লোকসভা নির্বাচন: নরেন্দ্র মোদীর আগ্রাসী মুসলিম বিদ্বেষ ও মরিয়া প্রচারণা কি হারের লক্ষণ?
।। রূপম রাজ্জাক।।
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপের ভোটগ্রহন হয়ে গেলো গত মঙ্গলবার। ১২টি রাজ্যব্যাপী ৯৪টি আসনে ছিল এই ধাপের ভোট। প্রথম দুই ধাপের ১৯১টি আসনের পর তৃতীয় ধাপের ভোট বেশ উত্তেজনাপূর্ন ছিল। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রাথমিক ভোটার টার্নআউটের হিসাবের চেয়ে ৬% বেশি হিসাব প্রকাশ পাওয়ায় বেশ সমালোচনা ছিল। এ নিয়ে বিরোধীরা জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। কারণ এতটা বেশি বর্ধিত হিসাব আগে কখনো দেখা যায়নি। মমতা ব্যানার্জি তো আরও সরাসরি আঙ্গুল তুলে বললেন বিজেপি যেসব আসনে কম ভোট পেয়েছে সেসব জায়গায় এই হিসাব বেশি করে বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া, বিজেপি জোটের সদস্য কর্ণাটকের জেডিএস দলীয় একজন এমপি প্রার্থী কর্তৃক প্রায় ৩ হাজার জন নারীকে বিকৃত যৌনাচার তথা হেনস্থার ভিডিও ফাঁস হয়েছে। নজিরবিহীন এই ঘটনা ঘটিয়েছে জেডিএস এর প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেভেগৌডার নাতি কর্ণাটকের হাসান আসনের এমপি প্রজওয়াল রেভান্না। তৃতীয় ধাপে কর্ণাটকের অবশিষ্ট ১৪টি আসনেরও ভোটগ্রহন ছিল। ধারণা করা যায় এর প্রভাব পড়বে ভোটের মাঠে। সেক্ষেত্রে সুবিধা পাবে কংগ্রেস প্রার্থীরা, যেখানে ইতিমধ্যেই তারা বিভিন্ন জরিপে এগিয়ে ছিল।
প্রথম ধাপের ভোটগ্রহনের পর হঠাৎ করে নরেন্দ্র মোদীর মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য সবচেয়ে আলোচনায় ছিল। তিনি কংগ্রেসের ইশতেহারের ভুল ব্যাখা দিয়ে ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বক্তব্যকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে মুসলমানদের হেয়প্রতিপন্ন করেন। কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরলে “অতিরিক্ত বাচ্চা পয়দাকারী” মুসলমানদের কাছে চলে যাবে হিন্দুদের সম্পদ, মঙ্গলসুত্র কেড়ে নেয়া হবে ইত্যাদি নানান অগোছালো আক্রমনাত্মক বক্তব্য। একজন প্রধানমন্ত্রীর মুখে এধরনের মিথ্যা ও ঘৃণাসূচক বক্তব্য বেশ বিস্ময় সৃষ্টি করেছে রাজনৈতিক মহলে। কিন্তু এতেও তিনি থামেননি।
ধারণা করা হয়, প্রথম ধাপের নির্বাচনে প্রত্যাশিত সাড়া না পেয়ে নরেন্দ্র মোদী পুরনো হিন্দু-মুসলিম রাজনীতিকে উস্কে দিয়ে হিন্দু ভোটকে সুসংহত করতে চাইছেন।
কিন্তু বিষয়টা শুধুমাত্র সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি। অভিযোগ এসেছে, দ্বিতীয় ধাপের ভোটের আগের রাতে ও ভোটের দিন মুসলিম অধ্যুষিত অনেক এলাকায় হঠাৎ করে নির্ধারিত রেল চলাচল বন্ধ ও বিলম্ব করে দেয়া হয়েছে যাতে মুসলমানরা কম অংশগ্রহণ করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায় তৃতীয় ধাপেও বোরকা পরিহিত অনেক মুসলিম নারীকে ভোট দিতে বাঁধা দেয়া হয়েছে।
কেন এত ভয় নরেন্দ্র মোদির? ধারণা করা হয়, দেশের সমসাময়িক সমস্যাগুলোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে হিন্দু-মুসলিম, পরিবারতন্ত্র, রামমন্দির, পাকিস্তান, পূর্বের কংগ্রেস সরকারগুলোর ব্যর্থতা ইত্যাদি নানান বিষয়ে নরেন্দ্র মোদীর বক্তব্যের চেয়ে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, তীব্র বেকারত্ব সমস্যা, ধনীদের বেশি সুবিধা দেয়া, জাতপাতের বৈষম্য, বিজেপির গত ১০ বছরের প্রতিশ্রুতি বনাম ব্যর্থতার বাস্তবতা, বিরোধীদের উপর নির্যাতন, রাষ্ট্রযন্ত্রের অনৈতিক ব্যবহার, ইলেক্টোরাল বন্ড কেলেঙ্কারি ইত্যাদি বিষয়গুলো মানুষের কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে এবং প্রথম ধাপেই মানুষ সেভাবে সাড়া দিয়েছে বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রী আরও আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিয়ে হিন্দু ভোটকে সুসংহত করাকে সহজ কৌশল মনে করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপির ভয়ের বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ন ব্যক্তির কথাতেও স্পষ্ট হয়েছে।
প্রথম ধাপের নির্বাচনের আগেই অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া নামক খ্যাতিমান ইলেকশন জরিপকারী প্রতিষ্ঠানের পরিচালক প্রদীপ গুপ্তের একটি টুইটে প্রকাশ পায় (যা পরবর্তীতে সরকারের চাপে তিনি মুছে ফেলেন), এবারের নির্বাচনে সরকারি জোট ১৩টি রাজ্যে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হবে ও সিট হারাবে। এছাড়া কংগ্রেসের ইশতেহারে দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহায়তা, শিক্ষানবিশ প্রোগ্রামের অধীনে গ্রাজুয়েটদের মাসিক ২৬ হাজার রুপি প্রদান, বেকারত্ব নিরসন, কাষ্ট সেন্সাস (জাতগণনা), বর্তমানের বিতর্কিত জিএসটি’র পরিবর্তন করে সব পণ্যের ক্ষেত্রে একই রেট নির্ধারণ, কেন্দ্রীয় সকল চাকরিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ৫০% করা ইত্যাদি প্রতিশ্রুতিগুলো আলোচিত হচ্ছে। এসব নিয়ে দেয়া রাহুল গান্ধীর বক্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছে। তাছাড়া, নির্বাচনকালীন এই সময়ে বিভিন্ন আলোচনার প্রসঙ্গ প্রধানত তৈরি হচ্ছে বিরোধী পক্ষ থেকে। নরেন্দ্র মোদী বা বিজেপি এবার টপিক সেট করতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে প্রতীয়মান। এ ব্যাপারে বিজেপিপন্থী সিনিয়র সাংবাদিক শেখর গুপ্ত এপ্রিলের শেষে একটি মন্তব্যে বলেন, ‘বিজেপি এবার স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কংগ্রেসের দেয়া এজেন্ডায় পা দিয়েছে। এটা আগে কখনো ঘটেনি। গত ৩ সপ্তাহ ধরেই কংগ্রেসের এজেন্ডাগুলো লাইমলাইটে আছে।’
যেমনটি আগের লেখায়ও বলেছিলাম, ভারতের নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ভর করে প্রধান ৪টি রাজ্যের প্রতিযোগিতায় কে কতটা এগিয়ে থাকে তার উপর। এর সাথে হিন্দি হার্টল্যান্ড। বিজেপির সুবিধা হচ্ছে, শীর্ষ ৪টি রাজ্য উত্তর প্রদেশ (৮০টি আসন), মহারাষ্ট্র (৪৮), পশ্চিমবঙ্গ (৪২) ও বিহার (৪০) সবকটিতেই শক্তিশালী সংগঠন আছে। এর বাইরে গুজরাটে একচ্ছত্র প্রভাবসহ কর্ণাটক, ওডিশা ও আসামের মতো রাজ্যেও তাদের নিজেদের শক্তিশালী সংগঠন আছে। ফলে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পারলেও সংসদে একক বৃহত্তম দল হবে নিশ্চিন্তে। বিজেপির এবারের সমস্যা হলো, তারা আগের দু’টি নির্বাচনেই হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি তথা ধর্মীয় মেরুকরণের সর্বোচ্চটা ব্যবহার করে সর্বোচ্চ আসনে জয় পেয়েছে বিধায় এবার আসন ধরে রাখার চ্যালেঞ্জে পড়েছে, যেহেতু মানুষ এবার তাদের সরকারের ১০ বছরের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে মূল্যায়ন করছে। এক্ষেত্রে কংগ্রেসের বাস্তবধর্মী ইশতেহার ও বিভিন্ন কৌশলগত প্রচারণাও মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ফলে বিজেপি এবার আসন হারাতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় এসেছে। বিশেষ করে কর্নাটক, রাজস্থান ও মহারাষ্ট্রের ব্যাপারে বিরোধীরা বেশি আশাবাদী। আরও বেশকিছু রাজ্যে ৩ থেকে ১০ টি করে বাড়তি আসন পাবার আশা দেখছে বিরোধীরা – যে রাজ্যগুলোতে বিজেপি বা জোট প্রায় সব আসনে জিতেছিল।
তবে কি বিজেপি জোটের টার্গেট ৪০০+ আসন অসম্ভব বিষয়? সেটাই বাস্তবতা। কারণ বিজেপি তার জোটসহ ইতিপূর্বের নির্বাচনেই তাদের শক্তিশালী রাজ্যগুলোতে প্রায় সব আসনে জিতে তবে ৩৫০টি জিততে পেরেছিল। এবার সেসব জায়গায় আসন হারাবে।
তবে এটা ঠিক বিজেপি দক্ষিণে তাদের রাজনৈতিক স্পেস তৈরির চেষ্টা করছে। তামিল নাডুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফর সংখ্যা দেখলে তা স্পষ্ট হয়। কিংবা কেরালায় মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয়তা। যদিও এই দু’রাজ্যে কোনো সিট পাবার সম্ভাবনা কম, তবে ভোট শেয়ার বাড়বে যা তাদের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে কাজে দিবে। তথাপি অন্ধ্র প্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডুর সাথে যে জোট করেছে তা সম্ভাবনাময়, অন্তত ১০টি আসনে জিতবে ধারণা করা হয়। এছাড়া ওডিশায় এবার বিজেপি ভালো করবে, কেউ কেউ বলছে আগের চাইতে অন্তত ৫টি আসন যোগ হবে। পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপির ২-৬টি আসন বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা। দেখার বিষয় হবে উত্তর প্রদেশে যে ১৬টি আসনে গতবার বিজেপি জোট জিততে পারেনি সেখানে দখল নিতে পারে কিনা। উত্তর প্রদেশের ব্যাপারে বিরোধীদের খুব বেশি আশাবাদী বলে মনে হয়না। বিশেষ করে রাজ্যের অন্যতম প্রধান দল প্রাক্তন মূখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর বিএসপি’র আলাদাভাবে নির্বাচন বিজেপিবিরোধী ভোটকে বিভক্ত করবে বলে প্রতীয়মান। সেক্ষেত্রে বিজেপি এবার আরও ৫-৮টি আসন বেশী পেতে পারে। সার্বিক হিসাবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন বিজেপি জোট আগের জেতা ৭০-৯০টির মতো আসন হারাতে পারে আর ২৫-৩০টি নতুন আসনে জয় পেতে পারে।
মোটের উপর বলা যায়, এই নির্বাচনে এখনো বিজেপি জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবার সম্ভাবনাই বেশী। কারণ, নানান হিসাব-নিকাশের বাইরে তাদের রয়েছে নরেন্দ্র মোদির মতো তাদের একজন প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী; অথচ বিরোধীরা এখনো নিশ্চিত না কে হবে তাদের প্রধানমন্ত্রী। ভারতের জাতীয় নির্বাচনে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন বিষয়।
ফলে বিজেপির জয় আগের মতো বিশাল ব্যবধানের না হলেও সম্ভাবনার পাল্লা তাদের দিকেই। অন্যদিকে, বিরোধীরা যেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে ও আলোচনায় থাকতে পারছে তা ধরে রাখতে পারলে বিজেপির জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া কঠিন হবে। কারণ ভারতের জাতীয় নির্বাচনে ভোটের প্যাটার্ন পরিবর্তন বা মেরুকরণ হতে সময় লাগেনা। তাই আগামী ধাপগুলোতে বিরোধীরা কতটা ন্যারেটিভ নিয়ন্ত্রণ করে তার উপর নির্ভর করছে গোটা নির্বাচনের ফলাফল।
আগামীকালই চতুর্থ ধাপের নির্বাচন। ১০টি রাজ্যের ৯৬টি আসনে হতে যাচ্ছে ভোটগ্রহণ। এরই মাঝে শুক্রবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। যদিও তিনি দাপ্তরিক কাজ করতে পারবেন না, তবে নির্বাচনী প্রচার চালাতে পারবেন। যা বিরোধী জোটকে সুবিধা দেবে। বিশেষ করে মূলধারার মিডিয়ায় আলোচনায় থাকার কৌশল কেজরিওয়াল খুব ভালো জানেন। ইতিমধ্যেই তার প্রমাণও দিয়েছেন ‘এক বছর পর নরেন্দ্র মোদির সম্ভাব্য অবসর’ নিয়ে কথা বলে। অন্যদিকে, দু’জন সাবেক বিচারপতি ও একজন সাংবাদিক আহবান জনিয়েছেন মোদী ও রাহুলকে উন্মুক্ত বিতর্ক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার। রাহুল গান্ধী তা লুফে নিয়ে বলেছেন তিনি রাজী, কিন্তু নরেন্দ্র মোদী বা বিজেপি থেকে এ বিষয়ে সাড়া নেই। সবমিলিয়ে জমে উঠেছে লোকসভার এই ধাপের নির্বাচনও।
লেখকঃ রূপম রাজ্জাক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংবাদিক ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ।