আগস্ট বিপ্লবের ১০ প্রবাসী সিপাহশালার
মিনহাজুল আলম মামুন, লণ্ডন, যুক্তরাজ্য- বাংলাদেশের অবৈধ ও অনৈতিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের জুলুম, গুম, খুন ও ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্য দিয়ে জাতির জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল। ফ্যাসিস্ট সরকারের দুঃশাসনে সারা বাংলাদেশ কারাগারে পরিণত হয়েছিল। মানুষের ভোটাধিকার ও বাক্স্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থ পাচার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা, ঋণের নামে ব্যাংক লুটের সুযোগ দেওয়া, আয়বৈষম্য চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, খেলাপি ঋণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়া, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাওয় এবং দেশকে স্বজনতোষী পুঁজিবাদের কবলে ফেলা হয়েছিলো। দেশের মানুষের এসব সমস্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হলে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের মন্ত্রীরা ‘দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে’ বলে উপহাস করছিলো। ফলে সমাজের সব শ্রেণি ও পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েই ছিল। সেটার বহিঃপ্রকাশ ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা।
১৫ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের দিন ছাত্রলীগকে নামিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। ওই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের জবাব ছাত্রলীগই দেবে। তারা প্রস্তুত’। এরপরই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালায়। দফায় দফায় ছাত্রীদেরও ধরে ধরে পেটানো হয়। গুলি করা হয় শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে। ১৭ জুলাই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে খুন করে পুলিশ। সেই ভিডিও চিত্রই কাজ করেছে বারুদে একটি দেশলাইয়ের কাঠির মতো। এরপর দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। স্লোগান দেওয়া হয় এই বলে যে ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি, গুলি কর।’
সত্যিই গুলি করা হবে, তা হয়তো ভাবতে পারেননি বিক্ষোভকারীরা। সাধারণ মানুষও ভাবতে পারেননি, কয়েক দিনেই ২০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলা হবে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেননি, ঘরের মধ্যে থাকা শিশু, ছাদে থাকা কিশোরী, বারান্দায় থাকা মানুষ গুলিতে নিহত হবেন। যদিও ১৯ জুলাই কারফিউ জারি করার বিষয়টি জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, ‘শুট অন সাইট’ বা দেখামাত্র গুলির নির্দেশ জারি করা হয়েছে।
ফলে বাংলাদেশে যা কখনো হয়নি, তা-ই হলো; বিপুল সংখ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো, কলেজ শিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো, স্কুল শিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো। মায়েরা কাঁদলেন, বাবারা কাঁদলেন, সহপাঠীরা কাঁদলেন। ক্ষোভে ফুঁসে উঠল দেশ। একে একে শিক্ষক, অভিভাবক, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও প্রবাসীরা সমর্থন জানাতে শুরু করলেন শিক্ষার্থী ও তরুণদের আন্দোলনে।
শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কেরা ৯ দফা দাবি জানিয়েছিলেন। সেই দাবি পূরণের বদলে বেছে নেওয়া হয় নির্যাতন ও গণগ্রেপ্তারের পুরোনো পথ, যা শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ১৫ বছর ধরে প্রয়োগ করে আসছিলেন। কয়েক দিনের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাদ যায়নি এইচএসসি পরীক্ষার্থীরাও।
২ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ৯ দফা দাবিকে এক দফায় রূপান্তর করা হয়। বলা হয়, সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে। ৪ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ বা ঢাকামুখী গণযাত্রার ডাক দেওয়া হয়। ঘোষিত তারিখ একদিন এগিয়ে এনে ‘৩৬ জুলাই’ নির্ধারণ করা হয় ‘মার্চ টু গণভবন’, দুপুর দুটোয়। শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দলে দলে রাস্তায় নামেন। যে নাগরিকেরা এতদিন নানা বৃত্তে বিভক্ত ছিলেন, তাঁরাও একত্র হয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ান। আন্দোলনটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। এক যুবা বিপ্লবী স্মিত হেসে স্পষ্ট উচ্চারণে শুনিয়ে দেয় ‘পেছনে পুলিশ, সামনে স্বাধীনতা’। গণঅভ্যুত্থান আর ‘পেছনে হটেনি’। ‘গণভবন মার্চ’ শুরুর আগেই ‘চিহ্নিত স্বৈরাচার’ ‘গণভবন ত্যাগ করার’ দলিলে স্বাক্ষর করে। সেনাবাহিনী ৪৫ মিনিট সময় দেয় তাকে হেলিকপ্টারে ওঠার জন্য। তিনি হেলিকপ্টারে ওঠেন এবং দেশ ছাড়েন। গণঅভ্যুত্থানের বিজয় ঘোষিত হয়।
৫ আগস্ট সোমবার পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটান। একদলীয় শাসন, সংবিধানের দোহাই দিয়ে সংবিধানের অবমাননার নিকৃষ্ট স্বেচ্ছাচারিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার নগ্ন চেহারা দেখতে দেখতে ক্লান্ত, বিরক্ত দেশের মানুষ এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এর পরিসমাপ্তি ঘটান। গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়, জাতি পরাধীনতার গ্লানি ও ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্ত হয়। নিজের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশের অবৈধ ও অনৈতিক প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচারী হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। কুখ্যাত স্বৈরশাসকদের মতো অজ্ঞাত স্থান থেকে হেলিকপ্টারে চড়ে পলায়ন এবং তাঁর সরকারি বাসভবনে ঢুকে উন্মত্ত জনতার উল্লাস ও বাস ভবনে আগুন বিশ্ববাসীকে হলিউডি সিনেমার দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো শাসকই যে টিকে থাকতে পারেন না, বাংলাদেশ আবারও তা প্রমাণ করে।
আগস্ট বিপ্লবে প্রবাসীরা এক অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন। প্রবাসীরা রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ রাখেন। যতক্ষণ পর্যন্ত স্বৈরাচারের পতন না হবে তারা রেমিটেন্স না পাঠানোর ঘোষণা দেন। দেশে দেশে বিভিন্ন প্রবাসী সংগঠন বিক্ষোভ কর্মর্সূচি পালন করেন। দেশে দেশে প্রবাসীরা প্রতিবাদের ঝড় তুলেন। এভাবে আগস্ট বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যেক প্রবাসীই স্টেক হোল্ডারের ভূমিকা নেন। কনক সারওয়ার, সাহেদ আলম, জিয়া হাসান, পারভেজ আলম, তাজ হাশমী, শহীদ উদ্দিন খান, মাহমুদুর রহমান, অলিউল্লাহ নোমান, শামসুল আলম, মুর্শিদ সালিন, মারুফ মল্লিক, মিনার রশীদ, ওয়াহিদুজ্জামান, মিনা ফারাহ, মনির হায়দার, রেজা আহমেদ ফয়সল চৌধুরী শোয়েব, সৈয়দ মামনুন মোর্শেদ, আহমেদ ময়েজ, হাসনাত এম হোসাইন, আফজাল জামী, কেএম আবু তাহের চৌধুরী, আবদুর রব ভুট্রো, রুমি, রুপম রাজ্জাক, জাকির হাসান শিশির, আমান আব্দুল্লাহ, দেবাশীষ, এহতেশাম হক, মাহমুদুল হক, রাহাত শান্তনু, কাইয়ুম আব্দুল্লাহ, শফিকুল ইসলাম কাজল, মুহাম্মদ শরীফুজ্জামান, শামসুল ইসলাম, মিনহাজুল আলম মামুন, হাসান আল জাবেদ, সাকিব, টিটু রহমান, শরীফ আহসান, শিহাব আহমেদ, আব্দুল মুকিত, বদরুজ্জামান বাবুল, মাহতাব উদ্দিন, শাফায়াত, এনাম চৌধুরী, মাহবুব আলী খানশূর, নওশীন মোস্তারি মিয়া, মুসলিম খান, নাশিত রহমান, জ্যোতি, সৈয়দ নূর, জুবায়ের বাবু, ইফতেখার চৌধুরী, মোহাম্মদ মুজাহিদ, শেখ মুহিতুর রহমান বাবলু, মতিউর রহমান চৌধুরী, আবদুল মুনেম জাহেদী, আশরাফ মাহমুদ, মিয়া মুহাম্মদ তরুণ, রাকেশ রহমান, রায়হান উদ্দিন, রাশেদ, শাওন নবী, সাফি, নজরুল ইসলাম বাসন, নাজির আহমেদ, মো: হাসান শোয়াইব খান, মো: মাহফুজুর রহমান, হাসনাত চৌধুরী, মোস্তাফিজুর রহমান, দেলোয়ার হোসাইন, আবদুল ওয়াহিদ তালিম, আজহার ভূইয়া, মো: মনিরুজ্জামান, মো: ইউসুফ হোসাইন ও মুবিন চৌধুরীসহ আরও অনেক প্রবাসী আগস্ট বিপ্লব ও গণ-অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তবে এর মাঝে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত ১০ জন প্রবাসী বাংলাদেশি সিপাহশালারের ভূমিকা পালন করেন। এই ১০ জন প্রবাসী সিপাহশালার হলেন- ফ্রান্সে বসবাসরত ‘পিনাকী ভট্টাচার্য’, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসরত ‘ফাহাম আবদুস সালাম’, সুইডেনে বসবাসরত ‘তাসনিম খলিল’, কাতারে বসবাসরত ‘শায়ের জুলকারনাইন সামি’, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত ‘শামসুল আলম লিটন’, ‘হাসনাত আরিয়ান খান’, ‘একেএম জাকির হোসাইন’ ও ‘শেখ আখলাক আহমেদ’ এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ‘ইলিয়াস হোসাইন’ ও ‘মুশফিকুল ফজল আনসারী’। প্রবাস থেকে ভূমিকা রাখতে গিয়ে তারা নিজেরা ও কারো কারো পরিবার জিম্মি দশায় পতিত হন এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে মামলা হামলা গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। তবুও এই অকুতোভয় মানুষগুলো দমে যাননি। তাদের এই অবদান এবং তাদের পরিবারের ত্যাগের কথা ইতিহাসে অবশ্যই স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘পিনাকী ভট্টাচার্য’ ও ‘ফাহাম আবদুস সালাম’ ইতোমধ্যেই নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন। স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে নানা প্রশ্ন তু্লে ও নানা বিষয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করে সরকারের অনেক প্রচলিত বয়ানকে তাঁরা নড়বড়ে করে দিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের তাঁরা নানা তথ্য উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করেন। তরুণদের তাঁরা উজ্জীবিত করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় পিনাকী ভট্টাচার্য হ্যামিলনের বাশিওয়ালার মত ভূমিকা রাখেন। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের প্রতিটি অধ্যায়ে ছাত্র তরুণ ও সকল মানুষকে উজ্জীবিত করেন। ‘তাসনিম খলিল’ বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের নিয়ে সরকারের নানা প্রপাগান্ডার ও জিম্মি করে ব্ল্যাকমেইল করে এই লিখিত বক্তব্য পাঠ করানোর বিপরীতে সঠিক তথ্য তুলে ধরেন। সমন্বয়কারীদের বিভিন্ন বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেন। এবং গণহত্যা তদন্তে ফার্স্টহ্যান্ড এভিডেন্স নেত্র নিউজের গ্লোবালিকস ওয়েবসাইটে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেন। ‘শায়ের জুলকারনাইন সামি’ কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক টেলিভিশন চ্যানেল আলজাজিরায় বাংলাদেশ বিষয়ে নিয়মিত বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করেন। ‘শামসুল আলম লিটন’, ‘একেএম জাকির হোসাইন’ ও ‘শেখ আখলাক আহমেদ’ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও রেব পুলিশের হামলার পর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ এলায়েন্স ফর হিউম্যান রাইটস (জিবিএএইচআর) মাধ্যমে ‘বাংলাদেশ সলিডারিটি ক্যাম্পেইন’ শুরু করেন। এবং পূর্ব লণ্ডনের আলতাব আলী পার্কে সংগঠনের পক্ষে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেন। শামসুল অলম লিটনের নেতৃত্বে ‘জিবিএএইচআর’ এর অন্তর্ভুক্ত সংগঠনগুলো লণ্ডনে অগণিত কর্মসূচি পালন করে। ‘অ্যাকশনস স্পিক লাউডার দ্যান ওয়ার্ডস’ তত্ত্বে বিশ্বাসী ‘হাসনাত আরিয়ান খান’ তাঁর ‘ইউনাইটেড বেঙ্গল মুভমেন্ট’ এর কর্মীদের মাধ্যমে হল ছেড়ে আসা শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। আহত শিক্ষার্থীদের হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং কারো রক্তের প্রয়োজন হলে রক্তের ব্যবস্থা করেন। শিক্ষার্থীদের বাচাঁতে গিয়ে তাঁর সংগঠনের অসংখ্য কর্মী আহত হন। এছাড়া ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে প্রথমেই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানান। বাংলাদেশের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাত্র সংগঠনগুলোকে বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানানোর আহ্বান জানান। ইন্ডিয়া, নেপালসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমর্থনে বিক্ষোভ সমাবেশের পেছনে তিনি ও তাঁর সংগঠনের সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থায় তিনি লিখেন এবং ‘জিবিএএইচআর’ এর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে তিনি ‘বাংলাদেশ সলিডারিটি ক্যাম্পেইন’ এ অংশ নেন ও সংগঠনকে সার্বিক সহযোগিতা করেন। ‘ইলিয়াস হোসাইন’ আন্দোলনের শেষ দিকে এসে সমন্বয়কদের তুলে নিয়ে যাওয়া এবং অসংখ্য গুম ও খুনের অন্যতম হোতা গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান হারুন-অর-রশিদের অশ্লীলতার ভিডিও ভাইরাল করে জাতির সামনে তার মুখোশ খুলে দেন এবং তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেন। ‘মুশফিকুল ফজল আনসারী’ হোয়াইট হাউসের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে অংশ নেন। এবং ছাত্র-জনতার পক্ষে বিভিন্ন প্রশ্ন করে সরকারকে চাপে রাখেন। তারপরেও এই প্রবাসী ১০ সিপাহশালার ছাত্র-জনতাকেই এই বিপ্লবের মহানায়ক মনে করেন।
অথচ এক শ্রেণির মানুষ এখন সুযোগ বুঝে বিপ্লবী সাজছেন, নিজেকে বীরশ্রেষ্ঠ দাবি করছেন। কিন্তু আলোচিত এই ১০ জনের কেউ হঠাৎ করে বীরশ্রেষ্ঠ হন নাই। এরা কেউ ক্রেডিট নেওয়ার জন্যও উতলা হয়ে উঠেন নাই, ক্লাউনের মত ভোল পাল্টে হঠাৎ করে বিপ্লবী সাজেন নাই। স্বৈরাচার পতনের দীর্ঘ লড়াই, আন্দোলন, সংগ্রামে তাঁরা ছিলেন। স্বৈরাচার সরকারের সাথে কোন আপোষ করেন নাই। এদের মাঝে কেউ কেউ ১৫ বছর দেশে যেতে পারেন নাই। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যাবে। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নানাভাবে দেশের ও বিদেশের গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এর মাঝে ব্যতিক্রম ছিলো যুক্তরাজ্য থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক সুরমা’। সুরমা’কে তিনি বশে আনতে পারেন নাই। সুরমা সম্পাদকের ভাইকে দেশে গ্রেফতার করেও সুবিধা করতে পারেন নাই। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সুরমা কার্যালয়ে অস্থায়ী ডাটা সেন্টার স্থাপন করে স্বৈরাচার পতনে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। সাপ্তাহিক সুরমা‘র উদ্যোগে হাউস অফ কমন্সের গ্র্যান্ড কমিটি হলরুমে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ‘সমতা ও ন্যায়ের জন্য ছাত্র আন্দোলন’- শীর্ষক প্যানেল ডিসকাশন অনুষ্ঠিত হয়। সত্য প্রকাশে, গণমানুষের অধিকার আদায়ে ও স্বৈরাচার সরকার পতনে সব সময় সোচ্চার ছিলো সুরমা। যেকারণে সরকারি কোন প্রোগ্রামে সুরমা টিমের কোন সাংবাদিক দাওয়াত পেতেন না। এমনকি হাইকমিশনের কোন প্রোগ্রামেও তাদের ডাকা হতো না। জুলাই বিপ্লবে যুক্তরাজ্যের যে ৪ জন সিপাহশালারের নাম এসেছে এদের মধ্যে ৩ জনই সাপ্তাহিক সুরমা’র সাথে সম্পৃক্ত। শামসুল আলম লিটন সাপ্তাহিক সুরমা’র সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। হাসনাত আরিয়ান খান চীফ রিপোর্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শেখ আখলাক আহমেদ ডিপ্লোমেটিক এডিটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। প্রবাসী সিপাহশালারগণ বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ফ্যাসিবাদী সরকারের হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং এ বিষয়ে সকল প্রবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রবাসীদের রেমিটেন্স পাঠানো বন্ধ রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং তাঁরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা করেছেন। এছাড়াও তাঁরা বাংলাদেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও ভারতীয় কূটনীতিকদের একতরফা ও মানহানিকর বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছেন। শেখ হাসিনাকে অবিলম্বে পদত্যাগ করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন। এরপরেও শেখ হাসিনা পদত্যাগ না করলে তাঁরা ছাত্র-জনতাকে গণভবন ঘেরাওয়ের আহ্বান জানিয়েছেন।
যে কারণে এই লেখার অবতারনা। আগস্ট বিপ্লবের মহানায়ক ছাত্র-জনতা ও প্রবাসীরা। আগস্ট বিপ্লবের সিপাহশালার একক কোন ব্যক্তি নয়, গোষ্ঠী নয়, দল নয়। স্বৈরাচার পতনে ছাত্র-জনতা ও প্রবাসীরা যে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, তাতে আমরা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছি। সকল প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে সংগ্রামী এ বীরদের অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানাই, অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে গিয়ে আরব আমিরাত, কাতার ও সৌদি আরবে অনেক প্রবাসী গ্রেফতার হয়েছেন। অবিলম্বে আমরা তাদের মুক্তি চাই। আগস্ট বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানে আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের মধ্যে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, সকল শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। ছাত্র–জনতার এই অভ্যুত্থানে দেশে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছেন, প্রবাসে যাঁরা সিপাহশালারের ভূমিকা নিয়েছেন আমরা তাঁদের অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের এই গণঅভ্যুত্থান ও বিপ্লব যাতে কেউ নস্যাৎ করতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানাই। সেই সাথে আগস্ট বিপ্লবে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া শহীদ পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। আগস্ট বিপ্লব ও এই গণঅভ্যুত্থানকে রক্ষা করা এখন বাংলাদেশের সকল ছাত্র-জনতা ও প্রবাসীদের দায়িত্ব।