একুশে উত্তর ভাবনা
|| আহমদ ময়েজ ||
লেখক: কবি, সাপ্তাহিক সুরমার সাবেক সম্পাদক

ভাষা দিবসের দিন চলে গেলে আমরা ব্যস্ত হয়ে যাই কতো অধিকভাবে বাংলাভাষাকে গুরুত্বীহীন করে তোলা যায়। আমরা স্বীকার করি বা না করি — এটা আমাদের কাজে ও মানসিকতায় স্থির হয়ে আছে। এ নিয়ে পরে ভাবি না বা কোনো আলোচনা-পর্যালোচনা বা তর্ক করি না। ভাষা দিবসটা এখন কেবল পোষাকী একটি দিন — যা আমাদের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছে প্রতিনিয়ত। শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের সুরে কবি আল মাহমুদের একটি কাব্যগাঁথা আমাদের নতুন করে ভাবাচ্ছে। সে গানটির চরণগুলো নিয়ে আজকের এ পর্যালোচনা।
‘প্রভাতফেরী প্রভাতফেরী
আমায় নেবে সঙ্গে
বাংলা আমার বচন
আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।’
একুশের ভাবগাম্ভীর্যে, বেদনায়, বিপ্লব ও বিষাদে ভরা এই গানটি হতে পারতো একুশের গান। এই গানের ভাষা, উপমা—উৎপ্রেক্ষায় রয়েছে সময়ের অনেক সুন্দর ও সাহসী উচ্চারণ। ৫০-এর অন্যতম শক্তিমান কবি আল মাহমুদ চট্টগ্রামে বসে এটি রচনা করেছিলেন। অনবদ্য কিছু স্তবকও ধারণ করেছে গানটি। হয়তো পরিবেশ কবিকে অনেক সহায়তা দিয়েছে। পাহাড়ী পরিবেশে আগের দিনের অনেক সূর্যসন্তান আত্মগোপনে থেকে জীবন সংগ্রামে জড়িয়েছিলেন।
‘পাহাড়তলীর মরনচূড়ায়/ ঝাপ দিলো যে অগ্নি/ ফেব্রুয়ারীর শোকের বসন/ পড়লো তারই ভগ্নী’।
বিপ্লব ও বিষাদের এমনই এক মেলবন্ধন রয়েছে এ গানে। সম্প্রতি গানটি আবেদনময়ী করে তুলেছেন গুণী শিল্পী প্রতুল মুখোপাধ্যায়। তিনি কোলকাতার মানুষ। তাঁর রচিত ও গীত বিখ্যাত একটি গান ‘আমি বাংলার গান গাই’। এ গানটিও বাংলাদেশের এক প্রতিবাদী শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু গেয়েছিলেন। ৯০-এর দশকের শেষের দিকে শিল্পী বাবু গানটিকে জনপ্রিয়তার অন্য এক মাত্রায় নিয়ে আসেন। শিল্পী প্রতুলের কণ্ঠে গানটি একটু নমনীয়, নোরম ও মমতায় পরিবেশিত হয়েছিলো। শিল্পী মাহমুদুজ্জামান বাবু তাঁর দরাজ কণ্ঠে ভিন্নতা আনেন। স্বরে আনেন বিপ্লব ও দেশাত্মবোধ।
শিল্পী প্রতুল আল মাহমুদের একুশের কবিতাটির সুরে এনেছেন গাম্ভীর্য, বিপ্লব ও বিষাদ। অবশ্য এ কবিতার ধরণও এমনই যে, যে কেউ এর ভেতর প্রকৃত একুশের মর্ম ও অতীত ইতিহাসের সংকেত খুঁজে পাবেন।
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে
ছড়াও ফুলের বন্যা
বিষাদগীতি গাইছে পথে
তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে নাকি সোনার ছেলে
ক্ষুধিরামকে চিনতে
রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো সে
মুক্তবাতাস কিনতে।
কবিতাটির এই স্তবকে কবি বিপ্লবী মানুষদের ধারণ করেছেন। একই সঙ্গে ‘বিষাদগীতি গাইছে পথে তিতুমীরের কন্যা’ এ চরণটি একমর্মবেদী রোদন ছড়িয়ে দিয়েছে।
৫২ সালের প্রথম দিকে একুশের যে গানটি গীত হয়েছিলো সে গানেও ছিলো একই আওয়াজ ও স্বর। একুশের প্রথম গান রচনা করেন ভাষাসৈনিক আ ন ম গাজীউল হক। প্রথম চরণ ‘ভুলব না, ভুলব না, একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’। সে সময়ে গানটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিলো। ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণে পাওয়া যায়, পথেঘাটে মানুষের মুখে মুখে গানটি ছড়িয়ে পড়েছিলো। প্রকৃত অর্থে গণসঙ্গীতের মর্যাদা পায় গানটি। সময়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও ক্রোধ ধারণ করেই গানটি জনপ্রিয়তা পায়। এটাকেই আমরা বলি একজন শিল্পীর কণ্ঠে বা কলমে যুগযাতনা ওঠে আসা। যুগযাতনাকে স্পর্শ করা।
আমরা এখন যে সময়ে একুশের বচন নিয়ে কথা বলছি, এটি বাংলার একটি অন্ধকার সময়। তথাকথিত প্রগতিবাদীদের হাতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পের বীজ বপন হচ্ছে এখন। বিগত ৫০ বছরে একটি কৃত্রিম সাংস্কৃতিক বলয়ে বেড়ে ওঠা তথাকথিত মুক্তচর্চা বাংলাকে এই পর্যায়ে এনেছে। ঠেসে দিয়েছে এক অন্ধকার বলয়ে। ভাষা চর্চায় প্রকৃত অর্থে জাতির কোনো দিকদর্শন নেই। জাতীয়তাবাদের উল্লোম্ফনায় রয়েছে বর্ণবাদী আচরণ। রয়েছে বিভাজনের স্পষ্ট ক্রিয়াকলাপ। রক্তশূন্যতার সাংস্কৃতিক চর্চা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
মাফিয়াবান্ধব সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে আমাদের জন্য কোনো মুক্তি নেই। একুশের বচন এখন যে রক্তশূন্যতায় ভোগছে তা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।