেখ হাসিনার নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় চাকরি করছেন। বিশেষ করে প্রশাসনের নিম্নপদে নিয়োগকৃতদের বেশির ভাগই ছাত্রলীগ, যুবলীগ, মহিলা লীগ থেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। হাসিনা পালালোও তারা এখনো বর্তমান সরকারের আমলে চাকির করছেন। এরা সুকৌশলে দিল্লির আঁকানো ছকে নতুন সরকাকে বিপদে ফেলতে নানান দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। হাসিনা পালালেও তার অনুসারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজধানী ঢাকাকে বিক্ষোভ-সমাবেশ-মানববন্ধনের শহরে পরিণত করেছেন। প্রতিদিনই রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় লেগেই রয়েছে দাবি আদায়ের আন্দোলন। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন থেকে শুরু করে সচিবালয়, জাতীয় প্রেস ক্লাব, শাহবাগ গুরুত্বপূর্ণ সব এলাকায় চলছে দাবি আদায়ের আন্দোলন। এমনকি বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভিতরেও বিক্ষোভ করা হচ্ছে। কোনো সরকারের শাসনামলে সচিবালয়ে আন্দোলন নজীরবিহীন। পতিত হাসিনার আমলেও সচিবালয়ের আশপাশে কোনও বিক্ষোভ, সমাবেশ কিংবা মানববন্ধনের অনুমতি ছিল না। এখন সচিবালয় এলাকা পরিণত হয়েছে দাবি আদায়ের প্রধানতম স্থানে। এরা পতিত হাসিনা সরকারের সময় সরকারের পক্ষ্যে থেকে ছাত্রদের কোটা বিরোধী আন্দোলন মোকাবিলা করেছেন। এমনকি অনেকেই ছাত্রলীগ, যুবলীগের সঙ্গে মিলে শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমন করেছেন। তারাই এখন সরকারকে ব্যাতিব্যক্ত করতে দিল্লির প্রেসক্রিপশনে দাবি আদায়ের নামে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন না করে একটা বিপ্লবী সরকার গঠিত হলে এত এত ক্যু এর ঘটনা ঘটতোনা। ষড়যন্ত্রকারীরা কোন সুযোগই পেতোনা। তারা বলছেন, গত ১৭ বছরে স্বৈরাচারী শাসনের নিষ্পেষণে দেশের মানুষ যখন দমবন্ধ অবস্থায় ছিল তখন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে মনে হয়েছে আমরা মুক্তি পেলাম। এই ভয়াবহ স্বৈরাচারী শাসন নিপীড়ন, গুম, খুন যেমন একদিকে জনগণকে নিষ্পেষিত করেছে অন্যদিকে সীমাহীন দুর্নীতি, লুটতরাজ, চুরি, অর্থপাচার দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে একেবারে দুর্বল করে দিয়েছে। বিধ্বস্ত এই অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণ করায় তার সামনে একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ রয়েছে। জনগণেরও আশা-আকাক্সক্ষা তাকে ঘিরে অনেক বেশি। বাংলাদেশের মানুষের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে রয়েছে বৈষম্যহীন দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ। যেখানে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যেখানে থাকবে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগ। যেখানে মানুষ মন খুলে কথা বলতে পারবে। এই অবস্থায় যে সরকার গঠিত হলো তার ন্যাচার কী হবে। এই সরকার কি নিরপেক্ষ হবে, নাকি যারা বিপ্লব সাধিত করেছে তাদের ইচ্ছায়, তাদের অংশগ্রহণে এই সরকার পরিচালিত হবে। এটিই এই মুহূর্তে বড় প্রশ্ন। এই উত্তর না পাওয়ায় প্রতিবিপ্লবের সম্ভাবনা, ষড়যন্ত্র দেখা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গণঅভ্যূত্থান বিপ্লব নয়। তবে, রাজনৈতিক প্রকৌশলের মাধ্যমে একটি গণঅভ্যূত্থানকে বিপ্লবে রূপান্তরিত করা সম্ভব একটি সময়ের মধ্যে, যা পার হয়ে গেলে সম্ভব নাও হতে পারে। বাংলাদেশে সংঘটিত গণ-অভ্যূত্থানটিকে বিপ্লবে রূপান্তরিত করার সুযোগ এখনও আছে। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন নয়, বিপ্লবী সরকার চাইছেন প্রবাসীরা। অবশ্য দেশ পরিচালনায় ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কেউ কেউ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয় বরং বিপ্লবী সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এ প্রসঙ্গে তৃতীয় বাংলা খ্যাত বিলেতে বাংলা ভাষার প্রধান কবি আহমেদ ময়েজ বলেন, ‘এ সরকারের নামকরণ হওয়া উচিত ছিলো বিপ্লবী সরকার। বিপ্লবী সরকারের কোনো সংবিধানের প্রয়োজন হয় না। এটাও ঠিক প্রচলিত সংবিধান এ সরকারকে কোনো বৈধতাও দেয় না। কী করে দেবে? এ সংবিধান মানলে তো তাদের ফাঁসি দিতে হবে। কারণ, সংবিধান বিপ্লবীদের জন্যয় কোনো স্থান রাখেনি। সংবিধান তাদের নাম দিয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহী। কিন্তু বিপ্লব যারা করেন তাঁরা নতুন গঠনতন্ত্র রচনা করেন। পুরানোকে ভেঙেই তাদের আবির্ভাব হয়। এর জন্যক বর্তমান যে সরকারটি গঠিত হলো তাঁর মধ্যে সেই বিপ্লবী আচরণ দেখতে পাচ্ছি না। শ্রেণীগতভাবেও তাঁর জিনের মধ্যে সে উপাত্যু নেই। এখন সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে’।
নির্বাসিত সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল বলেন, ‘এর আগে ৪টি অভ্যুত্থান দেখেছি। ২০২৪ সালে যেটা হয়েছে, এটি আসলেই একটি গণবিপ্লব যেটি ছাত্রদের নেতৃত্বে হয়েছে। এখন বিপ্লব উত্তর বাংলাদেশের আন্তর্বতীকালীন সরকারকে বিপ্লবী কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। দূর্নীতিবাজ ও রাজনৈতিক দানব এবং ফ্যাসিস্টদের মূল উপড়ে ফেলতে হবে। সমাজের সর্বস্থরে নায্যতা, সাম্য ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সিষ্টেম চালু করে যেতে হবে। এখন আন্তর্বতীকালীন সরকার পরিচালনায় যারা আছেন তারা বুঝলেই হল। তবে মনে হচ্ছে আমরা ভালোর দিকেই যাচ্ছি’।
বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়ে রাষ্ট্রচিন্তক মাহমুদুল হক বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনও জটিল রয়ে গেছে, কারণ বিদ্যমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়েছে, যদিও সংবিধানে কোনো তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিধান নেই। এই অসামঞ্জস্যটি গভীর এবং মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। বাংলাদেশের সংবিধানে কোনো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিধান না থাকা এবং বিদ্যমান অসামঞ্জস্যকে বিবেচনায় রেখে, প্রস্তাব করা হয়েছে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদ্যমান সংবিধান বিলুপ্ত করবে। এই বিলুপ্তি একটি বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার পথকে সুগম করবে, যা জনগণের এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা বিপ্লবী শক্তির প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিনিধিত্ব করবে। এছাড়াও, রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করা জরুরি, যাতে নতুন শাসন কাঠামোতে সহজ পরিবর্তন আনা যায়। একটি বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে। এই সরকার জনগণের প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষাকে অগ্রাধিকার দেবে এবং একটি অধিক সমান এবং ন্যায়সংগত সমাজ গড়ে তুলতে কাজ করবে। এই নতুন বিপ্লবী সরকারের প্রধান লক্ষ্য হবে- একটি সাংবিধানিক সংস্কার পরিষদ গঠন, নতুন সংবিধান অনুমোদনের জন্য গণভোট এবং নতুন সংবিধানের অধীনে সাধারণ নির্বাচন’।