বিএনপি’র ৩ চ্যালেঞ্জ


মুক্তকথা:
।। ডক্টর এম মুজিবুর রহমান ।।
এক:
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি’র যাত্রা শুরু করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান। এর ফলে ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগসহ নিষিদ্ধ হওয়া রাজনৈতিক দলসমূহকে রাজনীতি করার অনুমতি দিয়ে বহুদলীয় রাজনীতি ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু হয়। বিচারব্যবস্থায় স্বাধীনতা ফিরিয়ে বাক স্বাধীনতা নিশ্চিতকল্পে সংবাদপত্রের উপর থেকে প্রত্যাহার করা হয় সকল নিষেধাজ্ঞা । স্বাধীনতা যুদ্বে রণাঙ্গনের বীর উত্তম খ্যাত সশস্র মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন গতি। প্রাজ্ঞ ও দক্ষ লোকদের রাজনীতিতে টেনে এনে নতুনদের দিয়েছিলেন আলোর দিশা । দেশে শুরু হয়েছিল রাজনীতির নতুন বাতাবরণ।
রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতিতে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের জনগনের সামনে তুলে ধরেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন। দেশের ধর্ম-বর্ণ, গোত্র, নৃ-গোষ্ঠী তথা আপামর সকল মানুষকে অভিন্ন প্লাটফরমে এনে দাঁড় করিয়েছিল এই দর্শন । জাতীয় জীবনে – দেশটা কেন? কাদের জন্য? এদেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী? গন্তব্য কী? স্বপ্ন কী? – এর উত্তর তিনি তাঁর রাজনৈতিক দর্শন বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদের মধ্যে সংস্থাপন করেন। ফলে বাংলাদেশ বিভেদ ও হানাহানির বাইরে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি তৈরির জন্য একটা সুনির্দিষ্ট পাটাতন লাভ করে। অনেক বিশ্লষকেরা মনে করেন বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শনে জাতিসত্ত্বার সঠিক স্বরূপটি আবিস্কৃত হয়, যা আমাদের ভৌগলিক জাতিসত্ত্বার সুনির্দিষ্ট পরিচয় দান করে। বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের আত্মপরিচয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদের দর্শন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখারও সাহসী অঙ্গীকার।
অপরদিকে আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে শহীদ জিয়াউর রহমান ১৯ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। যার মধ্যে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টি প্রাধান্য পায়। এ কর্মসূচির মধ্যে অগ্রাধিকার দেয়া হয় জনগণের খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় এবং স্বাস্থ্যখাতকে। তাঁর শাসনকালে সাবলম্বী জাতি গঠনে গ্রামোন্নয়ন ও সামরিক বাহিনীর উন্নয়নের উদ্যোগ নেন। গ্রামোন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি স্বেচ্ছাশ্রমে খাল কাটা কর্মসূচি শুরু হয় । অত্যন্ত স্বল্প সময়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমরনীতি, কৃষি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও নারী-শিশু সবকিছুতেই একটা বিপ্লব ঘটান । অল্প কিছুদিনের শাসনকালেই দেশ অর্থনীতি ও বিশ্ব রাজনীতিতে স্বগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়।
আঞ্চলিক ও বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিশেষ করে মুসলিম গণতান্ত্রিক দেশসমূহের রাজনীতি পর্যালোচনা করলে চার দশক পূর্বে ঘোষিত জিয়াউর রহমানের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বিচক্ষণ রাজনীতির পরিচয় পাওয়া যায় । ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি নিজস্ব সংস্কৃতি এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন জাতি গঠনের রাজনীতির প্রবক্তা জিয়াউর রহমান ।
