পাপিয়া-সম্রাটদের রূপকথা, বীর শ্রেষ্ঠ-ভাষা শহীদ বিভ্রান্তি এবং এক দুই তারকা জেনারেলের গল্প!

সময়-অসময়
।। শাহ আলম ফারুক ।।

রূপকথা হার মানিয়ে যাচ্ছে। একালের বিল গেটস, স্টিভ জবস কিংবা আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস কারো সাথেই যেন মিলছে না।ছয় হাজার টাকার বাসায় যে ছয় বছর আগেও থাকত। ধার দেনা করে সংসার চালাত। আজ তার নাকি ঢাকা শহরেই ছয়টি বাড়ি। নগদ টাকা, দেশে বিদেশে সম্পদ। একটি মফ:সল শহরের পৌর মেয়রও নাকি হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এর আগে যুবলীগ নেতা টেন্ডার কিং জি কে শামীম, ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগ সভাপতি ক্যাসিনো সম্রাট খ্যাত ইসমাইল সম্রাট, একই শাখার তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ধরা পড়লে যুবলীগ কেন্দ্রিক নব্য ধনকুবেরদের ‘ক্যাসিনো’ জুয়া, মাদক ব্যবসা , চাঁদাবাজি, টেন্ডার দখলের বাণিজ্যসহ নানা অপকর্ম উন্মোচিত হয়েছিল। টাকার বস্তা নিয়ে সম্রাট নাকি সিংগাপুর যেতেন ক্যাসিনো খেলতে আরো কত কী! গত শনিবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানন্দর থেকে স্বামী-সহযোগীসহ RAB এর হাতে গ্রেফতার হন শামীমা নূর পাপিয়া, যুব মহিলা লীগের নেত্রী। নরসিংদী জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক। এই যুব মহিলা লীগ নেত্রীর ভয়ংকর অন্ধকার জগত যেন বাকি সবাইকে বিভৎসতা বর্বরতায় ছাড়িয়ে গেছে।
এটা সবার জানা হয়ে গেছে- পাপিয়া গত তিন মাসে প্রায় ৩ কোটি টাকার বিল পরিশোধ করেছেন হোটেল কর্তৃপক্ষকে। এখন পর্যন্ত যা জানা যাচ্ছে তার মূল সোর্স RAB এর প্রেস ব্রিফিং। এর বাইরে অনুসন্ধানী সে রকম কোন প্রতিবেদন চোখে পড়েনি এখনো। নানা ফর্মের য়্যুটুভার আর অনলাইন আবর্জনাগুলো ঘুরে ফিরে সেই RAB এর কথাগুলোকেই চমকের মত করে প্রচার করছে। দেখা যাচ্ছে সাংবাদিকতার ভেতর বাইরের এই কঠিন সময়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন সাধারণভাবে আজকাল বিরল। সে যাক RAB-১ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুলের দেয়া তথ্যমতে, ২০১৯ সালের নভেম্বরে হোটেল ওয়েস্টিনের ২১ তলার প্রেসিডেন্ট স্যুইটটি ভাড়া নেন পাপিয়া। গত তিন মাসে ওই কক্ষের ভাড়া পরিশোধ করেছেন প্রায় ৮৮ লাখ টাকা। ১৯ তলায় একটি বার রয়েছে, যেটি তিনি পুরোটাই বুক করে নিতেন। সেখানে প্রতিদিন তিনি আড়াই লাখ টাকা মদের বিল পরিশোধ করতেন। সব মিলিয়ে দেখা যায় ৩ মাসে হোটেল বিল প্রায় ৩ কোটি টাকা।
সে যা বলছিলাম। মিডিয়ায় চর্বিত চর্বণের পাশাপাশি পাপিয়ার উত্থানের পেছনে ব্লেইম গেম চলছে। কানাঘুষা চলছে যে দলের যে কেন্দ্রীয় নেত্রী তাকে ২০১৪ সালে পদ পাইয়ে দেন এবং পরবর্তীতে গত ৬ বছরে পাপিয়া তার আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন। এখন সে নেত্রীই তাকে কীট বলছেন! এটা কে না জানে- এই পাপিয়া বা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সম্রাট পাপিয়ারা একদিনে সৃস্টি হয় নি। প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের আনুকুল্যেই ক্ষীণ কায়া সম্রাট পাপিয়ারা অন্ধকারজগতে মেদ বহুল হয়েছে। গত ১১ বছর ধরে বিশেষত: ২০১৪ সালের এক তরফা নির্বাচনের পর থেকে দলের প্রভাবশালীদের কাছে সাধারণ জনগণ, এমনকী দলের সাধারণ কর্মী সমর্থকদের চেয়ে পাপিয়া সম্রাটরা বেশি করে গুরুত্ব পাচ্ছে। জনগণ বা কর্মী সমর্থকদের পছন্দ সমর্থন থেকে উপরে যথাযথ কানেকশনের গুরুত্বই অধিকতর ফলপ্রদ বিবেচিত হচ্ছে। সুস্থ রাজনীতির ন্যূনতম চর্চা থাকলে সব দল মত রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলে একদিকে জনগণের কাছে একধরণের জবাবদিহিতা থাকে অন্যদিকে দলের সাধারণ নেতা কর্মীদেরও গুরুত্ব থাকে। সেদিন এক সরকার দলীয় ব্যারিস্টার বন্ধু বললেন- গত ডিসেম্বরের ভোটের পর থেকে প্রশাসনের লোকেরাই এখন দেশ চালাচ্ছেন। তার মতে সুস্ঠু ভোট বা রাজনীতি থাকলে মাঠে রাজনীতি থাকলে এমন হোত না। প্রশাসন রাতে ভোট দিয়ে সরকার বানালে এমপি মন্ত্রীর তো দলের লোকদের পাত্তা না দিলে চলে। এ অবস্থা দেশের জন্য, রাজনীতির জন্য মারাত্মক পরিণতি নিয়ে আসতে পারে বলে ব্যারিস্টার বন্ধুটির ধারণা। তাঁর ধারণা যে যথেস্ট যুক্তিসংগত তা নিয়ে দল নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের মধ্যে সন্দেহ নেই, এটা বলাই যায়।
বছর দুয়েক আগে এক লেখায় বলছিলাম- নতুন প্রজন্মকে সত্য মিথ্যা শেখানোর নামে কতগুলো হাইব্রিড প্রজন্ম হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। আজকের এই হাইব্রিড নেশন তৈরিতে ৭২ এর পর থেকে কম বেশী সব সরকারের বিশাল অবদান, তবে বর্তমানের শেখ হাসিনার সরকারের অবদান সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। যার সার্থক ও অপ্রত্যাশিত পরিণতি দেখা গেছে এবারের একুশের অনুষ্ঠানমালায়। সকাল সন্ধ্যা যখন ইতিহাস ইতিহাস করে মুখে ফেনা উঠছে, দলীয় বৃত্তে সব ঐতিহাসিক অর্জনকে কুক্ষিগত করার জন্য যখন আইনও করা হয়ে গেছে, তখন জাতি যা দেখল তাতে বিস্মিত হবার মতই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও সংগীত বিভাগ, ঢাকার অন্যতম সেরা স্কুল সেন্ট গ্রেগরী এবং ডিএমপি’র একুশের ব্যানারে সাত বীর শ্রেষ্ঠের ছবি অংকিত হলো ভাষা শহীদ হিসেবে! বিগত বছরগুলোতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় গুলো অনিয়মের সব রেকর্ড ভংগ করেছে। শিক্ষক নিয়োগের অনিয়ম নিয়ে রীট করার অপরাধে দলীয় সন্ত্রাসী ক্যাডারের মত আচরণ করে এক অধ্যাপককে ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিয়েছে তাঁরই সহকর্মী শিক্ষক। ভিসি নিজের সন্তান ও আত্নীয়দের প্রকাশ্য অনিয়মের মাধ্যমে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি শুধু জয় বাংলাই বলছেন না সাথে শ্লোগান দিচ্ছেন জয় হিন্দ, গোপনে না প্রকাশ্যে এক অনুষ্ঠানে। শোভন রাব্বানীকে সরানো হলেও চাঁদা ও নানা অনিয়মের মূল হোতা জাবি ভিসিকে দলীয় বিবেচনায় কোন ব্যবস্থার শিকার হতে হয়নি। একইভাবে রোকেয়ার ভিসি ঢাকায় থেকে এক অদ্ভুত নিয়মে সার্বৎক্ষণিক স্টেশনে থাকার চাকুরিতে টিকে আছেন। যদিও কথায় কথায় হুংকার কিন্তু থেমে নেই – অনিয়ম দুর্নীতি যেই করুক কাউকে ছাড়া হবে না। বাস্তবে শুধু ছাড়াই হচ্ছে না বরং অনিয়ম দুর্নীতি কে রসদ যুগিয়ে মোটা তাজা করা হচ্ছে।
