বিগত সরকারের আমলে করা রাজনৈতিক হয়রানি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি
- মামলা প্রত্যাহারে দুটি কমিটি গঠন।
- ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে মামলা প্রত্যাহারে আবেদন।
।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ২৬ সেপ্টেম্বর- সারাদেশে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকারের শাসনামলে দায়ের করা সকল রাজনৈতিক ও নিপীড়নমূলক মামলা দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ সমমনা রাজনৈতিক দল ও দেশের সচেতন জনগণ। আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসন অবসানের পর অর্ধশত দিন পার হয়েছে। এর মাঝে স্বৈরশাসকের দোসরদের অর্থনৈতিক অপরাধ ও মহাদুর্নীতি বন্ধ করা হলেও বাকি সব কাজ শ্লথ গতিতে চলছে। জুলাই-আগস্টের সফল বিপ্লবের পর ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠায় একদিকে যখন আনন্দ-উল্লাসের ফোয়ারা, অন্যদিকে বিগত সরকারের আমলে করা রাজনৈতিক হয়রানি মামলা অর্ধশত দিন পরেও প্রত্যাহার না হওয়ায় ভুক্তভোগী মানুষের মুখে তখন বিষাদের ছায়া।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে মিথ্যা, গায়েবী, হয়রানিমূলক মামলার কারণে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের হাজারো নেতাকর্মী ছিলেন ঘরছাড়া। একজনের নামে শতাধিক মামলা, এমন নেতাকর্মীও অনেক। এসব মিথ্যা মামলার কারণে সরকারি চাকরি হয়নি অনেক শিক্ষার্থীর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, গায়েবি ও মিথ্যা মামলায় যারা এখনো আটক আছেন তাদের মুক্তি দেয়া যেমন জরুরি, তেমনি সকল রাজনৈতিক হয়রানি মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করাও জরুরি। নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হওয়া এক কথা, আর বৈশ্বিক অঙ্গনে দেশের স্বাভাবিক ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনা অন্য কথা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আপন স্বার্থেই সরকারকে দ্রুত উদ্যোগী হতে হবে। দেশের স্বাভাবিক ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট দুটি দুর্নীতি মামলার সাজা মওকুফে মুক্তি পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। হাতে পেয়েছেন তাঁর পাসপোর্ট। দীর্ঘদিন পর হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসায় ফিরেছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এর পর গত ৩ সেপ্টেম্বর মানহানির ৫ মামলা খারিজ করে খালেদা জিয়াকে খালাস দিয়েছেন ঢাকার সিএমএম আদালত। বিভিন্ন বিচারিক আদালতে বিচারাধীন থাকা এমন আরো ৩০ মামলার নিষ্পত্তির জন্য প্রক্রিয়া শুরু করেছে তার আইনজীবীরা। অপরদিকে, ৫ আগষ্টের পর বিএনপির নেতাকর্মীরা এখন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায় রয়েছেন। তাদের প্রত্যাশা, দ্রুততম সময়ে তিনি দেশে ফিরবেন। কয়েকটি মামলা থেকে খালাস পেলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। তার বিরুদ্ধে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলাসহ অর্ধশতাধিক মামলা রয়েছে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এসব মামলা হয়েছে।
আইনজীবী ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা, সহিংসতা, মানহানি ও নাশকতার অভিযোগে ৩৭টি মামলা করা হয়েছিল। এর মধ্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা করা হয়। মামলাগুলোর মধ্যে ২০১৮ সালে দুটি দুর্নীতির মামলায় ১৭ বছরের সাজা হয় খালেদা জিয়ার। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় একটি মামলা খারিজ করেন আদালত। এর মধ্যে সাতটি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। শফিক রেহমান ও মাহমুদুর রহমানের মত সিনিয়র সিটিজেনরা আজও রাজনৈতিক মামলায় ঝুলে আছেন।
এদিকে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কারণে হওয়া হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের লক্ষ্যে দুটি কমিটি গঠন করেছে অন্তবর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। এর মধ্যে একটি জেলা পর্যায়ের কমিটি এবং অন্যটি মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি।
