‘এতিমের চামড়াও খেয়ে নে’

|| ফরীদ আহমদ রেজা ||
গরু ও খাসি মিলিয়ে কুরবানী উপলক্ষে জবাইকৃত ৯০০টি পশুর চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলার সাহস যারা দেখিয়েছেন তাদের অভিবাদন। অভিবাদন আমার নিজ গ্রাম সৈয়দপুরের সম্মানিত আলেম সমাজ ও সাহসী জনতাকে। ১৪ আগষ্ট জনকণ্ঠে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, প্রতিবছরের মতো এবারও ঈদুল আজহার সময় ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম থেকে জবাইকৃত পশুর চামড়া সৈয়দপুর হোসাইনিয়া হাফিজিয়া আরাবিয়া দারুল হাদিস মাদরাসার পক্ষে থেকে সংগ্রহ করা হয়। কুরবানীদাতা বিভিন্ন ব্যক্তি মাদরাসার উন্নয়ন তহবিলে চামড়াগুলো দান করেন। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ চামড়া বিক্রয়ের জন্য দিনভর অপেক্ষা করেও বিক্রি করতে পারেননি। তাদের সংগৃহীত চামড়া ক্রয় করার জন্যে এবার অন্যান্য বছরের মতো শহর থেকে কোনো ক্রেতা আসেনি। নিরূপায় হয়ে ১৪ আগস্ট বিকেল ৩টার দিকে তারা সকল চামড়া মাদরাসার নিকটস্থ এলাকায় মাটিতে পুঁতে ফেলেন।
মাদরাসার মুহতামিম হাফেজ মাওলানা সৈয়দ ফখরুল ইসলামের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ঈদের দিন মাদরাসার পক্ষ থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করা হয়। গরুর ৮০০টি ও ছাগলের ১০০ টি চামড়া সংগৃহীত হয়। কিন্তু এবার চামড়া ক্রয় করতে শহর থেকে কেউ আসেনি। বাধ্য হয়ে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে চামড়াগুলো। তিনি বলেন, চামড়াগুলো সংগ্রহে এবং চামড়ায় লবণ ব্যবহারের জন্যে মাদ্রাসার ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। খবরে আরো বলা হয়, জগন্নাথপুরের বিভিন্ন এলাকার অধিকাংশ কুরবানীদাতা এবার চামড়া বিক্রয় করতে না পেরে মাটিতে পুঁতে রেখেছেন। ৯০০ চামড়া বিক্রি করে সৈয়দপুর মাদ্রাসা কমপক্ষে ৯০০+৩০০ = ২৭০,০০০ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লুটেরা-বান্ধব সমাজ ও সরকারের জন্যে এ বছর বাংলাদেশের হাজার হাজার মানুষ ন্যায্য এ টাকা থেকে থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলে সৈয়দপুরবাসী এলাকার পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষা করেছেন। বিক্রি করতে না পারলে তারা এ চামড়া কোথায় রাখবেন? আশেপাশে চামড়া সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তিন দিন পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করেছেন। আর দেরি করলে চামড়ায় পচন ধরে দুর্গন্ধ ছড়াবে এবং পুরো এলাকাকে অস্বাস্থ্যকর করে তুলবে। এমতাবস্থায় মাটিতে পুঁতে ফেলাই স্বাস্থ্যকর পদক্ষেপে। সৈয়দপুর প্রবাসী অধ্যূষিত একটি এলাকা। চামড়া নষ্ট হওয়ার কারণে এ মাদ্রাসার আর্থিক ক্ষতি হয়তো পুষিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু বাংলাদেশের হাজার হাজার কওমী মাদ্রাসার সর্বত্রই কুরবানী উপলক্ষে সংগৃহীত চামড়া বিক্রি নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। চামড়া বিক্রির টাকা দিয়ে মাদ্রাসাগুলো এতিম ও গরীব ছাত্রদের থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহ করে। তাই এ বছর তারা আর্থিক সঙ্কটে পড়বে।
শরিয়াতের মাকসাদ যারা বুঝে না তারা গরীবের সম্পদ হিসেবে সংগৃহীত চামড়া মাটিচাপা দেয়া নিয়ে ফতোয়াবাজি করতে পারে। তবে শরিয়াতের বিধান আলেম সমাজ ভালোই জানেন। চামড়া মাদ্রাসার হাতে যাওয়ার পর এর মালিক মাদ্রাসা। কারো কোন স¤পদ বা মালামাল জনজীবনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করলে এবং মানুষ বা প্রাণীস¤পদের স্বাস্থ্যের জন্যে হুমকি হয়ে দেখা দিলে এ ব্যাপারে তড়িৎ পদক্ষেপ নেয়া শরিয়াত ও আইনের দৃষ্টিতে তার দায়িত্ব। কোনোকিছু জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলে তা মাটিতে পুঁতে ফেলা-ই উত্তম ব্যবস্থা। সে বিচারে চামড়া মাটিচাপা দিয়ে তারা সঠিক কাজই করেছেন। বিবিসি প্রচারিত সংবাদ থেকে জানা গেছে, ঢাকার বাইরের অনেক মাদরাসা চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মাটিতে পুঁতে ফেলেছে। কোনো এক অদৃশ্য কারণে চামড়ার মূল্য হঠাৎ করে কমে যাওয়ায় ঢাকায় যারা চামড়া বিক্রি করতে পেরেছেন তারা বিক্রির টাকা দিয়ে সংগ্রহ করার খরচ মেটাতে পারবেন না।
সৈয়দপুরের মানুষ চামড়া পুঁতে ফেলার মাধ্যমে লুটেরাবান্ধব সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এর ভাষা শালীন কিন্তু বলিষ্ঠ ও গভীর তাৎপর্যবহ। মানুষ যখন মিছিল করে প্রতিবাদ করতে পারে না তখন অনেক সময় নিজের গায়ে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ করে। যেমনটি আমরা আরব বসন্তের সূচনালগ্নে তিউনিশিয়াতে দেখেছি।
এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে ঢাকার সাংবাদিক পীর হাবিব সা¯প্রতিক এক স্ট্যাটাসে বলেছেন, ‘খা, খা, খেতে থাক। এতিমের চামড়াটাকেও খেয়ে নে! কৃষকের ধান খেয়েছিস, শেয়ার বাজার ব্যাংক লুটেছিস, ভেজাল খাবার ও পন্যে মুনাফা লুটেছিস! লুটে নে। হারামখোররা তোরা সব লুটে নে! ঘুষ দূর্নীতিতো তোদের জন্য পান্তাভাতই। তোদের আর কতো টাকা চাই? বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছিস! দেশে বিদেশে অবৈধ স¤পদ গড়েছিস, গড়ে নে। কাফনের কোনো পকেট থাকেনা জেনেও তোদের রাক্ষুসে ক্ষিধে। তোরাই চোর, তোরাই ডাকাত, তোরাই লুটেরা!’
