শামীমার প্রতি এই আচরণ বৃটেনের মানবাধিকারের সুনামকে কলঙ্কিত করবে: এমপি আপসানা

শামীমার নাগরিকত্ব ফিরে পাবার পক্ষে বাড়ছে জনমত

সুরমা প্রতিবেদন
লণ্ডন ৩ মার্চ : শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব ইস্যুতে ব্রিটিশ সরকারের কঠোরনীতির নিন্দা ও সমালচনা করেছেন বৃটেনের মূলধারার রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞসহ বিশিষ্টজন। গত ২২ ফেব্রুয়ারী, বুধবার স্পেশাল ইমিগ্রেশন অ্যাপিলস কোর্ট কতৃর্ক শামীমার নাগরিকত্ব ফিরে পাবার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন তারা। অপ্রাপ্ত বয়সে (১৫ বছর) দেশতাাগ এবং পাচারের শিকার হওয়ার বিষয়টি শামীমার আইনজীবীরা তুলে ধরার পরও কোর্টের রায় হোম অফিসের পক্ষে অর্থাৎ তাঁর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়াকে সমর্থন করায় বিস্ময় করেছেন সচেতন মহল।
তবে বিভিন্ন মাধ্যমে বিশিষ্টজন কর্তৃক শামীমাকে দেশহীন করার ব্রিটিশ সরকারের নেওয়া কঠোর পদক্ষেপের নিন্দা ও সমালোচনা পরিলক্ষিত হলেও বাংলাদেশী কমিউনিটির বিশিষ্টজন, জনপ্রতিনিধি কিংব সংস্থা, সংগঠনগুলোর নেতৃস্থানীয়রা নিরবতা পালন করে যাচ্ছন। এমনকি বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত ৪ এমপির কাউকেই শামীমার নাগরিকত্বের মতো মানবাধিকার ইস্যুতে সহায়তা করতে স্বেচ্ছায় কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। গত ২২ তারিখে বিশেষ আদালতের রায়ে শামীমার নাগরিকত্ব বহালের আবেদন প্রত্যাখ্যান হবার পর ওই চার এমপির সাথে সুরমার পক্ষ থেকে তাদের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে ইমেইল করার পর মাত্র একজনের পক্ষ থেকে সাড়া পাওয়া গেছে, তিনি হলেন পপলার এণ্ড লাইমহাউসের এমপি আপসানা বেগম। শামীমা ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে সুরমার পক্ষ থেকে পাঠানো ইমেইল পাওয়ার প্রায় সাথে সাথেই তিনি সাড়া দিয়ে তাঁর বক্তব্য প্রদান করেন। একটি বেদনায়ক পরিস্থিতিতে শামীমা থেকে ব্রিটিশ সরকাররের মুখ ফিরিয়ে নেয়াকে রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে নিন্দনীয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, শামীমার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওযা এবং বন্দীশিবিরে বছরের পর বছর তাকেসহ অন্যান্য নারীদের আটকে রাখা বৃটেনের মানবাধিকার সম্পর্কিত সুনামকে কলঙ্কিত করবে। কাউকে রাষ্ট্রহীন করা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী উল্লেখ করে আপসানা বলেন, এটা রাজনৈতিকভাবে এবং নৈতিকভাবে নিন্দনীয় যে, সরকার একটি চ্যালেঞ্জিং, বেদনাদায়ক এবং জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় দায়িত্ব থেকে সরে আসতে চাইছে এবং বাজেভাবে তাদের মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, ছোটবেলায় পাচারের শিকার হয়েছিলেন শামীমা এবং যুক্তরাজ্যের উচিত পাচারের শিকার যে কোনো ব্রিটিশ কিশোরীর ন্যায় তার দায়িত্ব নেওয়া।
সবশেষে আপসানা বলেন, ভবিষ্যতে এধরণের আর কিছু যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করার জন্যে আসলে আমাদের একটি তদন্তকরে দেখা দরকার যে রাষ্ট্র কীভাবে তাকে পাচারের হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে।
