“এই দেশে কোন নির্বাচন হয়নি, একটি অনির্বাচিত সরকার রয়েছে”, মার্কিন দুই কংগ্রেসম্যানকে শহিদুল আলম
- শহিদুল আলম ‘বাংলাদেশের হিরো’, মার্কিন দুই কংগ্রেসম্যান
।। সুরমা প্রতিবেদন।।
লণ্ডন, ১৬ আগস্ট: আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র শিল্পী, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী ড. শহিদুল আলম মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস ও বাংলাদেশ সফররত দুই মার্কিন কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, “এই দেশে নির্বাচন হয়নি, অনির্বাচিত একটা সরকার রয়েছে। তারা যেভাবে দখল করে আছে তাতে বাংলাদেশের মানুষ নিপীড়িত, বাংলাদেশের মানুষ অত্যাচারিত। সেটা নিয়ে আমরা তাদের বলেছি”।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গুলশানস্থ বাসভবনে গত রোববার (১৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, দৈনিক মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান, মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মানবাধিকারকর্মী ও নারীপক্ষের সম্পাদক শিরীন হক, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন, তৃতীয় মাত্রার উপস্থাপক জিল্লুর রহমান, সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুখ ফয়সাল এবং আলোকচিত্র শিল্পী ও লেখক ড. শহিদুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক প্রসঙ্গে শহিদুল আলম বলেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেছেন- “আমরা বাংলাদেশের হিরোদের ডেকেছি। আমরা মনে করি যারা প্রকৃত বাংলাদেশি, বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম করেছে, বাংলাদেশকে ভালোবাসে এবং যারা বাংলাদেশের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদেরকে আমরা সময় দিচ্ছি” । দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে কোনো আলাপ হয়েছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব নিয়ে উপস্থিত প্রত্যেকেই কথা বলেছে। নির্বাচন সম্পর্কে আলাদাভাবে কোন আলাপ না হলেও আমাদের ঘরোয়াভাবে আলাপ হয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে তেমন কোনো আলাপ হয়নি। তিনি বলেন, তারা জানতে চেয়েছে বাংলাদেশের কী অবস্থা, আমরা কীভাবে দেখছি, সেগুলো আমরা যে যার মতো বলেছি। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে শুধু বক্তব্য দিয়েছেন রাষ্ট্রদূত নিজে এবং দু‘জন কংগ্রেসম্যান।
তিনি আরও বলেন, আমি আলাদাভাবে মার্কিন কংগ্রেসম্যানদের কিছু বলিনি। আমি শুধু আমার ব্যক্তিগত পরিস্থিতি কী সেটা উপস্থাপন করেছি। পাঁচ বছর আগে আমার ওপর যে অত্যাচার হয়েছিল সেটা যে আইনে হয়েছিল সেই আইন এখন বিলুপ্ত। এখনো পর্যন্ত ট্রায়াল শুরু হয়নি, চার্জশিট জমা দেওয়া হয়নি তারপরেও আমি প্রতিমাসে কোর্টে হাজিরা দিচ্ছি। এটা আইনগতভাবে অন্যায়। এক অর্থে অনেক বড় হয়রানি কিন্তু তারপরও হচ্ছে। আমাকে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন কাজে দেশের বাহিরে যেতে হয় এবং এ সমস্ত কারণে আমার ওপর অনেক হয়রানি হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, লেখক ও মানবাধিকারকর্মী ড. শহিদুল আলম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দেশের অন্যতম প্রধান আলোক চিত্র শিল্পী ও বিশ্বের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় চিত্রগ্রাহকদের একজন। বাংলাদেশে এই পেশায় তার মতো বৈশ্বিক মর্যাদা খুব কম লোকই পেয়েছেন। নিজের চার দশকব্যাপী ক্যারিয়ারে শহিদুল আলমের ছবি নিউ ইয়র্ক টাইমস, টাইম ম্যাগাজিন ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সহ প্রত্যেক খ্যাতনামা পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে ছাপা হয়েছে। বাংলাদেশের ফটোসাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব আনয়নে আর যে কারো চেয়ে অনেক বেশি কাজ করেছেন শহিদুল আলম। তাঁর হাতে প্রশিক্ষিত হয়েছেন শ’ শ’ ফটোসাংবাদিক। নিজের ব্যক্তিগত উদাহরণ ও অনুপ্রেরণার মাধ্যমে তিনি হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে এই পেশায় আকৃষ্ট করেছেন। আজ যে বহু বাংলাদেশি ফটোসাংবাদিক বৈশ্বিক প্রকাশনায় নিজের ছবি ছাপানো কিংবা আন্তর্জাতিক পদক লাভের বাসনা লালন করেন, তাঁর কারণ সম্ভবত কেবল তিনিই। শহিদুল পদকজয়ী ফটোএজেন্সি দৃক প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘পাঠশালা’ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রখ্যাত ফটোগ্রাফি স্কুল। এই স্কুলে পড়তে বিদেশ থেকে শিক্ষার্থী ও অতিথি শিক্ষকরা আসেন। এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ ফটোগ্রাফিক ইন্সটিটিউট ও সাউথ এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব ফটোগ্রাফি প্রতিষ্ঠা করেছেন। দৃক ও পাঠশালা- দুই প্রতিষ্ঠানই তিনি গড়েছেন নিজের পৈতৃক সম্পত্তিতে। তাঁর সবচেয়ে সফল সৃষ্টি হলো ছবি মেলা। এই আন্তর্জাতিক চিত্রপ্রদর্শনীতে বিশ্বের সব জায়গা থেকে কাজ জমা পড়ে। অংশ নিতে ঢাকায় আসেন বিশ্বের সেরা সব ফটোগ্রাফাররা। ২০০০ সালে শুরু হওয়া এই চিত্রপ্রদর্শনীর প্রথম থিম ছিল ‘যেই যুদ্ধ আমরা ভুলে গেছি।’ এটি ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও গণহত্যা নিয়ে সবচেয়ে সফল চিত্রপ্রদর্শনীর একটি। ১৯৮৩ সালে তিনি হার্ভে হ্যারিস ট্রফি জেতেন। ১৯৯৩ সালে তথ্যচিত্রের জন্য জিতে নেন মাদার জোন্স পদক।‘৯৮-এ তিনি আন্দ্রে ফ্রাঙ্ক ফাউন্ডেশন ও হাওয়ার্ড চ্যাপনিক অ্যাওয়ার্ডস লাভ করেন। ২০১৪ সালে শিল্পকলা পদক ও ২০১৭ সালে চীনের ডালি ইন্টারন্যাশনাল চিত্রপ্রদর্শনীতে আজীবন সম্মাননা লাভ করেন। এ বছর তিনি পান লুসি ফাউন্ডেশন হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাওয়ার্ড। চিত্রগ্রাহক হওয়ার পাশাপাশি তিনি লেখক, কিউরেটর ও অ্যাক্টিভিস্ট। ২০০৭ সালে তিনি কাশ্মীরের ভূমিকম্প নিয়ে ‘নেচার’স ফিউরি’ ও দক্ষিণ এশিয়ায় এইচআইভি/এইডস নিয়ে ‘পোর্ট্রেইট অব কমিটমেন্ট’ শীর্ষক দুটি বই লিখেন। তার লেখা বই ‘মাই জার্নি অ্যাজ অ্যা উইটনেস’ সম্পর্কে লাইফ ম্যাগাজিনের সাবেক পিকচার এডিটর জন মরিস লিখেছেন, কোনো চিত্রগ্রাহকের লেখা সর্বকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই এটি। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্গানিক কেমিস্ট্রি নিয়ে পিএইচডি আছে তাঁর। যুক্তরাজ্যের সান্ডারল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইউসিএলএ) তিনি ভিজিটিং প্রফেসর। এ ছাড়া তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিথি লেকচারার ছিলেন। গত বছর আলোকচিত্র এবং আন্দোলনের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে ইউনিভার্সিটি অব দ্য আর্টস লন্ডন।
২০১৮ সালের আগস্ট মাসে নিরাপদ সড়কের দাবিতে দেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আল জাজিরা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার ও ফেসবুকে কয়েকটি পোস্ট দেবার পর ৫ আগস্ট রাতে তাঁকে তাঁর ঢাকার বাসা থেকে পাঁচ-ছয় জন লোক জোর করে তুলে নিয়ে যায়। পরদিন আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার করে পুলিশ। ভয় দেখিয়ে বাক স্বাধীনতাকে স্তব্ধ করে দেওয়াই ছিল তাঁকে গ্রেপ্তার করার মূল কারণ। আল জাজিরার সাথে সাক্ষাৎকারে শহিদুল আলম বর্তমান সরকারকে ‘অনির্বাচিত’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এই ঘটনায় তাকে গ্রেপ্তারের পর ১০ আগস্ট