পীর হাবিব আওয়ামী ঘরানার বঙ্গবন্ধু প্রেমিক সাংবাদিক। দেশে লুটপাটের রমরমা অবস্থা দেখে তাঁকেও এসবের বিরুদ্ধে কথা বলতে হচ্ছে। ব্যাংক লুটপাট, শেয়ার বাজার ধ্বংস, কৃষকের মাথায় বাড়ি, চামড়া শিল্প ধ্বংস, বিদেশে অর্থপাচার ও অন্যান্য লুটপাটের খবর দেশের কারো কী অজানা? কিন্তু কারো মুখে কথা নেই। বিরোধীদল জেলে এবং সাংবাদিকদের মুখে তালা। ডিজিটাল আইনের ভয়ে তারা নিশ্চুপ। ক্রসফায়ার ও গুমের ভয়ে বুদ্ধিজীবীরা নিরব দর্শক।
দেশে বিচারহীনতা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সিন্ডিকেটের লুটপাটের বাইরে ব্যক্তিগত সন্ত্রাস ও লুটপাটও সীমাহীন। ডেঙ্গুজ্বরে হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত, শত শত মানুষ মারা যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিও নেই। দেশে কি কোনো সরকার আছে? আছে অনির্বাচিত অবৈধ সরকার। সরকারের প্রধান লক্ষ্য ক্ষমতায় টিকে থাকা। অবাধ লুটপাটের অধিকার দিয়ে সেটাই তারা নিশ্চিত করছে মাত্র। দেশের মানুষের ভোগান্তি নিয়ে ভাবার মন বা সময় কোনোটাই তাদের নেই।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা কুরবানীর চামড়া সব সময় কিনেন। ২০০-৩০০ টাকা দিয়ে কিনে অনেক উচ্চমূল্যে তারা বিদেশীদের কাছে বিক্রি করেন। এবার ব্যবসায়ীরা তা না কেনার কারণ কি? ফেইসবুকে একজন মন্তব্য করেছেন, এটা কওমী জননীর পক্ষ থেকে কওমী মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্যে ঈদের উপহার। অসম্ভব নয় হয়তো। গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার চাণক্যনীতিও আমাদের জানা আছে। না কি আমাদের ব্যবসায়ীরা চামড়া ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন? আসলে বাংলাদেশের লেদার ফ্যাক্টরির কাছে ব্যবসায়ীরা সংগৃহীত চামড়া বিক্রি করেন না। তাদের আসল খদ্দের বিদেশীরা। দুর্মুখেরা বলে, চামড়া না কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্য কারো কাছে ব্যবসায়ীরা বিক্রি হয়ে গেছেন। বাঙালি দেশপ্রেমের যতই গর্ব করুক না কেনো, কেনা-বেচার বাজারেও তাদের অনেকে সহজলভ্য সামগ্রী। আর ব্যবসায়ীরা সাধারণতঃ লাভ ছাড়া কোথাও পা দেন না। এ বিক্রি হওয়ার কর্মটির সাথে সরকারের কেউ কেটা জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এক সময় ভারত থেকে আমাদের দেশে চোরাই ও বৈধপথে প্রচুর গরু আমদানী হতো। দেশে গরুর ফার্ম বৃদ্ধি এবং দেশীয় গরুর মাংস সুস্বাদু হওয়ার কারণে সে সংখ্যা এখন অনেক হ্রাস পেয়েছে। চামড়া বিক্রয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির নেপথ্যে এ অবস্থার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সংযোগ উড়িয়ে দেয়া যায় না।
আমরা জানি সরকারের নিকট থেকে চামড়া সংরক্ষণ ও সংগ্রহে অব্যবস্থার ব্যাপারে কোনো বিবৃতি আসবে না যদিও এ অব্যবস্থার কারণে ক্ষতির পরিমান কোটি কোটি টাকা এবং ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ। ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে কওমী জননীর লক্ষ লক্ষ সন্তান রয়েছে। চামড়া সংক্রান্ত সমস্যার আসল কারণ কি তা আমাদের জানা নেই। কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিক ভেতরের খবর সংগ্রহ করে বাইরে পাঠিয়ে দিলে বিশ্ববাসী এর আসল রহস্য জানতে পারবে।
লণ্ডন ১৪ আগস্ট ২০১৯