সবচে
ভয়ংকর যে রিপোর্টটি প্রকাশ করেছে সুইডেনভিত্তিক একটি অনলাইন পোর্টাল তার
শিরোনাম হচ্ছে ‘ক্যাসিনো জেনারেল’। রিপোর্টে দেখা গেল বিজিবির মহাপরিচালক
মে: জে: শাফিন উদ্দিনের ঘাড়ে হাত রেখে রসিকতা করছে জেলে অন্তরীণ এক
চিহ্নিত ক্যাসিনো কারবারী সন্ত্রাসী। বাহিনীর অভ্যন্তরীণ সোর্সের দেয়া
তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ঐ সন্ত্রাসী চোরাকারবারী
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিজিবি ঘাটিতে সিনিয়র অফিসারদের সাথে ছবিতে বেশ
দাপুটে ভাব নিয়ে আছে। একবার দেশের প্রমাণিত শীর্ষ সন্ত্রাসীর ভাইকে
নজিরবিহীনভাবে সেনা প্রধান করা হল, এবার দেখা গেল সন্ত্রাসী চোরাচালানী
ক্যাসিনো বেপারীর বন্ধু দেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তি।
রিপোর্ট ছাপা হবার অন্তত: সপ্তাহ খানেক পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন তিনি
বিজিবি প্রধানের সাথে এ নিয়ে কথা বলবেন। রাস্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং জাতীয়
সেনাবাহিনীর সাথে সংশ্লিষ্ট এমন বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত হবে না, এটা
মনে হয় কোন ফেইলড স্টেটেও চিন্তা করা যাবে না।
সবকিছু
ছাপিয়ে যেটা সত্য ব্যাংকগুলোর ঋণ জালিয়াতি কান্ড, ক্যাসিনো
কান্ড,পাপিয়া কান্ড, ধর্ষণ কান্ড, সরকারী কর্মকর্তা ও দলীয় লোকজনের
বাড়িতে কোটি কোটি নগদ টাকার ভান্ডার, পুলিশ কর্তৃক নাগরিকের নিত্য হয়রানি
এসবই যেনতেনভাবে অগণতান্ত্রিক সরকার দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতা ধরে রাখার
ফলাফল ছাড়া আর কিছু নয়।
এদিকে দিল্লিতে বিতর্কিত নাগরিক আইনের সূত্র ধরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ঢাকায়ও বেশ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে গুজরাটে যা করেছে দিল্লিতেও সেই মোদীর প্রশাসন তাই করে যাচ্ছে। মুজিববর্ষের জাতীয় উদযাপনের অনুষ্ঠানে গুজরাটের খুনি খ্যাত এই মোদীকে মূল বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ নিয়ে ছাত্র সমাজ সহ সাধারণ শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষরা প্রতিবাদ করছে। বলা হচ্ছে আগামী মাসে মোদীকে ছাত্র জনতা ঢাকায় আসতে দেবে না। ভারতের সাথে দৃশ্যত: এবং মূলত: অসম চুক্তি নিয়ে এক আবরারের ফেইসবুকে বুদ্ধিদীপ্ত স্ট্যাটাস তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়েছে, এবার মোদী ঠেকানোর প্রতিবাদে ক্ষমতাসীনদের কেমন প্রতিক্রিয়া হয় তাই দেখার বিষয়।