অপরদিকে, খোদ টোরি পার্টির সিনিয়র নেতারা শামীমা বেগমের প্রতি সরকারের আচরণের নিন্দা করেছেন। সিরিয়ায় পাচার হওয়া ব্রিটিশদের উপর সর্বদলীয় সংসদীয় গ্রুপের ভাইস-চেয়ার ডেভিড ডেভিস বলেছেন, এটি দায়িত্বের লজ্জাজনক প্রত্যাখান এবং এর প্রতিকার করা আবশ্যক।
টোরি রাজনীতিক ও আইনজীবী ব্যারোনেস সাঈদা ওয়ার্সি বলেন, নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা প্রধানত দক্ষিণ এশীয়, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকান ঐতিহ্যের মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রায় একচেটিয়াভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, আইনের ন্যায্যতা ও সমতার ব্রিটিশ মূল্যবোধের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীতে একটি দ্বি-স্তরের নাগরিকত্ব ব্যবস্থা তৈরী করেছে। তিনি বলেন, বৃটেনের এসব‘কঠোর’ নীতিগুলি দ্বৈত নাগরিকত্বেরসহ ৬ মিলিয়ন মানুষের উদ্বেগের বিষয়।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশী পিতামাতার সন্তান শামীমা বেগমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা পূর্ব লণ্ডনের বেথনাল গ্রিনে। ২০১৫ সালে ১৫ বছরবয়সে বেথনাল গ্রিন একাডেমির এই ছাত্রী একই স্কুলের দুই সহপাঠির সাথে সিরিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে যাবার ১০ দিন পরেএক আইএসআইএল সদস্যকে বিয়ে করেছিলেন বলে সংবাদ প্রকাশিত হয় এবং তার তিনটি সন্তান ছিল যারা জন্মের প্রায়কিছুদিন পরপরই মারা যায়।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে, যুদ্ধ সংবাদদাতা অ্যান্থনি লয়েড উত্তর সিরিয়ার আল-হাউল শরণার্থী শিবিরে বেগমকে জীবিতঅবস্থায় খুঁজে পান। পরের দিন, ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি সাজিদ জাভিদ তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করেন। ব্রিটিশ সরকারবিশ্বাস করে যে বেগম তার বাংলাদেশী পিতামাতার কারণে দ্বৈত নাগরিকত্ব ধারণ করেছিলেন কিন্তু বাংলাদেশ সরকারও তাকে আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে।
তৎকালীন হোম সেক্রেটারি সাজিদ জাভিদ কতৃর্ক শামীমা কখনই যুক্তরাজ্যে ফিরতে পারবেন না ঘোষণার পর ২০২০ সালেরজুলাই মাসে তা চ্যালেঞ্জের জন্য তাকে যুক্তরাজ্যে ফিরে আসার অনুমতি দেয়া উচিৎ বলে আপিল আদালত রায় দেয়। কিন্তু তা পরিষ্কার ছিলো না যে হোম অফিস কতৃর্ক নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার পর কীভাবে শামীমা বৃটেনে এসে হোম অফিসের সিন্ধান্তের চ্যালেঞ্জ করবেন। তবু এই রায়ের প্রেক্ষিতে আপিল করেন শামীমার আইনজীবীরা। ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী আপিল কোর্ট হোম অফিসের সিদ্ধান্তের পক্ষেই সর্বসম্মত রায় প্রদান করে।
সর্বশেষ ২২ ফেব্রুয়ারী (২০২৩), স্পেশাল ইমিগ্রেশন অ্যাপিল কোর্ট আবারও হোম অফিসের পক্ষে রায় দিয়ে বলেছে যে, সাবেক হোম সেক্রেটারি সাজিদ জাভিদ কতৃর্ক শামীমা বেগমের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্তটি জাতীয় নিরাপত্তার কারণে বৈধ ছিল।