বিএনপি গত চার দশকে অনেক চড়াই উৎরাই পারি দিয়েছে। উদার গণতন্ত্র সমর্থিত ও মধ্যপন্থী দল হিসেবে বিএনপি আজো দেশে সমাদৃত । সেই ১৯৭৮ সাল থেকে আজ অবধি আপামর মানুষের সমর্থনে এতটুকু চিড় ধরেনি । কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যেও প্রতিটি নেতা-কর্মী জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে অবিচল রয়েছেন। বিএনপি’র বিপুল জনসমর্থন ও জনপ্রিয়তা নিয়ে তার বিরোধীরাও দ্বিমত পোষণ করেন না। জিয়াউর রহমানের জনপ্রিয়তা, মিলিটারি ও সিভিলিয়ানসহ প্রতিটি সেক্টরে তাঁর দূরদর্শী চিন্তা-চেতনা সর্বোপরি তাঁর বিচক্ষণ রাজনীতি দেশ-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে ।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর সহধর্মিণী বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তিন যুগের অধিক বিএনপির হাল ধরে আছেন। বেগম খালেদা জিয়া একমাত্র নেত্রী যিনি বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনে পাঁচটি করে আসন থেকে প্রতিবারই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন । বিশ্লষকেরা মনে করেন খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা আর ভু-রাজনীতির টানাপোড়নে মামলার জালে আটকা তিনি । অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এসময়ের অগ্রপ্রতিক তারেক রহমান চিকিৎসার কারণে লন্ডনে প্রবাসী। এমন পরিস্থিতিতেও দেশের অন্যতম বৃহৎ দল বিএনপি এবং বর্তমান সরকার ও আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এখনো বিএনপিই।
দুই:
বিএনপি’র নীতি- আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা সমকালীন বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট এবং বাস্তবতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ । ইতিহাস স্বাক্ষী, শুধু নেগেটিভ ভোটের উপর দাঁড়িয়ে যুগের পর যুগ কোনো দল এতো জনসমর্থন ধরে রাখতে পারে না। তবে রাজনীতি কোনো স্থির বিষয় নয় বরং রাজনীতি একটি বিজ্ঞানও বটে। সময়ের সাথে বাস্তবতার নিরিখে রাজনীতির গতি প্রকৃতি পরিবর্তিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনীতির গতি প্রকৃতিকে পরিবর্তনের খাতিরে আপামর জনসাধারণের আকাঙ্খার বিপরীতে রাজনীতির গতিকেও স্বাধীনচেতা জনগণ সমর্থন করে না। নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ উগ্রপন্থাকে কখনো সমর্থন করে নাই, আবার অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও পরাজিত হয় নাই। তাই রাজনীতিতে জনগণের পালস (স্পন্দন) বুঝতে নৈপুণ্যতা থাকা চাই ।
প্রয়াত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ মৃত্যুর পূর্বে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘অনেক প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও বিএনপিকে কেউ ভাঙতে পারেনি। দলটি এ দেশে এখনো ক্ষমতার রাজনীতিতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। বিএনপির জন্য এটি অনেক বড় সফলতা। ……জিয়াউর রহমানের আদর্শ থেকে বিএনপি বিচ্যুত হয়েছে —এ কথা না বলে কখনো কখনো হোঁচট খেয়েছে বলা যায়।’ জিয়াউর রহমান ও তাঁর হাতে গড়া দল বিএনপি’র জনপ্রিয়তাই আজো শাসক কূলের মাথা ব্যাথার মূল কারণ এবং দেশ-বিদেশে শক্তিশালী বিএনপি বিরোধী প্রপাগান্ডা মেশিনারি কাজ করছে তাও অসত্য নয় ।
