নিউজবাংলাদেশ

নির্বাচনী ভিলেনদের তালিকা প্রকাশ: ১৮ সালের ৪৫ সচিব চিহ্নিত

  • কূটনৈতিক যুদ্ধে হেরে গেছে সরকার
  • শান্তি ‍মিশনে বাংলাদেশকে নিষিদ্ধের দাবী
  • আওয়ামী লীগের হয়ে দেন-দরবার করবে না ভারত

।। সুরমা প্রতিবেদন।।

লণ্ডন, ২ জুন: যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণা করার পরে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খল নায়কের ভূমিকা পালনকারী আওয়ামী পদলেহী সরকারি কর্মকর্তারা চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছে। যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত ভিসা নীতি নিয়ে এসব সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। সচিবালয়ে এখন এটা  ‘টক অব দ্য সেক্রেটারিয়েট’ পরিণত হয়েছে। ডিসি, এসপিসহ ২০১৮ সালের নির্বাচনী অনিয়মের সাথে জড়িত অন্যান্য সংস্থার সদস্যদের মাঝেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। আমেরিকান এই নীতি মিত্র দেশগুলিও অনুসরণ করবে। ফলে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারিতে নৈশ ভোটের কারিগরদের চোখে-মুখে উদ্বেগের ছাপ পরিলক্ষিত হয়েছে। যেসব কর্মকর্তার সন্তানেরা যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেন এবং সেখানে যাঁদের সহায়-সম্পদ ও যাতায়াত রয়েছে, সেসব কর্মকর্তারাই ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারিতে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত হয়ে পড়েছে।  ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরে নৈশ ভোট করে গণশত্রুতে পরিণত হওয়া এসব কর্মকর্তাদের নামের তালিকা সাপ্তাহিক সুরমা সংগ্রহ করছে। এছাড়া ভুয়া নির্বাচনের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং অফিসার, নির্বাচন কমিশন ও তাদের সচিবালয়ের অফিসার, আইজিপি, ডিসি, এসপি, ওসি, ডিআইজি এবং আর্মি অফিসার যারা দায়িত্বে ছিলেন, যেসকল ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা দায়িত্বরত ছিলেন, যেসকল সচিবরা অফিসার্স ক্লাবে গোপন মিটিং করে নির্বাচনে কারচুপি করার পরিকল্পনা করেছিলেন, যেসব কর্মকর্তারা গোপন আদেশে জেলা মনিটরিংয়ের দায়িত্বে নিয়েছিলেন, নির্বাচনের পরদিন থানায় থানায় যারা বিশেষ ভোজের আয়োজন করেছিলেন তাদের সবার নামের তালিকা, পরিচিতি, এবং অপরাধের ধরণ সাপ্তাহিক সুরমা সংগ্রহ করছে। এসব তথ্য মার্কিন দূতাবাস, স্টেইট ডিপার্টমেন্ট এবং পশ্চিমা দূতাবাসে প্রেরণ করা হবে এবং সাপ্তাহিক সুরমায় তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হবে। এ সপ্তাহে প্রথম পর্বে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নৈশ ভোটের আগ মুহুর্তে দেশের ৬৪ জেলায় উপদেষ্টা (মেনটর) নিয়োগকৃত ৪৫ জন সিনিয়র কর্মকর্তার নাম প্রকাশ করা হলো।

কর্মকর্তাদের নাম, পদবী অপরাধের ধরণ’

২০১৮ সালের ভোট ডাকাতির নির্বাচনের আগে ৮ নভেম্বর উন্নয়ন প্রকল্প তদারকির নামে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান ৪৫ জন সিনিয়র কর্মকর্তাকে ৬৪ জেলার উপদেষ্টা (মেনটর) নিয়োগ করে। তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের তালিকায় ছিলেন সাবেক ও বর্তমান সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব। তাদের অধিকাংশকে নিজ নিজ জেলার তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিনেই তাদের নিয়োগ দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে এ ধরনের নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় খোদ প্রশাসনেই। ফলে প্রাথমিকভাবে ১৩ নভেম্বর তা স্থগিত বা বাতিলের কথা বলা হলেও বাতিল করা হয়নি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত আদেশও জারি করার কথা বলা হলেও তা জারি করা হয়নি এবং কোথাও সেটা প্রকাশ করা হয়নি। এ ব্যাপারে তৎকালীন ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জেলা প্রশাসনে মেনটর নিয়োগ পূর্ব প্রচলিত। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এটা রুটিন কাজ। এ আদেশটি কমিশন অবহিত নয়। উপদেষ্টা (মেনটর) নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে ইসির সচিবসহ ৩৮জন বর্তমান ও সাবেক সচিব এবং ৭জন অতিরিক্ত সচিব ছিলেন। এ তালিকায় কয়েকজন সিনিয়র সচিবও ছিলেন। এ ধরণের দায়িত্ব নিয়ে তারা নির্বাচনকে চরমভাবে প্রভাবিত করেছিলেন এবং রিটার্নিং অফিসারদের ওপর অযাচিত প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন।  তারা হলেন:- স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম- মাদারীপুর, পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ইসতিয়াক আহমদ- মানিকগঞ্জ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সাবেক সচিব এম এ এন ছিদ্দিক-নরসিংদী, সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম-টাঙ্গাইল, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম- মুন্সীগঞ্জ, প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের জনবিভাগ সচিব সম্পদ বড়ুয়া- কিশোরগঞ্জ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ সচিব কামাল উদ্দিন তালুকদার- শরীয়তপুর, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শেখ ইউসুফ হারুন- গোপালগঞ্জ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক (এসডিজি) মো. আবুল কালাম আজাদ- জামালপুর, পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য সুবীর কিশোর চৌধুরী- ময়মনসিংহ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান- নেত্রকোনা,নৌপরিবহন সচিব মো. আবদুস সামাদ-শেরপুর, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব নজরুল ইসলাম খান- যশোর, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. নমিতা হালদার- বাগেরহাট, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শ্যামল কান্তি ঘোষ- ঝিনাইদহ, ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল হান্নান- খুলনা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মো. আকরাম-আল-হোসেন- মাগুরা, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. জিল্লার রহমান- চাঁপাই নবাবগঞ্জ, পানিসম্পদ সচিব কবির বিন আনোয়ার- সিরাজগঞ্জ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব সৌরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী- নওগাঁ, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল- পাবনা, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. সাইদুর রহমান- নাটোর, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খন্দকার মো. ইফতেখার হায়দার- রংপুর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. মাকসুদুল হাসান খান- গাইবান্ধা, ভূমি সংস্কার বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মাহফুজুর রহমান- কুড়িগ্রাম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক বনমালী ভৌমিক- পঞ্চগড়, জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. নুরুল ইসলাম- ঠাকুরগাঁও, প্রধান তথ্য কমিশনার মরতুজা আহমদ- সুনামগঞ্জ, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. আব্দুল জলিল- সিলেট, সাবেক নৌ-পরিবহন সচিব অশোক মাধব রায়- হবিগঞ্জ, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আবদুল মালেক- পটুয়াখালী, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব নাজিমউদ্দীন চৌধুরী- ভোলা, শিল্প মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. আব্দুল হালিম- বরিশাল, সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইসমাইল- ঝালকাঠি, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া- পিরোজপুর, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক সচিব নববিক্রম কিশোর ত্রিপুরা- খাগড়াছড়ি, বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব খোরশেদ আলম চৌধুরী- কক্সবাজার, বিপিএটিসির সাবেক রেক্টর আ ল ম আব্দুর রহমান- চট্টগ্রাম, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) এন এম জিয়াউল আলম- কুমিল্লা, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী- ফেনী, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন- নোয়াখালী, নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ- বান্দরবান, বিসিএস প্রশাসন একাডেমির রেক্টর মো. মোশাররফ হোসেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. মাকছুদুর রহমান-চাঁদপুর।

