- দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয়
- দুর্নীতিতে আরও ২ ধাপ অবনমন
।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ০৪ ফেব্রুয়ারি- শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে পাকিস্তান, উগান্ডার চেয়েও নিচে নামিয়েছে। ‘সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত’ দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ এখন দশম অবস্থানে রয়েছে। ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২তম। বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) দুর্নীতির ধারণাসূচক ২০২৩ শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় কেবল আফগানিস্তান দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের নিচে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও নির্বাচনের আগের বছরে সরকার, সরকারি দল আর আর তাদের অলিগার্করা দুর্নীতির মহোৎসব চালিয়েছে। নির্বাচনের সার্কাস করে যে সংসদ বানিয়েছে তার অর্ধেকের বেশি কথিত এমপি হাজার কোটি টাকার মালিক। পাকিস্তান আমলে ২২ পরিবার ছিল আর এখন আওয়ামী লীগ করলেই কোটিপতি, পদ পেলে শত কোটি আর এমপি হলে হাজার কোটি টাকার মালিক। আর তাদের সাথে আছে এস আলম, সামিট আর দরবেশরা। যারা তাদের ক্যাশিয়ার। ভাগ বাটোয়ারা করে দেশের অর্থনীতিকে ফোকলা করে দিয়েছে। এদের কেউ ব্যাংক ধ্বংস করেছে, কেউ শেয়ার বাজার লুট করেছে। আর এই সরকার দেশের জনগণের ভোটাধিকার থেকে শুরু করে সকল অধিকার হরণ করে একটা লুটের সাম্রাজ্য তৈরি করেছে। ব্যাংকে টাকা নাই, ডলার নাই; কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ নাই। কিন্তু লুটপাট চলছে আগের মতোই। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দখলদার সরকার দেশকে দেউলিয়া বানিয়ে ছাড়বে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকের (সিপিআই) ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৯ নম্বরে। গতবার এই তালিকায় বাংলাদেশ ১৪৭ নম্বরে ছিল। আর অধঃক্রম অনুযায়ী বিবেচনা করলে বাংলাদেশ অবস্থান এবার ১৮০ দেশের মধ্যে দশম, যেখানে গত বছর ছিল দ্বাদশ অবস্থানে। দুর্নীতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে স্কোর ও র্যাঙ্কিংয়ে আফগানিস্তানের পরে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
রাজধানীর ধানমণ্ডিতে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) কার্যালয়ে প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক এবং বাংলাদেশের দুর্নীতির পরিস্থিতি তুলে ধরে এসব তথ্য জানান সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গবেষণা অনুযায়ী ২৪টি পূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৪৮টি ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক, ৩৬টি হাইব্রিড গণতান্ত্রিক ও ৫৯টি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের গড় সিপিআই স্কোর যথাক্রমে ৭৩, ৪৮, ৩৬ ও ২৯; অথচ বাংলাদেশের স্কোর ২৪। এমনকি ফ্রিডম হাউস অনুযায়ী যেসব দেশে নির্বাচনী গণতন্ত্র আছে, এমন ৯৩টি রাষ্ট্রের গড় স্কোর ৫৩ এবং নির্বাচনী গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রগুলোর গড় স্কোর ৩১, সেখানেও বাংলাদেশের ২৪ স্কোর উদ্বেগজনক ও বিব্রতকর। দুর্নীতি ও অবিচার পরস্পর সম্পর্কযুক্ত, দুর্নীতি অন্যায়ের জন্ম দেয় এবং নাগরিক ও অন্যায় দুর্নীতির দুষ্টচক্র তৈরি করে। সিপিআইয়ের তথ্য আরও প্রমাণ করে, যেসব দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা রয়েছে, রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত, সেসব দেশের কার্যকর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনা বেশি।
দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান তুলে ধরে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০২৩ সালের সিপিআই অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় শুধুমাত্র ভুটান গত বছরের ৬৮ স্কোর ধরে রেখেছে। নেপাল ও পাকিস্তানের স্কোর যথাক্রমে ১ ও ২ পয়েন্ট উন্নতি হয়েছে এবং অবশিষ্ট পাঁচটি দেশের স্কোরই ১ থেকে ৪ পয়েন্ট অবনমন হয়েছে। এরমধ্যে আফগানিস্তানের স্কোর কমেছে ৪ পয়েন্ট, শ্রীলংকার ২ পয়েন্ট এবং মালদ্বীপ, ভারত ও বাংলাদেশের স্কোর কমেছে ১ পয়েন্ট করে।
ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী এ বছর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধুমাত্র পাকিস্তান ও নেপালের অবস্থানের যথাক্রমে ৭ ধাপ ও ২ ধাপ উন্নতি হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৬টি দেশের অবস্থানের ১ থেকে ১৪ ধাপ পর্যন্ত অবনতি হয়েছে। এরমধ্যে শ্রীলংকার ১৪ ধাপ, আফগানিস্তানের ১২ ধাপ, ভারত ও মালদ্বীপের ৮ ধাপ, বাংলাদেশের ২ ধাপ এবং ভুটানের অবস্থানের ১ ধাপ অবনমন হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র ভুটান ছাড়া বাকি সাতটি দেশই সূচকের গড় স্কোর ৪৩-এর কম পয়েন্ট পেয়েছে। তিনি বলেন, সূচকে ১০০ স্কোরের মধ্যে ৯০ পেয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে তালিকার শীর্ষে আছে ডেনমার্ক। ৮৭ পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে ফিনল্যান্ড। আর সবচেয়ে দুর্নীতি বেশি হচ্ছে সোমালিয়ায়। তাদের স্কোর মাত্র ১১। ১৩ পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে আছে দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা।
বাংলাদেশের নিম্ন অবস্থানের ব্যাখ্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, গত কয়েক বছর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার সবচেয়ে আলোচিত মেয়াদ ছিল। কিন্তু এই মেয়াদে এই ঘোষণাকে চর্চায় রূপ দেয়ার সুনির্দিষ্ট কৌশলনির্ভর কার্যক্রম দৃশ্যমান হয়নি, উপরন্তু এই মেয়াদে দুর্নীতির ব্যাপকতা ঘনীভূত ও বিস্তৃত হয়েছে। সরকারি ক্রয় ও বিতরণ ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে দুর্নীতির অসংখ্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়কালে বিদেশে অর্থপাচারের আশঙ্কাজনক চিত্র উঠে আসলেও এর প্রতিরোধ ও প্রতিকারে দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ঋণখেলাপি, জালিয়াতি ও অর্থপাচারে জর্জরিত ব্যাংকিং খাতের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি; বরং এর জন্য যারা দায়ী, তাদের জন্য বিচারহীনতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমনে কার্যকর দৃষ্টান্ত শাস্তি নিশ্চিতে কার্যকরতা দেখাতে পারেনি। রাজনৈতিক, প্রসাশনিক ও আর্থিকসহ বিভিন্নভাবে অর্জিত ক্ষমতার অবস্থানকে অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পদ বিকাশের লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহারের ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়ে স্বাভাবিকতায় রূপান্তর করা হয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক প্রভাব ব্যাপকতর হয়েছে।
টিআই’র এই ফলাফল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এটি একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা। যখন ক্ষমতায় যে দল থাকে সেই দলের কাছে এই গবেষণা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, সেই দল যখন বিরোধী দল হয় তখন তারা সেটা গ্রহণ করে। আমাদের গবেষণাকে রেফার করে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার চেষ্টা করে। অর্থাৎ আমরা যে কথাগুলো বলছি সেগুলোর যথার্থতা রয়েছে।
দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের ভালো হওয়ার কোনো সুযোগ আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে টিআইবি’র চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, সরকারের দুর্নীতি দমনের অঙ্গীকার আছে। তারা যে কথাগুলো বলে, সেগুলা সৎভাবে বলেন কিনা তার ওপর বিষয়টি নির্ভর করে। তবে তারা যেই মন্তব্য করেন, আমাদের হতাশ হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন- টিআইবি’র উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (আউট রিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ মনজুর-ই-আলম, সমন্বয়ক (আউট রিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।