নিউজবাংলাদেশ

১৫ আগস্ট জাতীয় নাজাত দিবস পালিত

  • হাসিনা ও জয়ের শোক দিবস পালনের আহ্বান ছাত্র-জনতার প্রত্যাখান।
  • ১৫ আগস্ট  সাধারণ ছুটি বাতিল।
  • ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে রোকেয়া প্রাচীর ওপর হামলা।
  • কাদের সিদ্দিকীর গাড়ি ভাঙচুর।

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।

লণ্ডন, ১৫ আগস্ট- ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ হাসিনার বাবা ও তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত দেশের মানুষ দিনটিকে জাতীয় নাজাত (মুক্তি) দিবস হিসেবেই পালন করেছেন।

১৯৯৬ সালের ১৫ আগস্ট দিনটি প্রথম জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালিত হয়। এর আগে আওয়ামী লীগের একটা অংশ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় দিবসটি পালন করতো। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ১৫ আগস্টকে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন শুরু হয়। পাশাপাশি ১৫ আগস্ট সরকারি ছুটিও ঘোষণা করা হয়। এছাড়া পতাকা বিধি সংশোধন করে ১৫ আগস্ট জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়। তবে ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালে মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও সাধারণ ছুটি বাতিল করা হয়। এছাড়া জাতীয় পতাকা বিধি আবারও সংশোধন ১৫ আগস্ট অর্ধনমিত রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এর ফলে ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে দিবসটি পালিত হয়ে আসছিলো।

১৩ আগস্ট মঙ্গলবার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ১৫ আগস্টের ছুটি বাতিল করা হয়। সরকারি ছুটি বাতিলের বিষয়ে বুধবার ১৪ আগস্ট সরকারের তথ্য বিবরণীতে বলা হয়—  ‘উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঘোষিত ১৫ আগস্টের সাধারণ ছুটি বাতিল করার বিষয়ে ঐকমত্য হওয়ায়, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্তক্রমে সরকার জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ঘোষিত ১৫ আগষ্টের সাধারণ ছুটি বাতিল করেছে।’

১৫ আগস্ট অন্যান্য বছর রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বিশেষ বাণী প্রদান করলেও এবার রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রধান উপদেষ্টার কোনও বাণী পাওয়া যায়নি। সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসস থেকেও এ সংক্রান্ত কোনও সংবাদ রিলিজ করা হয়নি। শোক দিবসে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনও কর্মসূচি পালিত হওয়ার খবর পাওয়া জানা যায়নি। বঙ্গভবন সূত্রে শোক দিবসে রাষ্ট্রপতির কোনও কর্মসূচি পাওয়া যায়নি। সরকারের পক্ষ থেকেও কোনও কর্মসূচির কথা জানা যায়নি।

গত ১৫ বছরের আওয়ামী স্বৈরশাসনে শেখ হাসিনা তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানকে আলাদা উচ্চতা দিতে গিয়ে অন্যদের ক্রমাগত ছোট করে গেছেন। শেখ হাসিনা তার বাবাকে বড় করতে গিয়ে ইতিহাস বিকৃত করেছেন। দেশের সব বড় মানুষদের তিনি ছোট করেছেন। স্বাধীনতার জন্য দেশের মানুষের সীমাহীন ত্যাগ ও অবদানকে অস্বীকার করেছেন। মিথ্যা ইতিহাস রচনাকারীদের তিনি পুরস্কৃত করেছেন। পাঠ্যপুস্তকে তিনি শিক্ষার্থীদের মিথ্যাপাঠ নিতে বাধ্য করেছেন। গত পনের বছর ধরে শেখ হাসিনা তার মৃত পিতাকে টোটেম হিসাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার সকল ব্যবস্থা করেছেন, খরচ করেছেন জনগণের ট্যাক্সের হাজার হাজার কোটি টাকা, আদালত থেকে বাগিয়েছেন “জাতির পিতা” হিসাবে রায়, আইন করেছেন তাকে সমালোচনার উর্ধ্বে রাখার। এসব করতে গিয়ে তিনি দানব ফ্যাসিস্ট বনে গেছেন। মুজিবায়ন এবং টোটেম সংস্কৃতিকে সর্বত্র দৃশ্যমান করতে শিল্পকলার নাম দিয়ে সারা দেশে স্থাপন করেছেন মুজিবের শত শত মুর্তি, প্রতিষ্ঠা করেছেন মুজিব কর্ণার, বানিয়েছেন হাজার হাজার মুরাল। তিনি মুজিব নামের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন শত শত স্থাপনায়! কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গণহত্যা করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের মানুষ জাতীয় শোক দিবস প্রত্যাখ্যান করে আবারও দিনটিকে জাতীয় নাজাত (মুক্তি) দিবস হিসেবেই পালন করেছেন। 

শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শোক দিবস পালনের জন্য আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের আহ্বান জানিয়েছিলেন দলটির প্রধান শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়। অন্যদিকে শেখ হাসিনা ও তার দলকে রুখে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাঁরা শেখ হাসিনার ‘স্বজন হারানোর ব্যথা আমিও বুঝি’ মার্কা গল্প নিয়ে ট্রল করছিলো। শুধু তাই না, তারা ১৫ই আগস্ট ঘিরে আওয়ামী লীগের অপতৎপরতা প্রতিহত করতে রেজিস্ট্যান্স উইক পালন শুরু করেছিলো। ১৫ আগস্টে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়ক ও আশেপাশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের পাশাপাশি জোরদার ও সতর্ক অবস্থান নিয়ে ছিলো হাজার হাজার মানুষ। তাদের প্রায় সবার হাতে ছিলো লাঠি, পাইপ। মাথায় ছিলো জাতীয় পতাকা বাধা। কাউকে সন্দেহ হলেই জেরা করা হচ্ছিলো, তল্লাশি করা হচ্ছিলো সামাজিক মাধ্যমের অ্যাপ। আওয়ামী লীগের সাথে সংশ্লিষ্টতা বা ১৫ই আগস্ট নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে কোনো কর্মকাণ্ড পাওয়া গেছে, এমন কিছু মানুষকে রাস্তার বিপরীত পাশে অবস্থিত নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের উত্তম-মধ্যম দিয়ে পরে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সকাল থেকে ঘুরে-ফিরে এই দৃশ্যেরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল মিরপুর রোডসহ লাগোয়া অন্যান্য সড়ক ও গলিতে।

সাধারণ মানুষ দূরের কথা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও হাসিনা ও তার পুত্র জয়ের ডাকে সাড়া দেয়নি। বরং ১৫ আগস্ট বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন ও সাংস্কৃতির সংগঠন গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে। শেখ হাসিনাকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ধরে এনে বিচারের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ-মানববন্ধন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্র্মী ও সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের বিপদে ফেলে পালিয়ে দিল্লি যাওয়ায় শেখ হাসিনাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে অভিহিত করেছে। মূলত দিল্লির পুতুল বাংলাদেশে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত শেখ হাসিনাকে ‘লালকার্ড’ দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারাই। দু-চারজন ‘মুজিব প্রেমী’ আহম্মকী করে ৩২ নম্বরে যাওয়ার চেষ্টা করে ‘রশি থেরাপি’ খেয়েছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মী ও আমজনতা তাদের ধরে উত্তম-মাধ্যম দিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যায় কয়েকজনকে হাতে রশি বেঁধে রাখা হয়েছে। দুইজনকে গণপিটুনি দেয়া হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে ৩২ নম্বর তো বটেই আশেপাশের এলাকাও ব্যানার ফেস্টুনে ছেয়ে যেতো। দূর-দূরান্ত থেকে ভেসে আসতো শেখ মুজিবুর রহমানের রেকর্ডকৃত ভাষণ। কিন্তু, এই ১৫ অগাস্টে একটি ব্যানারেরও দেখা মেলেনি পুরো এলাকায়। আশেপাশের কোন এলাকায় এই দিনটি ঘিরে কর্মসূচি বা অনুষ্ঠানের কথাও শোনা যায়নি। ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন যেটিকে ‘বঙ্গবন্ধু জাদুঘর’ বানানো হয়েছিল, তার ঠিক সামনের সড়কটি দুই প্রান্ত থেকে ব্যারিকেড ও কাঁটাতার দিয়ে একরকম অবরুদ্ধ অবস্থায় রাখা হয়েছিলো। ভেতরে অবস্থান করছিলেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া, ৩২ নম্বরের আশেপাশের সড়কে সেনাবাহিনী ও বিজিবির পাশাপাশি স্বল্প সংখ্যক পুলিশ সদস্যের উপস্থিতিও চোখে পড়ে। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ শ্রদ্ধা জানাতে যেতে চাইলে অবস্থানকারীদের তোপের মুখে পড়তে হয় তাদের। ৩২ নম্বর সড়ক সংলগ্ন সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাক-বিতন্ডার কোনো এক পর্যায়ে কয়েকজনকে লাঠি-সোটা নিয়ে ধাওয়া দেওয়া বা মারধোর করা হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ আক্রান্তদের বাঁচানোর চেষ্টাও করেন।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে রোকেয়া প্রাচীর ওপর হামলা

রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীসহ কয়েকজনের ওপর হামলা হয়েছে। সেখানে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে তারা মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করতে গিয়েছিলেন।

বুধবার (১৪ আগস্ট) কর্মসূচি শেষে ফেরার সময়  সোয়া সাতটার দিকে এ হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি শেষ হওয়ার মুহূর্তে কয়েকজন ব্যক্তি লাঠিসোঁটা হাতে রোকেয়া প্রাচীসহ অন্যদের ওপর হামলা চালান। আহত অবস্থায় রোকেয়া প্রাচীকে সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেখানে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক সদস্য বলেন, মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি শেষ করে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে বের হওয়ার সময় কিছু ব্যক্তি রোকেয়া প্রাচীসহ অন্যদের ধাওয়া দেন। তখন তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে যান। এ সময় কয়েকজনের ওপর হামলা হয়েছে।

এর আগে দুপুরের দিকে ফেসবুকে এই অভিনেত্রী ১৫ আগস্টের শোক দিবস উপলক্ষে সেখানে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আছি ধানমন্ডি ৩২। হোক সব হত্যার, সব নৈরাজ্যের বিচার। বিচার হোক বাঙালির ইতিহাস হত্যার। আছি। আমরাও বিচার চাই। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে স্মরণ করব স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস। আছি পুড়ে যাওয়া ৩২-এ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।’

ফেসবুক পোস্টের ঘোষণা অনুযায়ী পরে তিনি নিজে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থান নেন। সন্ধ্যার দিকে মোমবাতি প্রজ্বালনের সময় ৩০–৩৫ জন মানুষ তার সঙ্গে অংশ নেন।

কাদের সিদ্দিকীর গাড়ি ভাঙচুর

ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। এসময় তার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে এই ঘটনা ঘটে।

এই বিষয়ে কাদের সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে বলেন, সেখানে অনেক উত্তেজিত লোকজন দেখলাম, ছাত্রদের দেখলাম। আমাকে বলেছে আপনি চলে যান, আমি চলে এসেছি। আমার গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা কিন্তু সুন্দর আচরণ করেছে।

তবে উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করে কাদের সিদ্দিকী বলেন, যখন কোনো অন্যায় কাজ বেশি হয়, তখন দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়। ছাত্ররা যে বিজয় অর্জন করেছে সেটি ঐতিহাসিক বিজয়। এটাকে ধরে রাখতে হলে সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে।

এসময় দ্রুত পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আমি এতবছর যাবৎ আওয়ামী লীগের দ্বারা নির্যাতিত, তারপরও এই আন্দোলনকারীরা যদি আমাকে তাদের শত্রু ভাবে তাহলে এটা তো আমার জন্যও দুর্ভাগ্যজনক। তারপরও বলবো, দেশের মানুষের যদি স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়, জান, মাল, নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় সেটিও আমার জন্য গৌরবের।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close