‘কূটনৈতিক যুদ্ধে কাবু হচ্ছে সরকার’

বছর দেড়েক আগে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর সাত কর্মকর্তার ওপর স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দেয় যুক্তরাষ্ট্র। তার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার (২৪ মে) গভীর রাতে আগামী নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় কোনো রকম অনিয়ম, হস্তক্ষেপ ও বাধা দান করা হলে এর সঙ্গে জড়িত যেকোনো ব্যক্তি ও তার পরিবারকে ভিসা দেবে না জানিয়ে বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানে নতুন নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি অনুসারে ভুয়া ভোট প্রদান, ভোটার ও নির্বাচনী এজেন্টদের বাধা দান, নির্বাচনী সমাবেশে হামলা, গায়েবি মামলা প্রদান, নির্যাতন-নিপীড়ন, মতপ্রকাশে বাধা দান ইত্যাদি কাজ নির্বাচনে অনিয়ম ও হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এসব কাজে জড়িত থাকলে সরকারের সব পর্যায়ের ব্যক্তিরা (যেমন: মন্ত্রী, আমলা, পুলিশ বা নিরাপত্তা বাহিনী) এবং বিরোধী দলেরও যে কেউ এই ভিসা নীতির তোপে পড়তে পারেন বলে জানা গেছে। নতুন এই ভিসা নীতি তাই স্যাংশনের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক। কারণ, এটি নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নয়, বরং এটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় যেকোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োগযোগ্য সর্বজনীন নীতি। এই নীতির আলোকে কারও আমেরিকান ভিসার আবেদন প্রত্যাখাত হলে, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মিত্র যেসব দেশ বাংলাদেশের মানুষের প্রিয় গন্তব্যস্থল (অবকাশ, ব্যবসা বা সন্তানদের শিক্ষার জন্য) সেখানে ভিসাপ্রাপ্তিও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। জড়িত ব্যক্তি ছাড়াও তাঁদের স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানদের ভিসা দেওয়া হবে না বা ভিসা থাকলে তা বাতিল করা হবে। একই সঙ্গে এর ভেতর বিচারবিভাগ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান, সরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাও থাকবে। অর্থাৎ ব্যাপক ও বিস্তৃত পরিসরে যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। দেশের ৫২ বছরের কূটনীতির ইতিহাসে নজিরবিহীন এক ঘটনা। শুধু নজিরবিহীন বললেই যথেষ্ট হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা প্রদানে নতুন নীতি দেশের ইতিহাসে কূটনৈতিক ব্যর্থতার উদাহরণ হয়ে থাকবে। প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দৌড় ঝাপ ও ব্যাপক অর্থ ব্যায়ে লবিষ্ট নিয়োগ করে লবিং করা সত্বেও যুক্তরাজ্য, জাপানসহ বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগি অন্যান্য দেশগুলো দেশে অবাধ, সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছে। সরকারের সব রকমের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা বিফলে গেছে। ২৯ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে সফরে ছিলেন। তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফরকালেই (৩মে)  যুক্তরাষ্ট্র তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের এমন কঠোর বার্তার পর সরকারের টনক নড়েছে। মুখে যত যা-ই বলুক, ভেতরে  ভেতরে তাদের কম্পন শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সফরকে সফল বলে দাবি করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই সফরে কার্যত কোনো কূটনৈতিক সাফল্য আসেনি। এরপর লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত তাঁকে আর ক্ষমতায় রাখতে চাইছে না। এ অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেও করেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে ক্ষমতার পালাবদলে ভূমিকা রাখে। তিনি আরও বলেছেন, ‘যারা নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের কাছ আমরা কিছু কিনব না।’ ৩ মের ওই চিঠির আগে ও পরে প্রধানমন্ত্রীর নানা ধরনের কথাবার্তা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্বের ও কূটনৈতিক যুদ্ধে সরকারের কাবু হওয়ারই বহিঃপ্রকাশ। প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তির কথাবার্তা ও যুক্তরাষ্ট্রে নানা প্রতিক্রিয়ায় বোঝাই যাচ্ছে, কূটনৈতিক টানাপোড়েন ভালোভাবেই চলছে, কূটনৈতিক যুদ্ধে সরকার কাবু হচ্ছে।

