মুদ্রাস্ফীতি: টাকা যেভাবে তেজপাতা হয়
|| সুরমা প্রতিবেদন ||
লণ্ডন, ১১ আগস্ট : বিদেশে সম্পদ পাচার হলে অর্থনীতিতে তার কি প্রভাব পড়ে? অর্থনীতির জটিল এই বিষয় প্রতিদিন প্রতিটি মানুষকে প্রভাবিত করে। কিন্তু সহজভাবে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়না বা বোঝা মুশকিল হয়ে পড়ে। একটি সাধারণ বিশ্লেষণে জটিল বিষয়টি এই রিপোর্টে তুলে ধরা হলো। একজন চার্টার্ড একাউন্টেন্ট বিষয়টি এভাবে ব্যাখ্যা করেন। বাজারে অতিরিক্ত মুদ্রার প্রবাহ মুদ্রাস্ফীতিকে অর্থাৎ জিনিসপত্রের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটিয়ে চলে। একটা উদাহরণ দিলে হয়তো সহজে বোঝা যাবে। ধরা যাক, একটি দেশের সকল সম্পদ মিলিয়ে হলো এককোটি বলপেন। আর বাজারে টাকা আছে এক কোটি। সুতরাং একটি বলপেনের দাম হবে একটাকা। জবাবদিহিতা বিহীন অবস্থায় মাফিয়াদের বিদেশে সম্পদ পাচার ও তার বিপরীতে বিদেশী মুদ্রার পরিবর্তে স্থানীয় মুদ্রার মাধ্যমে হিসাব সমন্বয় (ডলারের গ্রাহককে স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ বা আণ্ডার/ওভার ইনভয়েসের দায় রিজার্ভ থেকে শোধ করে স্থানীয় মুদ্রায় ঋণের একাউন্টে স্থানান্তর) প্রয়োজন। বিদেশী মুদ্রা ফেরত না পাওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় মুদ্রায় অপরিশোধিত অর্থ বা ফেইক ডিজিটে মুদ্রার যোগান কাগজপত্রে দেখতে হবে। এই হিসাবের বিপরীতে চাপতে হবে অতিরিক্ত মুদ্রা (টাকার নোট)। এভাবে সীমিত সম্পদের বিপরীতে অনিয়ন্ত্রিত মুদ্রা বাজারকে নিয়ন্ত্রণ (ডোমিনেট) করতে থাকবে। এইভাবে বাজারে আরো নতুন মুদ্রা ছাড়া হলো দশ কোটি। এখন বাজারে অর্থের প্রবাহ হয়ে গেলো সর্বমোট এগারো কোটি টাকা।
সম্পদ ও মানুষের আয় তো ওইভাবে বাড়েনা। প্রতিবছর গড়ে ছয় শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে ১০ বছরে সম্পদ বাড়ে ৬০ শতাংশ। আর মুদ্রার প্রবাহ বেড়ে গেলো ১০০০%।অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিধারায় ১০ বছর পর ওইবলপেনের দাম হওয়ার কথা একটাকা ষাট পয়সা। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রতিটি বলপেনের দাম হবে এগারো টাকা। ফলে জনসাধারণের পক্ষে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বলপেন অর্থাৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কেনা অসম্ভব হয়ে পড়ে অথবা কষ্টকর হয়ে পড়ে। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্ত মানুষের জন্য এই পরিস্থিতি অসহনীয়। বাজারে খাবার থাকবে কিন্তু তার আয় সীমিত বলে তাকে আধপেটা অথবা অপুষ্টি নিয়েই জীবনযাপন করতে হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে ৯৮% মানুষই এই দুই শ্রেণীর আওতাভুক্ত। সুতরাং, বিদেশে সম্পদ পাচার ও তার বিপরীতে বিপুল ও অসীম মুদ্রার প্রবাহ জনজীবনে দুঃসহ পরিস্থিতি তৈরি করে। ইন্দোনেশিয়া, ভেনেজুয়েলার মতো দেশে এভাবেই এক ডলারের যথাক্রমে ১৪,৭৭৫রুপী,৫৮৫,১৬০ বলিভার।
জিম্বাবুয়ের পরিস্থিতি আরও তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের মাত্র ছয় বছর আগে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া দেশটিতে মুগাবের টানা কতৃত্ববাদী শাসন অর্থনীতিকে পুরো দেউলিয়া করে ফেলে। একসময়ের স্যার উপাধি পাওয়া মুগাবে তার জাতির কাছে দেশের স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে সম্মানিত ছিলেন। কিন্তু চার দশকে তার দুঃশাসন বিপুল সম্পদের অধিকারী জাতিকে বিশ্ব থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। জিম্বাবুয়ের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নাগরিকদের দেশটির প্রায় মূল্যহীন মুদ্রা মার্কিন ডলারে বিনিময় করার অনুমতি দেয়। এর ১০০ ট্রিলিয়ন-ডলারের নোটটির মূল্য মাত্র ৪০ মার্কিন সেন্ট অর্থাৎ এক ডলারের মূল্য ২৫০ ট্রিলিয়ন জিম্বাবুয়ান ডলার। স্থানীয় মুদ্রার মূল্য যখন ১০ বছরে তেজপাতার মতো হয়ে যায় একটি শাসন আমলে, সেখানে পরিস্থিতি সামাল দিতে পরবর্তীতে টাকার মূল্য কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা চিন্তা করতে হলে ২০ ডিজিটের ক্যালকুলেটর (এখন বাজারে আছে সর্বোচ্চ ১৪ ডিজিট) নিয়ে বসেও কূল পাবেন না।