তবে বর্তমান বিশ্বে জনপ্রিয়তার শীর্ষে থেকেও রাষ্ট্র ক্ষমতার বাইরে রয়েছে, তা সম্ভবত প্রগতিশীল মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলের মধ্যে শুধু বিএনপির ক্ষেত্রেই দেখা যায় । এর কারণও নিশ্চয় বিএনপিকে খোঁজে বের করতে হবে। এছাড়া দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিকভাবে কিছু ফ্যাক্টর একটি রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে অথবা ঠিকে থাকতে সহায়কের ভূমিকা পালন করে থাকে। সেদিকেও বিএনপিকে আরো নজর দেয়ার তাগিদ রয়েছে বলে মনে করেন অনেকে । বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য যে, আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তি কারো কাছেই আজ বাংলাদেশে গণতন্ত্র বা সুষ্ঠূ নির্বাচন অনুষ্ঠান কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। পরিণাম চিন্তা না করে বাংলাদেশকে তাদের বৃহত্তর স্বার্থে ব্যবহার করছে ও করতে চায়। এটাও সত্য যে, আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যখন নিজেদের ক্ষমতা বৃদ্ধির লড়াইয়ে মগ্ন থাকে, তখন গণতন্ত্র, মানবিক অধিকার, আইনের শাসনের মতো মৌলিক বিষয়গুলো গৌণ হয়ে পরে।
রাজনীতির প্রতিকূল পরিবেশ ও আন্তর্জাতিক কূটচালের বিপরীতে গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন অধিকার ও সু-শাসন প্রতিষ্ঠায় জনগণের আস্থা অর্জন। বাকসর্বস্ব রাজনীতির বিপরীতে মেধা নির্ভর রাজনীতির চর্চা এবং দেশপ্রেমের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে গণমুখী কর্মসূচির মাধ্যমে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হয়। জনআস্থা করতে পারে তাদের অনুপ্রাণিত এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় উজ্জীবিত । জনসমর্থনকে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে দরকার সময়কে ধারণ করে দেশপ্রেমিক দক্ষ কর্মী বাহিনী গঠন । রাজনীতির বৈরী পরিবেশ উত্তরণের এটাই একমাত্র রাস্তা। অতীত ইতিহাস ঘাটলে এর অজস্র উদাহরণ পাওয়া যায়।
দেশের বিভিন্ন সেক্টরে বিএনপির অসংখ্য শুভাকাঙ্খী ও গুণগ্রাহী রয়েছেন। কিন্তু এদের সবাইকে সংগঠিত করতে যে বুদ্বিদীপ্ত রাজনীতি প্রয়োজন তাতে ঘাটতি রয়েছে বলে অনেকের ধারণা । বুদ্বিভিত্তিক সমাজ ও মিডিয়া জগতে আজো বিএনপি নিয়ে অনেকের হীনমন্যতা কাজ করে বলে মনে হয়। রাজনীতিতে সাধারণ উপলব্দি (পার্সেপশন) একটা বিরাট ফ্যাক্টর। পার্সেপশন ভুল হতে পারে। কিন্তু পাবলিক পার্সেপশন যদি তৈরী হয়ে যায় তখন গুনগত পরিবর্তন সাধনে রাজনীতির দায়িত্ব হলো সেই পার্সেপশনকে এড্রেস করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
তিন:
দেশ-বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনসমূহের প্রতিবেদন, নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্ট সর্বোপরি দূর্নীতি ও লুটপাটের সামগ্রিক অবস্থা দেশে জবাবদীহিতাবিহীন শাসনের ফল বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা । আজ্ঞাবহ গণমাধ্যম ও নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি, মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার অন্তরায় । বিরোধী মতের সবাইকে শত্রূজ্ঞান ভেবে রাষ্ট্রযন্ত্রের শক্তি, দলীয় ক্যাডার ও স্বশস্ত্র পেটুয়া বাহিনী দিয়ে দমিয়ে রাখার অভিযোগ উঠছে। গুম, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার মানুষদের চাপা ক্ষোভ ও কান্নার আর্তনাদ ভাসছে বাতাসে । পুরো জাতিকে দাবিয়ে রাখতে ভয়ের আবহ তৈরী করা হয়েছে । আর এতে রসদ যোগাচ্ছে দেশীয় উচ্ছিষ্টভোগী ও আধিপত্যবাদী শক্তি। কিন্তু সংঘটিত শক্তি হিসেবে রাজনীতির দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের মধ্যকার এই ভয়ের সংস্কৃতি দূর করা। এই পথ যে কুসুম বিস্মৃত ও মসৃণ নয় তা বোধকরি সকলের অজানা নয় ।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, দেশের রাজনৈতিক বৈরী পরিবেশ উত্তরণের কৌশল বিরোধীদেরই বের করতে হয় । শুধু কমিটি কেন্দ্রিক দায়সারা রাজনীতি দুঃশাসনের বিকল্প হতে পারে না। দেশপ্রেমিক প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী ও মেধানির্ভর রাজনীতি ব্যতিরেকে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে অর্থনীতি ও সমরনীতিতে ঠিকে থাকা দুরূহ। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপি যদি রাষ্ট্র ও সমাজে আইনের শাসন, জবাবদিহিতা ও গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠানিকরণে সময়কে ধারণ করে নিজেদের নেতা-কর্মীদের তৈরী করে তখন রাজনৈতিক ময়দানে ঠিক থাকার জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলেও এই প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। তখন রাজনীতির গুনগত মান নিয়ে দেশের জনগণ তুলনা করার সুযোগ পাবে । দুঃশাসনের বিপরীতে জনসমর্থন তখন জনশক্তিতে পরিণত হতে বাধ্য। আর তখনই জনগণ পেতে পারে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্রের সুবাতাস । রাষ্ট্র পেতে পারে একটি সুশাসন পদ্বতি, সমৃদ্বশালী অর্থনীতি এবং আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন অগ্রসর জাতি।
রাজনীতির অংকে হিসেব নিকেশের পরেও অনেক কৌশলী সিদ্ধান্ত হয়তো পরবর্তীতে ভুল হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে। তবে এর থেকে শিক্ষা নেয়া দোষের কিছু নয়। তাই অতীতের সিদ্ধান্তসমূহের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে জাতির সামনে আগামীর পরিকল্পনা উপস্থাপন জরুরি। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন সেক্টরকে কিভাবে শোধরানো হবে তার পরিষ্কার ধারণা ও স্বচ্ছ রোডম্যাপ থাকা চাই। ক্ষমতাসীন সরকারের অব্যবস্থাপনার বিপরীতে প্রকৃত সমস্যা নিরূপণ করে তার সমাধানে বাস্তবধর্মী কর্মপন্থা জনগণের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন ।
বিএনপির অনেক সীমাবদ্বতার মধ্যেও এ কথা স্বীকার করতে হবে যে, বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া’র জাতীয় ঐক্যের আহবানে দেশের সর্বস্তরে বিশেষ করে সরকার বিরোধী শিবিরে একটা সাড়া জাগিয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান সম্প্রতি করোনার সময়ে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতিতে দিতে পারে নতুন মাত্রা । আঞ্চলিক ও বিশ্ব ভু রাজনীতির ঢামাঢোলে একটি সুষ্ঠূ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্টানিক রূপ দিতে জাতীয় ঐক্য আজ খুবই প্রয়োজন । এই ঐক্য শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক নয়, হতে হবে আইনের শাসন ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে দেশ গঠনেও।
বিগত নির্বাচনের আগে গড়া নির্বাচনী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপির পুরনো মিত্র ২০ দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সমন্বয় অক্ষুন্ন রেখে সামনে চলাকেও বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন অনেকে । নিজেদের অস্তিত্ব এবং নতুন প্রজন্মের জন্য নিরাপদ ভবিষ্যতের স্বার্থে রাষ্ট্র ও সমাজে আইনের শাসন, জবাবদিহিতা এবং রাজনীতিতে সহনশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে আবেগের ঊর্ধ্বে উঠে প্রয়োজন বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ । দেশের সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমও এর দায় এড়িয়ে থাকতে পারে না। তবে রাজনীতিতে ঠিকে থাকতে হলে দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জন ও সংগঠিত করার নেতৃত্ব বৃহৎ শক্তি হিসেবে বিএনপিকে নিতে হবে।