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার নাজির আহমেদ বলেন, ‘গত ১৬ বছরে পতিত স্বৈরশাসক সংবিধানকে নিজে ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে ও চূড়ান্ত কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠতে কাটাছেঁড়া করে এমন একটি পর্যায়ে নিয়ে এসেছিল যে একজন নাগরিক চাইলেও সংবিধানটি সঠিকভাবে অনুসরণ করে চলতে পারবেন না সেটা না ভেঙে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও দায়িত্ব নিয়ে পড়েছেন বেশ ঝামেলায়। তাঁরাও দৃশ্যত: সংবিধানের কিছু অংশ মানছেন বা মানতে পারছেন আবার অন্য অংশ কিংবা বহু অংশ মানছেন না বা মানতে পারছেন না। সঙ্গত: কারণে প্রশ্ন উঠছে স্বৈরশাসকের পতনের পর তাদের স্বার্থে কাটাছেঁড়া করে রেখে যাওয়া সংবিধান ও সেটিং থাকে কিভাবে? কেনই বা থাকবে? কেনই বা মানতে হবে? স্বৈরশাসকের নিয়োগ দেয়া প্রেসিডেন্টকেও মানতে হবে বা রাখতে হবে কেন? মনে করিয়ে দেয়া দরকার চরম কর্তৃত্বপরায়ণ স্বৈরশাসনের প্রধান ব্যক্তির একক ইচ্ছায় প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হওয়া ব্যক্তি তো বটেই, নিয়োগের একদিন আগেও দেশের কেউ জানতো না কে প্রেসিডেন্ট হবেন। তাছাড়া প্রেসিডেন্টকে যে সংসদ নির্বাচিতে করেছিল সে সংসদ কিভাবে গঠিত হয়েছে তা জাতির জানা। জাতির প্রকৃত কোনো মেন্ডেট ছিল না সে সংসদে। এখন প্রশ্ন উঠেছে যে, সংসদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তার অবস্থানটা কতোটা বৈধ তাও স্পষ্ট নয়। যেহেতু সংসদ ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েছে। একটা “ill motive & mala fide intention” থেকে প্রেসিডেন্ট পদে উনাকে বসানো হয়েছিল, যেমনটি করা হয়েছিল প্রধান বিচারপতিকে কেন্দ্র করে। আরো একটু সময় পেলেই সদ্য পদত্যাগ করা প্রধান বিচারপতি তো সফল গণঅভ্যূত্থানকে প্রায় নস্যাত করেই ফেলছিলেন’।
তিনি আরও বলেন, ‘সফল গণঅভ্যূত্থানের পর গণঅভ্যূত্থান থেকে অনুসৃত ক্ষমতা বা প্রাপ্ত মেন্ডেটই হয় নতুন সরকারের ক্ষমতার বা চলার পথের ভিত্তি। সফল গণঅভ্যূত্থানের মাধ্যমেই রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গঠিত হয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সেই প্রতিষ্ঠিত থিউরি “social contract” (সামাজিক চুক্তি)। তাই গণঅভ্যূত্থান থেকে জন্ম নেয়া নতুন সরকারকে তাদের বৈধতার জন্য অন্য দিকে তাকাতে হয় না। গণঅভ্যূত্থানের পর সাধারণত গঠিত হয় ‘বিপ্লবী সরকার’। কিন্তু প্রফেসর ড. ইউনূস ও তার টিম গঠন করলেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তারপরও তারা সংবিধানের কিছু অংশ মানছেন আবার কিছু অংশ মানছেন না বা মানতে পারবেন না। কিছু অংশ মানতে গিয়েও তালগোল পাকানো হচ্ছে। এতে বিপদে পড়ার আশঙ্কা আছে বা দিন দিন তা বাড়ছে। এভাবে করতে থাকলে অনেক সমস্যায় তারা পড়তে পারেন বা পড়ে থাকবেন। ইতিহাসে বিপ্লব হবার পর প্রতিবিপ্লব, কাউন্টার বিপ্লব বা ক্যু হবার পর কাউন্টার ক্যু বা অভ্যূত্থানের পর পাল্টা অভ্যূত্থান ইতিহাসে অজানা নয়। বাংলাদেশেও অতীতে হয়েছে। বিশ্বে তো বহু উদাহরণ আছে। সফল গণঅভ্যূত্থানে স্বৈরশাসনের যেহেতু পতন হয়েছে এবং সংবিধানে যেহেতু তাদের ক্ষমতা নেয়ার বিধান নেই কাজেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিৎ ছিল প্রেসিডেন্টকে চাপ দিয়ে পদত্যাগ করানো এবং এরপর একটি শক্তিশালী “বিপ্লবী সরকার” গঠন করা। গণঅভ্যূত্থান থেকে অনুসৃত মেন্ডেট দিয়ে ঝড়ের বেগে দেশ ও সরকার চালাতে পারতেন এবং সংবিধানসহ সবকিছু সংস্কার ও রিপেয়ার করতে পারতেন। পদচ্যুত হওয়া সরকারের কোনকিছুর মুখাপেক্ষি হওয়া লাগতো না। যেমনটা সামরিক শাসন জারির পর সংবিধান নয় বরং সামরিক আইনের বিধিমালা দিয়ে দেশ শাসন করা হয়।