‘বাংলাদেশের বাহিনীকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে নিষিদ্ধ করার আহ্বান’

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছয় কংগ্রেসম্যান  স্কট প্যারি, বব গুড, ব্যারি মুর, টিম বার্শেট, ওয়ারেন ডেভিডসন ও কীথ শেলফ গত ১৭ মে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের কাছে চিঠি লিখেছেন। সেই চিঠিতে তারা বিরোধী দল এবং সংখ্যালঘুদের ওপরে ক্ষমতাসীনদের নানা রকম অন্যায় অত্যাচারের কথা উল্লেখ করে সবশেষে আহ্বান জানিয়েছেন বাইডেন যেন বাংলাদেশের সৈন্য জাতিসংঘে পাঠানোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন। চিঠিতে তাঁরা বলেন, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘন থামাতে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত ও অবাধ নির্বাচনের সর্বোচ্চ সুযোগ দেওয়ারও অনুরোধ জানাচ্ছি। এতে বলা হয়, শেখ হাসিনার সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে যে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে আসছে, কিছু এনজিও তার শত শত প্রমাণ সংগ্রহ করেছে। এ বিষয়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ফ্রিডম হাউস- এমনকি জাতিসংঘেরও প্রতিবেদন রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে প্রত্যাখ্যান করছে। মানুষের ওপর নির্যাতন বেড়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেড়েছে, সাংবাদিকদের কারারুদ্ধ করা হয়েছে, প্রতিপক্ষকে গুম করা হয়েছে এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা এবং হত্যা করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের নির্যাতন শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপরই হয়নি, বরং ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর হিন্দুদের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে এসেছে। তাদের ওপর হামলা, মন্দির ও বাড়িঘরে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, হত্যা, ধর্ষণ এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তর করার কারণে হিন্দুরা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। একইভাবে খৃস্টান সম্প্রদায়ের ওপরও নিপীড়ন চালানো হয়েছে। চিঠিতে আরো বলা হয়, কয়েক মাস ধরে হাজার হাজার মানুষ অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করছে। এই প্রতিবাদীদের একটাই প্রত্যাশা, শেখ হাসিনার সরকার যাতে বিদায় নেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের গুম-খুন-নির্যাতনের মূল হোতা, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন (র‌্যাব) অসংখ্য প্রতিবাদীকে গ্রেপ্তার করেছে। খুন করেছে। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ফ্রিডম হাউজ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অসংখ্য এনজিও র‌্যাবকে সরকারের ডেথ স্কোয়াড হিসেবে অভিহিত করেছে। সম্প্রতি ডয়চে ভেলে ও নেত্র নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, র‌্যাবের প্রাক্তন সদস্যরা স্বীকার করেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন ছাড়া বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ড এবং জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটানো সম্ভব না। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক বছর আগে র‌্যাবকে ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্যাংশন জারি করেছে। এরপরও শেখ হাসিনার সরকার জনগণের ওপর নিপীড়ন জোরদার করেছে। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এই সরকারের পিছিয়ে পড়া এবং মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন ঠেকাতে র‌্যাবের বিরুদ্ধে এই নিষেধাজ্ঞা যথেষ্ট নয়। দেশের জনগণের প্রতি শেখ হাসিনার এই অপরাধ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য খারাপ ‘অ্যাক্টরকে’ উৎসাহিত করছে। তারা একত্রিত হচ্ছে এবং চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকছে। এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থকে আঘাত করছে। কংগ্রেসম্যানরা বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশ অবাধ নির্বাচনের সর্বোত্তম সুযোগটি পাক। এই জন্য ব্যক্তিভিত্তিক নিষেধাজ্ঞা জোরদার করার আহ্বান জানাচ্ছি। একই সঙ্গে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সামরিক বাহিনীকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে নিষিদ্ধ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।

স্ত্রী আওয়ামী লীগের হয়ে দেন-দরবার করবে না ভারত সরকার’

যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকির ইস্যুতে ভারত সরকার কখনই মার্কিন সরকারের কাছে গিয়ে বাংলাদেশ সরকার বা আওয়ামী লীগের হয়ে দেন-দরবার করবে না বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক এবং দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার হুমকির ইস্যুতে ভারত সরকার কি বাংলাদেশে সরকারের পাশে থাকবে? এ প্রশ্ন এখন নানা জায়গায় আলোচিত হচ্ছে। এ নিয়ে বিবিসি বাংলার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমেরিকা র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর সুরাহার জন্য বাংলাদেশ সরকার দিল্লির দ্বারস্থ হয়েছিল বলে খবর বেরিয়েছিল যা তারা অস্বীকার করেনি। ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি কৌশলগত সহযোগী দেশ। কোয়াডের সদস্য। খুবই ঘনিষ্ঠ একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা গড়ে উঠেছে দুই দেশের মধ্যে। তাছাড়া, ভারতের বাজারও আমেরিকান বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য খুবই লোভনীয়। কিন্তু দিল্লি কি তাদের সেই কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে আওয়ামী লীগের ওপর চাপ কমাতে সাহায্য করবে? ভারতের জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক এবং দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দিল্লির ওপর ভরসা করে এবং এখনও করবে, কিন্তু ভারতেরও কিছু সমস্যা রয়েছে। ভারত কি আমেরিকাকে বলবে বাংলাদেশ নিয়ে তোমরা যা করছো সেটি ঠিক নয়? আমার মনে হয়না ভারত তা করবে।’ বাংলাদেশ বা আওয়ামী লীগের হয়ে ভারত সরকার দেন-দরবার করবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে কূটনীতি বিভিন্ন চ্যানেলে হয়, ভারত হয়ত ট্র্যাক টু বা ট্র্যাক থ্রি চ্যানেলে একথা তুলবে, কিন্তু ভারত সরকার কখনই মার্কিন সরকারের কাছে গিয়ে বাংলাদেশ সরকার বা আওয়ামী লীগের হয়ে দেন-দরবার করবে না।’ তবে তিনি স্বীকার করেন ভারত চায় আওয়ামী লীগের সরকার বাংলাদেশে থাকুক কারণ, তার মতে, নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগগুলো সবসময় শেখ হাসিনা আন্তরিকভাবে  বিবেচনা করেছেন যা নিয়ে দিল্লি কৃতজ্ঞ।’ এ কারণে, তিনি বলেন, ‘পরপর দুটো নির্বাচন নিয়ে বিস্তর প্রশ্ন উঠলেও ভারত চোখ বুজে ফলাফলকে মেনে নিয়েছে। এটা ঠিক যে ভারত আওয়ামী লীগকে অন্ধের মত সমর্থন করেছে…কিন্তু আমেরিকা এখন যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে সেটা ভারতের জন্য চিন্তার জায়গা তো বটেই। মনে হচ্ছেনা আমেরিকানরা পেছাবে। সেখানে ভারত কী করতে পারবে তা নিয়ে আমি সন্দিহান।’ এর আগে র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়েও ভারত যে বাংলাদেশের হয়ে আমেরিকার সঙ্গে জোরালো কোনও দেন-দরবার করেছে তার কোনো প্রমাণ নেই। ভারত যতই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবুক না কেন তাদের তো অনেক জায়গাতেই যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন বলে মনে করেন দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close