বিশ্ব বরেণ্য ২৫ জন বুদ্ধিজীবি শহিদুল আলমের মুক্তি চেয়ে বিবৃতি দেন। মার্কিন ভাষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক এমআইটির প্রফেসর এমিরেটাস নোম চমস্কি ছাড়াও লাহোর/হুস্টোন-এর লেখক বাপসি সিদ্ধা, পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী ফটো সাংবাদিক প্যাট্রিক ফ্যারেল, ম্যারি রিচার্ডসন বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাসের অধ্যাপক আয়েশা জালাল, যুক্তরাজ্যের বাথ স্পা বিশ্ববিদ্যালয়ের সালিমা হাশমি, ফ্রেন্ড অব বাংলাদেশ পুরস্কার বিজয়ী কবি ড. আব্দুল হামিদসহ বরেণ্য বুদ্ধিজীবিরা বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন। বিবৃতিদাতারা বলেন, আমরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পী ও আলোক চিত্রীরা বিশিষ্ট ফটো সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলমকে আটক ও নিপীড়নের তীব্র নিন্দা এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে তাঁর আশু মুক্তির আহ্বান জানাই। এছাড়া মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সাংবাদিকদের বৈশ্বিক সংগঠন কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), পেন ইন্টারন্যাশনাল, মুম্বাই প্রেসক্লাব, দক্ষিণ এশিয়া মিডিয়া ডিফেন্ডার্স নেটওয়ার্ক (সামডেন) সহ গার্ডিয়ান ও ওয়াশিংটন পোস্ট, নিউইয়র্ক টাইমস তাঁর মুক্তি দাবি করে বিশাল কাভারেজে বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করে এবং গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানায়। দেশি-বিদেশি সকল অনলাইন -অফলাইন প্রকাশনায় বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়।
দেশে ও বিদেশে তাঁর মুক্তির জন্য ব্যাপক দাবি ও প্রচেষ্টার পরও মোট ১০৭ দিন জেল খাটতে হয় শহিদুল আলমকে। বেশ কয়েকবার নিম্ন ও উচ্চ আদালতে চেষ্টার পর অবশেষে ২০ নভেম্বর জামিনে তিনি ছাড়া পান। নিজের গ্রেপ্তারের কারণ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,“আমার ধারণা, যারা কথা বলার দুঃসাহস দেখায় তাঁদেরকে একটা বার্তা দেওয়া যে, এসব ক্ষেত্রে তারা কী করতে পারে।” তাঁর গ্রেপ্তারের পরবর্তীতে দেশে ও বিদেশে ওঠা প্রতিবাদের ঝড় সম্পর্কে সরকার প্রস্তুত ছিল না বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, “তাদের হিসাব সম্পূর্ণ ভুল ছিল, শুধু আমি যা করেছি তা নয়, বরং অন্যরা যা করেছে সেসব বিষয়েও, বিশেষত জেলের বাইরের মানুষজন যা করেছে, যে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে, ভয় ও আশঙ্কা উপেক্ষা করে মানুষ যেরকমভাবে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে।”শহিদুল আলম জানান, আল জাজিরায় সাক্ষাৎকারে তিনি যা বলেছেন, তা এখনো সমর্থন করেন। তিনি বলেন, “আল জাজিরার সাথে সাক্ষাৎকারে আমি যা বলেছি, তা আমি এখনো সমর্থন করি, এবং সেগুলো এমন কতগুলো বিষয় যা সরকারসহ প্রায় সকলে ভালোভাবেই জানে। তাদেরকে মূলত যে বিষয়টা ক্ষেপিয়ে তুলেছে, খুব সম্ভবত, তাদের আইনগত বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা, যেটা তাদের মাথা ব্যথার একটা বড়ো কারণ।” যখন তাঁকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি বাসায় একা ছিলেন বলে জানান। তিনি বলেন, এক তরুণী তাঁর দরজার বেল বাজালে তিনি দরজা খুলে দেন। তরুণীটি তাঁকে শহিদুল আংকেল বলে ডাক দিয়েছিল বলেও জানান তিনি। তবে দরজা খোলার সাথে সাথে পাঁচ-ছয় জন লোক তাঁকে জাপটে ধরে তুলে নিয়ে যায়।“আমি বাসায় একা ছিলাম, তবে আমি অন্যদেরকে জানানোর চেষ্টা করছিলাম। আমি চিৎকার করা শুরু করি যাতে অন্যরা আমার গলা শুনতে পায়,” বলেন তিনি।“আমি যত দূর পারি, চেষ্টা করছিলাম ঘটনাটাকে দীর্ঘায়িত করতে,” যোগ করেন তিনি। বাসা থেকে জোর করে লিফটে উঠিয়ে নিচে এনে তাঁকে একটি ভ্যান গাড়িতে তোলা হয়। শহিদুল আলম গাড়ির দরজার বাইরে পা বাড়িয়ে দিয়ে চেষ্টা করেন দরজা আটকাতে। একইসাথে তিনি চিৎকার করতে থাকেন। কিন্তু ওই লোকজন তাঁর পাসহ জোর করে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দেয়। তিনি বলেন, “আমি যাতে চিৎকার করতে না পারি, সেজন্য তারা আমার মুখ চেপে রেখেছিল। আমি ধাক্কা দিয়ে হাত সরিয়ে দেওয়ায় তারা আমার হাত দুটো পিছমোড়া করে হাতকড়া পরিয়ে দেয়। তারপর চোখ বেঁধে আমাকে নিয়ে চলে যায়।”
বাংলাদেশর গণমাধ্যম নিয়ে উদ্বিগ্ন শহিদুল আলম বলেন, “বাংলাদেশে নতুন প্রযুক্তির বিকাশের পাশাপাশি যখন কীনা গণমাধ্যমের অধিকতর স্বাধীনতা ভোগ করার কথা, সেখানে যে এর উল্টো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আজকে বাংলাদেশে অনেক পত্রিকা, অনেক টেলিভিশন, অনেক রেডিও। তা সত্ত্বেও গণমাধ্যম যে ভূমিকা রাখতে পারে না, সেটাই আমার কাছে খুব চিন্তার বিষয়। কিছু কিছু গণমাধ্যম তো নিজেদের একেবারে সরকারের মুখপাত্র হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। অনেকে বিভিন্ন ভাবে সরকার থেকে আরেক ধাপ এগিয়ে সরকারের বুলিকেই সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করতে চেষ্টা করছে। এটা একটা ভয়ের বিষয়।” বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকায় হতাশ শহিদুল আলম বলেন, ” যেখানে বুদ্ধিজীবীদের এত জোরালো ভূমিকা রাখার কথা, সেখানে এতটাই তারা গুটিয়ে গিয়েছে, তাদেরও তো জনগণের আস্থা রাখার সুযোগ এত কম। বুদ্ধিজীবীদের তো কেনা যায়, তাদের পোষা যায়। যারা পোষা বুদ্ধিজীবী নয়, তাদেরই ভয় পায়। “
বাংলাদেশের কারাগারকে দুর্বিসহ হিসেবে বর্ণনা করেন শহিদুল আলম।“ওখানে কোনো বালিশ নেই, চাদর নেই, অনেকগুলো মানুষের জন্য একটি মাত্র টয়লেট। লোকজনকে আমি বালিশ হিসেবে নিজের জুতা ব্যবহার করতে দেখেছি।”তবে অন্য কয়েদি এবং জেলখানার কর্মীরা তাঁর প্রতি অনেক সদয় ছিলেন বলে জানিয়েছেন শহিদুল আলম। তাঁরা সব সময়ই তাঁর দেখাশোনা করতেন বলে জানান তিনি। শুরুর দিকে একজন খুনের আসামির সাথে এক সেলে ছিলেন বলে জানান শহিদুল। ওই সেলে শুধু তাঁরা দুইজনই ছিলেন, যেখানে আমদানি সেলে, অর্থাৎ যেখানে নতুন কয়েদিদের রাখা হয় সেখানে ১৭০ জনের মতো আসামি ছিলেন বলে জানান তিনি।“জেলখানার লোকজন আমার প্রতি খুবই সদয় ছিলেন, বিশেষত কয়েদিরা। তাঁরা প্রায়ই আমাকে কলা, ফলের জুস, দুধ এগুলো খাবার জন্য এনে দিতেন,” বলেন শহিদুল আলম। তিনি বলেন, “আমি খুবই ভাগ্যবান ছিলাম, কারণ আমার সম্পর্কে জানত সবাই। আমি জেলখানার সব স্তরের কাছ থেকেই সহায়তা পেয়েছি, বিশেষত অন্য কয়েদিদের কাছ থেকে। তারা সব সময়ই আমকে দেখে রাখত, সব সময় খেয়াল রাখত যাতে আমার ক্ষেত্রে অনাকাঙ্খিত কিছু না ঘটে। আমার ধারণা, জেলার এবং কর্মীরাও আমার সম্পর্কে খুব ভালো করে জানতেন।”জেলখানার এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে জেল ব্যবস্থার পুনর্গঠন নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন শহিদুল আলম। তিনি বলেন, “এখন আমি জানি, জেল জিসিনটা কেমন, আমি জানি জেলে কত নিরপরাধ মানুষ রয়েছে, যাদের সেখানে থাকার কথা নয়। আমি জানি অন্য অনেককে কত নিপীড়ন সহ্য করতে হচ্ছে। সুতরাং আমি কারাগার পুনর্গঠনের জন্য একটি কাজ শুরু করতে চাই।”ভবিষ্যতেও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং কথা বলার চর্চা অব্যাহত রাখবেন জানিয়ে বলেন, “আমি আগেও সত্য বলেছি, এখনো বলছি, তখনো আমাকে গ্রেপ্তার করার কোনো অধিকার তাদের ছিল না, এখনো নেই। একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে আমি আমার কথা বলেই যাব।”