গত রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ–সংক্রান্ত এক প্রজ্ঞাপন জারি করে। সেখানে কমিটি দুটির কাজের ধরন ও কাজের পরিধিও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। প্রজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে জেলা পর্যায়ের কমিটির সভাপতি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করতে হবে। জেলা কমিটির কাছ থেকে সুপারিশপ্রাপ্তির পর সেসব পরীক্ষা–নিরীক্ষা করা এবং প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করা ও মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম গ্রহণ করবে মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি।
বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও অন্যান্য নানা কারণে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও নিরীহ ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে। সেগুলো প্রত্যাহারে সুপারিশের লক্ষ্যে সরকার এই দুটি কমিটি গঠন করেছে বলেও প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
জেলা পর্যায়ের কমিটির সভাপতি হিসেবে থাকবেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, সদস্যসচিব অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সদস্য পুলিশ সুপার (মহানগর এলাকার জন্য পুলিশের একজন ডেপুটি কমিশনার) ও পাবলিক প্রসিকিউটর (মহানগর এলাকার মামলাগুলোর জন্য মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর)।
জেলা পর্যায়ের কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কেও প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে। তা হলো রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের জন্য আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদনপত্র দাখিল করতে হবে। আবেদনের সঙ্গে এজাহার ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যায়িত কপি দাখিল করতে হবে। আবেদনপ্রাপ্তির সাত কর্মদিবসের মধ্যে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দরখাস্তটি জেলার পাবলিক প্রসিকিউটরের (ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটান পাবলিক প্রসিকিউটর) কাছে মতামতের জন্য পাঠাবেন। আবেদনপ্রাপ্তির ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে পাবলিক প্রসিকিউটর (ক্ষেত্রবিশেষে মেট্রোপলিটন পাবলিক প্রসিকিউটর) তাঁর মতামত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর পাঠাবেন। পাবলিক প্রসিকিউটরের মতামত সংগ্রহ করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবেদনটি সাত কার্যদিবসের মধ্যে জেলা কমিটির সভায় উপস্থাপন করবেন।
জেলা কমিটির কাছে যদি মনে হয় মামলাটি রাজনৈতিক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে হয়রানির জন্য করা হয়েছে, তাহলে মামলাটি প্রত্যাহারের জন্য কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ করবে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সেই সুপারিশ, মামলার এজাহার, অভিযোগপত্রসহ আবেদন পাওয়ার ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী তথ্যাদিসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন।
মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটির কার্যপরিধি ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জেলা কমিটির কাছ থেকে সুপারিশপ্রাপ্তির পর মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটি সেগুলো পরীক্ষা–নিরীক্ষা করবে। প্রত্যাহারযোগ্য মামলা চিহ্নিত করে তালিকা প্রস্তুত করবে এবং মামলা প্রত্যাহারের কার্যক্রম গ্রহণ করবে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪–এর আওতাধীন মামলাগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট, ১৯৫৪–এর ১০(৪) ধারার বিধানমতে কমিশনের লিখিত আদেশ ছাড়া প্রত্যাহার করা যায় না। তাই এ ধরনের মামলা চিহ্নিত করে তালিকা তৈরি করতে হবে। এ ধরনের মামলার বিষয়ে করণীয় পরে নির্ধারণ করা হবে।
মন্ত্রণালয় পর্যায়ের কমিটির সভাপতি হিসেবে থাকবেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এবং সদস্যসচিব হবেন জননিরাপত্তা বিভাগের আইন–১ শাখার উপসচিব/জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব/সহকারী সচিব। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন জননিরাপত্তা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব, অতিরিক্ত সচিব (আইন ও শৃঙ্খলা) ও যুগ্ম সচিব (আইন) এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি।