‘বিষক্রিয়ায়’ এরশাদ ও বাবলুর মৃত্যু
সাবেক রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিবের চাহুল্যকর তথ্য প্রকাশ
খালেদা জিয়ার উপরও বিষপ্রোয়োগের অভিযোগ
বিদেশে খালেদাকে পাঠাতে আপত্তির এটাই কি কারণ?
।। আরিক শামস ও হাসনাত খান ।।
লণ্ডন, ১৩ অক্টোবর : সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের একান্ত সচিব সম্প্রতি বিদেশে কোনো অবস্থান থেকে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। এরশাদ ও জাপা মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু এবং অপর বিশ্বস্ত সহকারী মেজর (অব) খালেদ এই তিনজনের রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু অথবা খুনের অভিযোগ তদন্ত সাপেক্ষ। ফরেনসিক পরীক্ষা এবং বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবী উঠছে বিভিন্ন পর্যায়ে।ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
এদিকে, এরশাদের সঙ্গে এব্যাপারে কথোপকথনের অনেক রেকর্ডিং রয়েছে, যা এখন প্রকাশের অপেক্ষায়। এইসব প্রমাণ এই চাঞ্চল্যকর ও সুনির্দিষ্ট অভিযোগকে প্রমানের ক্ষেত্রে সাহায্য করবে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। এদিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া’র চিকিৎসকরা সম্প্রতি বলেছিলেন, জেলে তাঁকে অতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগ করা হয়েছে। ওই অতিরিক্ত ওষুধেই তাঁর লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। লিভারের সমস্যা অতীতে তাঁর কখনো ছিল না। নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, এই অতিরিক্ত ওষুধ কি কি হতে পারে তা পরীক্ষার মাধ্যমেই প্রকাশিত হবে। এইসব পরীক্ষা দেশের সম্ভব নয়। বিদেশের সম্ভব। কোন সুনির্দিষ্ট ওষুধের নাম উল্লেখ না করে তিনি এস্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের কথাও ইঙ্গিত করেছেন। স্টেরয়েড জাতীয় শুধুমাত্র ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। অন্য রোগীকে তা দেওয়া হলে রোগীর অঙ্গহানি অথবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদাকে পাঠাতে সরকারী আপত্তির এটাই কারণ কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তাঁর অত্যন্ত বিশ্বস্ত একান্ত সচিব মনজুরুল ইসলাম। পরীক্ষাগারে আলামত পরীক্ষা করার পর এই হত্যাকান্ডের প্রমাণ মিলবে বলেও তিনি ধারনা প্রকাশ করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত খবরে এ তথ্য জানানো হয়। একসময় দোর্দণ্ড প্রতাপের অধিকারী সামরিক শাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এবং দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেও প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতা এবং ভোটের রাজনীতিতে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে পেরেছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, উভয়েই নানা সময় তাঁকে নিয়ে টানাটানি করেছে। তবে ২০১৩ সালের পর থেকে মৃত্যু অবধি তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দ্বারা যেভাবে টানা-হ্যাচরার শিকার হয়েছিলেন এবং তাঁর শেষ দিনগুলোকে তিনি যেভাবে অসহায় অবস্থার শিকার হয়েছিলেন এবং নিজ মুখে যা স্বীকার করেছিলেন তাতে করে অতীত পাপ মোচনের মত অনেকেই তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল সম্পন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাই পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে এরশাদ সৃষ্ট জাতীয় পার্টি ততই প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এবং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন স্বয়ং প্রয়াত এরশাদও।
হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের একসময়ের বিশ্বস্ত একান্ত সচিব অভিযোগ করেছেন যে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতাসীনদের বেধে দেওয়া সীমার বাইরে বারবার আসা যাওয়া করার কারণে একসময় তাদের আস্থা হারান এবং একপর্যায়ে তাঁর প্রতি কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুজাতা সিংহের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারের পর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ভারতীয় চাপের কথা তিনি প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের বলে দিয়েছিলেন। এরপরপরই সরকারের একটি দল তাকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে বন্দি করে। যেখান থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আর মুক্তি পাননি। এমন কি নির্বাচনে না দাঁড়ালেও তাকে গুলশান আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয় আর তাঁর পরিবর্তে স্ত্রী রওশন এরশাদ, যিনি সরকারের সাথে হাত মিলিয়ে ছিলেন, তাকে জাতীয় পার্টি সংসদীয় দলের নেতা ও বিরোধী দলের নেতার মর্যাদা দেয়া হয়। ফলে নিজ পাটি এমনকি পরিবারের ওপর তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারান। মৃত্যু পর্যন্ত এরশাদ আর সে নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাননি এবং নিদারুন অবহেলার শিকার হয়ে তিনি অত্যন্ত অমর্যাদাকরভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হন। এরশাদের একান্ত সচিব মনজুরুল ইসলামের অভিযোগ সত্য হলে সিএমএইচে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এরশাদকে স্লো পয়জনিং করা হয় যার পরিণতিতে পরবর্তীতে তিনি আর কখনো পূর্ণমাত্রায় সুস্থ হননি।
হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের মৃত্যু তাঁর একসময়ের বন্ধু প্যালেস্টাইনিদের মহান নেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় যিনি ২০১৪ সালে ফ্রান্সের সামরিক হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আরাফাতের এ মৃত্যু নিয়ে তখন থেকে গুঞ্জন চলে আসছে। অনেকের সন্দেহ, তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়। এই সন্দেহের জের ধরে সুইজারল্যান্ডের পরীক্ষাগারে আরাফাতের ব্যবহূত কিছু জিনিস নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। ফলাফলে পলোনিয়াম বলে একধরনের বিষাক্ত পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে গবেষকদের ভাষ্যে জানানো হয়। সুইজারল্যান্ডের দ্য লসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রেডিয়েশনের প্রধান ফ্রাঙ্কোয়েস বোচাড দাবি করেন, আরাফাতের ব্যবহার করা ওই সময়কার জিনিসপত্র থেকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, তাঁকে পলোনিয়াম বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, ‘তাঁর ব্যবহার করা জিনিসপত্রে আমরা পলোনিয়াম পেয়েছি।’
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যারা ক্ষমতাসীনদের প্রতি অলঙ্ঘনীয় চ্যালেন্জ ছুঁড়ে দেন তাদেরকে দৃশ্যপট থেকে সরানোর জন্য পলোনিয়াম বিষ প্রয়োগের ঘটনা নতুন নয়। রাশিয়ার সাবেক গোয়েন্দা ও পরে দেশটির তীব্র সমালোচক বনে যাওয়া আলেকসান্দর লিতভেনেনকোকে হত্যায় পলোনিয়াম ব্যবহার করা হয়েছিল। লন্ডনের একটি হোটেলে তীব্র মাত্রার পলোনিয়ামযুক্ত চা-পানের পর তিনি মারা যান।
৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পতনের পর হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ প্রায় তিন দশক বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর অপরিহার্যতা প্রমাণ করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে ওঠেন। মৃত্যুর আগে তিনি বেশ কয়েক সপ্তাহ ক্যান্টনমেন্টের সামরিক হাসপাতালে চিকিত্সাধীন ছিলেন। সেখানকার কর্মকর্তারা তখন ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অজুহাত দেখিয়ে দেশের একাংশের কাছে জনপ্রিয় এই নেতার মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বা তাঁর শারীরিক অবস্থার কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি। এবং বিস্ময়ের ব্যাপার হল তার দাফন পরবর্তী সমগ্র কাজ সেনাবাহিনীর পূর্ণ তত্ত্বাবধানে ও পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় অনুষ্ঠিত হয় যেখানে পরিবারের সদস্যদের খুব একটা ভূমিকা ছিল না। নির্ধারণ অবহেলা ও নির্যাতনের শিকার এরশাদের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি সরকারের এবং সামরিক কর্তা ব্যক্তিদের হঠাৎ উথলে উঠা দরদ দেখে তখন অনেকের ভ্রু কুঞ্চিত হলেও প্রমাণের অভাবে কেউ কোন মন্তব্য করেননি। তবে তাঁর অসুস্থতার বিষয়টি নিয়ে তখন অনেক গুজব রটেছিল, নানাজনের মুখে নানা রকম কথা ছড়িয়েছিলো।
৮৯ বছর বয়সী এরশাদের মৃত্যুর প্রায় তিন বছর পর তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা দাবি করছেন যে, দেশের জাতীয় নিরাপত্তার দীর্ঘদিনের শত্রুরা তাকে বাগে আনতে না পেরে অবশেষে তাঁকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছেন। সম্প্রতি সাংবাদিক কনক সারোয়ারকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তাঁর একান্ত সচিব মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘‘২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির বনানী কার্যালয়ে দুপুর দুইটার দিকে এরশাদ সাহেব ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে তাঁর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। এই ঘোষণাটা দেওয়ার পরে তিনি তাঁর প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় গেলেন। প্রেসিডেন্ট পার্কের বাসায় যাওয়ার পর ‘ডিজিএফআই’ এর ডিজি আকবর সাহেব এরশাদ স্যারের কাছে আসলেন। আকবর সাহেব এসেই একটা ফোন আমাকে হাতে দিয়ে বললেন, ‘মন্জু সাহেব এখানে একটা সিমকার্ড আছে। এই সিমটা ফোনের ভিতর ঢুকিয়ে ফোনটা একটু স্যারকে রেডি করে দেন। এই ফোনটা ইউজ করবেন স্যার।‘ এরপর ওনারা আলাদাভাবে বৈঠক করলেন এবং বৈঠক শেষে আকবর সাহেব চলে গেলেন। আকবর সাহেব চলে যাওয়ার পর স্যার এসে আমাকে বললেন, ‘বাদ দাও, এই ফোন রেডি করতে হবে না। রাত হয়ে গেছে, তুমি বাসায় যাও’। আমি বাসায় এসে গেটে মাত্র ঢুকেছি এই সময় একজন আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, আপনার স্যারকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। আমি বাসায় ঢুকে টিভিতে ব্রেকিং নিউজ দেখলাম যে, হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ অসুস্থ্য। তাঁকে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিভিন্ন টিভি সংবাদগুলোতে এরকম সংবাদ প্রচার হচ্ছে। সাথে সাথে আমার আর জানতে বাকি থাকলোনা যে ওনাকে সিএমএইচে নিয়ে একরকম বন্দি করে রাখা হয়েছে। কারও সাথে ওনাকে দেখা করারও অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। স্যারকে ফোনও ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছিলো না। এমতাবস্থায় আমরা আর তাঁর কোন খোঁজ খবর পাচ্ছিলাম না। এই ঘটনার পর পরই মধ্যরাতে একটা ঘোষণা আসলো যে, জাতীয় পার্টি রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচনে যাচ্ছে। অর্থাৎ সরকার এরশাদকে জোরপূর্বক সিএমএইচে নিয়ে বন্দি করে রওশন এরশাদের সাথে আঁতাত করেছে। পরে স্যার আমাকে বলেছেন, মাত্র ৩০-৪০ কোটি টাকার বিনিময়ে রওশন জাতীয় পার্টিকে ধ্বংস করে দিলেন। জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দিলেন। জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের কাছে বিক্রি করে দিলেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের আগেও জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের সিদ্বান্ত এরশাদ সাহেব অনেকবার নিয়েছিলেন এবং সে সময়টায় অসুস্থবোধ করার কারণে বার বার তিনি চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যেতে চাচ্ছিলেন। তিনি আশা প্রকাশ করছিলেন যে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে সিঙ্গাপুরে গিয়ে তিনি পার্টি সদস্যদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের ঘোষণা দিবেন, নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিবেন। সরকারের পক্ষ থেকেও ধারণা করা হচ্ছিলো যে, তিনি সিঙ্গাপুরে গেলে সেখান থেকে এধরনের একটি ঘোষণা তিনি দিবেন। নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা তিনি দিবেন। এই ভয় থেকে সরকার তাকে সিঙ্গাপুর যেতে দিচ্ছিলো না। কোনভাবেই সরকারের অনুমতি মিলছিলো না। আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে চিঠি দেওয়ার পরেও অনুমতি পেতে বিলম্ব হচ্ছিলো। এদিকে এরশাদ সাহেব আমাকে বার বার তাগাদা দিচ্ছিলেন টিকিট কনফার্ম করার জন্য। নভেম্বরের ২৫ তারিখে আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি দিয়েছিলাম। তখন এই চিঠিটাকে তারা হোল্ড করে রেখেছিলো। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে তারা এরশাদ সাহেবকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলো। পরবর্তীতে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পরে জানতে পারি যে, এরশাদ সাহেবকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছে। তাঁকে মেরে ফেলার পায়তারা করা হয়েছে। হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের ক্যান্সার ছিলোনা। কিন্তু তাঁকে সিএমএইচ থেকে ক্যান্সারের ওষুধ দেওয়া হয়েছিলো। সিঙ্গাপুরের ডাক্তারদের কাছে যখন আমরা গেলাম তাঁরা হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে পরীক্ষা করে ঢাকায় দেওয়া ডাক্তারদের ওষুধ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। সিএমএইচের কাগজপত্র দেখে তাঁরা তাঁকে আবার পরীক্ষা করলেন। পরীক্ষা শেষে এবারও তাঁরা অবাক হলেন। বললেন, ক্যান্সার না থাকার পরেও ক্যান্সারের ওষুধ দেওয়ার কারণে তাঁর লিভারের প্রায় ৭০% ডেমেজ হয়ে গিয়েছে। আর যদি এক সপ্তাহ পরে ওনাকে আনা হতো, তাহলে ওনাকে বাঁচানো যেতো না। যা শুনে আমরা খুব অবাক হয়ে গেলাম। জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাও দেশের মিডিয়ার কাছে তখন বলেছিলেন যে, ‘ওষুধ যেটা দেয়া হয়েছে সেটা ক্যান্সারে ব্যবহার হয়। সিঙ্গাপুরের ডাক্তাররা বলেছেন যে, ওনার ক্যান্সার হয়নি। সুতরাং এই ওষুধটা দেয়ার কারণেই এটা এভাবে এফেক্ট করেছে।’ কোন অ্যাকশন নিবেন কিনা, সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের দোষ না এটা। দোষটা হচ্ছে ভারতের।’ পরে এই ব্যাপারে আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি নিজেকে সেভ করার জন্য একথা বলেছিলেন বলে আমাকে জানিয়েছিলেন। সিএমএইচের কথা বললে তাঁকে যদি এমপি হতে দেয়া না হয় বা তাঁকে যদি গ্রেফতার করা হয় বা হেনস্থা করা হয়, এই আশঙ্কা থেকেই তিনি ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন। একান্ত সচিব মনজুরুল ইসলাম আরও বলেন, হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের এই ওষুধগুলো মেইনটেইন করতেন ওনার পলিটিক্যাল সেক্রেটারি মেজর (অব:) খালেদ আক্তার। শেখ হাসিনা এরশাদ সাহেবকে একেবারে সুপরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলেছেন। এই কাজটাতে মেজর খালেদ আক্তার তাকে সহযোগিতা করেছেন। এরশাদ সাহেব নিজেও এ নিয়ে মেজর খালেদের ওপর খুব ক্ষিপ্ত ছিলেন। মেজর খালেদ যেনো তাঁর অফিস কিংবা বাসায় আর না আসেন তিনি নিষেধ করে দিয়েছিলেন। এরশাদ মারা যাওয়ার কিছুদিন পর মেজর খালেদ আক্তার করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সিএমএইচে ভর্তি হন এবং চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি রহস্যজনক মৃত্যুবরণ করেন। এই ঘটনার আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষী জিয়া উদ্দিন বাবলু যিনি আমাদের সাথে সিঙ্গাপুরে ছিলেন এবং হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে স্লো পয়জনিং করার ক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা করেছিলেন তিনিও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সিএমএইচে ভর্তি হন এবং রহস্যজনক মৃতুবরণ করেন। মেজর (অব:) খালেদ আক্তার ও জিয়া উদ্দিন বাবলু হোসেইন এরা দু‘জনেই হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে হত্যার ক্ষেত্রে সরকারকে সহযোগিতা করেছেন। হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদকে হত্যার পর শেখ হাসিনা সরকার এভাবে এই দুই গুরুত্বপূর্ণ স্বাক্ষীকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। তা না হলে মেজর খালেদ ও বাবলুর মত সুস্থ সবল মানুষেরা করোনা আক্রান্ত হয়ে সিএমএইচের মত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মারা যাওয়ার কথা না। মেজর খালেদ ও বাবলুর মত সুস্থ সবল মানুষেরা অনেকেই রিকোভার করে ফিরে এসেছেন। কিন্তু তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। আমি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলাম না, পলিটিক্যাল কোন পোস্ট হোল্ড করছিলাম না। সে কারণে সরকার হয়তো আমাকে নোটিশ করেনি। সরকার যদি জেনে যেতো যে আমি সবকিছু জানি তাহলে আমাকেও মেজর খালেদ ও বাবলুর মত শেষ করে দেয়া হতো। আমাকেও তাদের পরিণতি বরণ করতে হতো। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের একান্ত সচিব মনজুরুল ইসলাম আরও বলেন, এরশাদ সাহেব যেকোন সময় যেকোন সিদ্বান্ত নিতে পারেন শেখ হাসিনা সরকার তাঁকে নিয়ে সব সময় এরকম আতঙ্কে থাকতেন এবং এরশাদ সাহেবকে সরকার সব সময় বড় একটা হুমকি মনে করতেন। একারণে বিষ প্রয়োগে তাঁরা তাকে হত্যা করেছেন।‘‘
এই ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে স্লো পয়জনিং করা হয়েছে এবং ধরা পড়ার ভয়ে চিকিৎসার জন্য সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশ যেতে দিচ্ছে না বলে উদ্বিগ্ন জনতা জোর সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
উল্লেখ্য, লিভারে সমস্যার পাশাপাশি রক্তে হিমোগ্লোবিন সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ২০১৯ সালের ২৬ জুন রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) এ ভর্তি হন। ১৪ জুলাই সকাল ৭টা ৪৫ মিনিটে তিনি (সিএমএইচ) এর (আইসিইউ) তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এ প্রসঙ্গে একান্ত সচিব মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘সিএমএইচের আইসিইউতে তিনি ছিলেন। আইসিইউতে থাকা অবস্থায় দু‘দিন কোন খবর পাচ্ছিলাম না। মাঝে মধ্যে গুঞ্জন শুনছিলাম, তিনি মারা গেছেন। এই অবস্থায় আমি ম্যাডাম রওশন এরশাদকে অনুরোধ করেছিলাম যে, স্যারকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে চলেন। সিঙ্গাপুরে নিয়ে ট্রিটমেন্ট করালে হয়তো ওনি সুস্থ হবেন। কিন্তু রওশন এরশাদ তখন স্যারকে বাইরে না নিয়ে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। এই পর্যায়ে মনজুরুল ইসলাম নিজেই প্রশ্ন করেন, ‘রওশন এরশাদ কেনো এই অবস্থান নিয়েছিলেন? তার মানে কি তিনি জানতেন যে, এরশাদ সাহেব অলরেডি মারা গেছেন? নাকি তিনি তাঁর চেয়ারটা রক্ষা করার জন্য বা এরশাদ সাহেব মারা গেলেই তাঁর বিরোধী দলীয় নেতার চেয়ারটা আবারও উদ্বার হয়, এরকম একটা চিন্তা থেকে তিনি বাইরে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেন নাই?’ অনেক জটিল প্রশ্ন। আসলে ক্ষমতার লোভ যে মানুষকে কতোটা নিচে নামাতে পারে বা অমানুষ বানাতে পারে, তা এই ভিডিও সাক্ষাতকারটা না দেখলে কেউই ঠিক উপলব্ধি করতে পারবেন না। যাইহোক, সবশেষে তিনি এরশাদের দেহাবশেষের নমুনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এরশাদ হত্যার বিচার দাবী করেন।