রাজনীতি সচেতন মানুষ যেমন জানেন তেমনি দেশের সাধারণ জনগণ এমনকি সরকার দলীয় নেতা কর্মীরাও জানেন যে, অবাধ ও সুষ্ঠূ ভোট হলে ফলাফল উল্টো হতে পারে । তবে দেশের বর্তমান বাস্তবতায় ভোটাধিকার প্রয়োগ করে তার ফলাফল ঘরে নিয়ে আসতে হলে যে দক্ষতা, প্রজ্ঞা ও সাহস প্রয়োজন তাতে কোনো ঘাটতি আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার তাগিদ রয়েছে । যে কোনো দেশে শুধু দলীয় নেতাকর্মী ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রশক্তির মদদে গড়ে উঠা স্বশস্ত্র পেটুয়া বাহিনীকে মোকাবেলা করা কষ্টসাধ্য তাতে সন্দেহ নাই । উপরন্তু কোনো দেশের সরকার যদি তাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে অনৈতিক সুবিধাদি প্রদানের মাধ্যমে প্রশাসনসহ বিভিন্ন সেক্টরে সিন্ডিকেট গড়ে তুলে তাহলে এরা নিজেদের স্বার্থেই সরকারের এক্সটেনশন চাইতে পারে। তবে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলন থেকে এটা পরিষ্কার যে, সুশৃঙ্খল নেতৃত্বের মাধ্যমে আগামীর বাংলাদেশের যুগোপোযোগী পরিকল্পনা ও গণমূখী রাজনীতির নিশ্চয়তা, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকরণে রাষ্ট্রের সর্বস্তরে জবাবদিহীতা, দূর্নীতিমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা বিনির্মাণে আইনের শাসনের দৃশ্যমান অঙ্গীকার থাকলে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তির সাথে সাধারণ জনগণ একাত্মতা পোষণ করবে তাতে সন্দেহ নেই । ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় রাজনৈতিক শক্তির সাথে সাধারণ জনগণের শক্তির সম্মিলন ঘটলে অধিকার আদায় সময়ের ব্যাপার মাত্র। অন্যথায় লেন্দুপ দর্জির তাবেদারী ও একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসন মেনে নিতে হয় । আর এতে করে গণতান্ত্রিক রাজনীতি, মিডিয়ার স্বাধীনতা, মানুষের জান মালের নিরাপত্তা সর্বোপরি দেশের সার্বভৌমত্ব ঝুঁকির মধ্যে থাকে ।
উপসংহার:
অর্থ, বিত্ত আর প্রতিপত্তির অসুস্থ প্রতিযোগিতা এবং পাশবিকতার যাঁতাকলে রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্বৃত্তায়ন খামছে ধরেছে রাষ্ট্র, সমাজ ও সভ্যতাকে। একটা জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং স্রোতের প্রতিকূলে হাঁটার জন্য প্রয়োজন দৃঢ় নেতৃত্ব এবং সততা ও যোগ্যতার সমন্বয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীবাহিনী। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ‘কারো সাথে শত্রুতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্ব’ নীতির ভিত্তিতে উন্নয়ন সহযোগী বন্ধুপ্রতিম ও মুসলিম দেশসমূহের সাথে সুসম্পর্ক নিয়েই এগুতে হবে। শত্রু-মিত্রের মধ্যের পার্থক্য নিরূপণ করে কূটনীতি থাকা চাই । কারো দয়া ও করুণার উপর ভর করে আর যাই হোক জাতি গঠনের রাজনীতি হয় না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক, বলয়ভিত্তিক এবং নিজস্ব প্রাপ্তির সুবিধাবাদী রাজনীতির উর্ধে উঠে জনকল্যাণমুখী, দুর্নীতিমুক্ত, আত্মমর্যাদাশীল দেশ ও জাতি গঠনের রাজনীতির ধারাকে জনগণের দাড়গোড়ায় নিয়ে যেতে পারলে অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্বে সর্বাত্মক গণআন্দোলন গড়ে তুলা দুরূহ হওয়ার কথা নয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বৈরী রাজনৈতিক পরিবেশউত্তরণে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়, সময়কে ধারণ করে দক্ষকর্মী গঠনের মাধ্যমে জনগণকে আস্থায় আনতে বিএনপির গঠনমূলকও কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন । দেশপ্রেমিক, দক্ষ, সাহসী ওমেধানির্ভর কর্মী গঠনের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠানিকরণ, জবাবদীহিতা ও আইনের শাসন এবং মুক্তিযুদ্বের অঙ্গীকার সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার শপথ হোক বিএনপি’র ৪২তমবার্ষিকীর দৃপ্ত উচ্চারণ ।
লণ্ডন ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০।