“বিপ্লবী সরকার” গঠন না করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করলেও তাদের মেন্ডেটকৃত সংস্কার করে দুটি উপায়ে বৈধতা নিশ্চিত করে ক্ষমতা ছাড়তে পারেন। প্রথমত: একটি গণভোট দিয়ে তাদের করা সংস্কারের ও ক্ষমতায় থাকার বৈধতা নিতে পারেন। দ্বিতীয়ত: তারা যদি নতুন সংবিধান রচনায় হাত দেন অথবা বর্তমান সংবিধানের বেশিরভাগ বা মূল বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে সংস্কার করে প্রায় নতুন সংবিধান রচনায় অগ্রসর হন তাহলে একটি Constituent Assembly গঠন করবেন শুধুমাত্র তাদের আমূল পরিবর্তন বা সংস্কারকৃত সংবিধানের অনুমোদনের জন্য। এর সাথে সাথে চাইলে একসাথে গণভোটেরও ব্যবস্থা করতে পারেন। কিন্তু “বিপ্লবী সরকার” গঠন না করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে যেভাবে এগুচ্ছেন সেভাবে এগুতে থাকলে প্রতি পদে পদে বাঁধার পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে। কোন সময় বাঁধা এমনভাবে আসতে পারে যে তা হয়তো ডিঙ্গানো সম্ভব নাও হতে পারে’।
এদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিপ্লবী সরকার আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘বর্তমান সরকার রক্তাক্ত মঞ্চ থেকে তৈরি হয়েছে। শত শত মানুষ জীবন দিয়েছে। এই সরকার, এই বিপ্লব ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে। তাই বর্তমান সরকারকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। একটা প্রচণ্ড রক্তাক্ত মঞ্চ থেকে এই সরকার (অন্তর্বর্তী) তৈরি হয়েছে। সেই মঞ্চ ও আপামর জনগণের কিছু দাবি ছিল। গত ১৫-১৬ বছর ধরে এই দাবিগুলো উত্থাপিত হয়েছে। সেই দাবি থেকেই এই সরকারের কর্মকাণ্ডগুলো প্রায়োরিটি পাবে। যারা এই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন তাদের স্বীকৃতি সবার আগে দিতে হবে। এটা অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। যারা আহত হয়েছেন রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের চিকিৎসা দিতে হবে। এটাও হচ্ছে না। আহতদেরও স্বীকৃতি দিতে হবে। এটা না করলে এই বিপ্লবের সত্যিকার ইতিহাস তৈরি হবে না। একটা ফ্যাসিবাদের প্রেক্ষাপটে শত শত মানুষ জীবন দিয়েছে। এই ফ্যাসিবাদের মূল উৎপাটন করতে হবে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা কাঠামো ঠিক না করলে এই ফ্যাসিবাদ আবার ফিরে আসবে। আমরা আর রক্ত দিতে চাই না। এই সরকার, এই বিপ্লব ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যর্থ হবে। এই সরকারের কাছে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার না করলে স্বচ্ছ, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। একটা জবাবদিহিমূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে না। পুলিশ প্রসাশন, জনপ্রশাসন, বিচার বিভাগ এবং সরকারি স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সকল প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে। এই সরকারের ইমিডিয়েট কাজ হচ্ছে, সংবিধানের ষষ্ঠদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীকে বাতিল ঘোষণা করা। এটি বাতিল ঘোষণা করলে আমরা মোটামুটি সহ অবস্থায় ফিরতে পারবো। এটা নামে অন্তর্বর্তী সরকার বললেও এর ক্যারেক্টার হচ্ছে বিপ্লবী সরকারের মতো। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে তাদের সংশ্লিষ্টতা না থাকলে ওই বিপ্লবের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারকে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ করা। সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ না করলে তা ধীরে ধীরে কচ্ছপের মতো মাথা বের করবে, আবার লুকাবে, আবার মাথা বের করবে। তাই এই জাতিকে যদি আমরা নিরাপদ রাখতে চাই তাহলে স্বাধীনতা বিরোধী, ফ্যাসিবাদী শক্তিকে কোনোক্রমেই অধিকার দেয়া যাবে না। আমাদের জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন’।