নিউজ

বঙ্গবাজারে স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, হাজারো ব্যবসায়ীর স্বপ্ন পুড়ে ছাই

ফায়ার সার্ভিস হেডকোয়ার্টারের পাশে এতবড় অগ্নিকাণ্ড নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন

সুরমা প্রতিবেদন: ঈদের আগে স্মরণকালের ভয়াবহ আগুনে পুড়েছে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী বঙ্গবাজার মার্কেট। ঈদ সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা যখন রমরমা ব্যবসার স্বপ্ন দেখছিলেন, তখনই এক আগুনে সবকিছু মাটিতে মিশে গেছে। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হাজারো ব্যবসায়ীর স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীসহ দোকান কর্মচারীদের মাঝে প্রশ্ন উঠেছে ফায়ার সার্ভিসের হেডকোয়ার্টারের পাশে এই অগ্নিকাণ্ড শুরুতেই কেনো নিয়ন্ত্রণ করা গেলোনা? ফায়ার সার্ভিস হেডকোয়ার্টার থেকে দুই মিনিটের রাস্তাও নয় বঙ্গবাজার। তারপরও আগুন  কিভাবে এতটা ছড়িয়ে পড়ল? সকাল ছয়টায় লাগা আগুন বঙ্গবাজারের এক অংশ থেকে আরেক অংশে কিভাবে ছড়ালো? বারবার আগুন লেগে সাধারণ মানুষ নিস্ব হয়ে যাচ্ছে তবুও কেনো সরকারের টনক নড়ে না? শত কোটি টাকা খরচ করে ‘মুজিব’ নামের সিনেমা বানানো হয়, তবুও কেনো অল্প কিছু টাকা খরচ করে ফায়ার বিগ্রেড সিস্টেমকে আধুনিকায়ন করা হয়না?

বঙ্গবাজারের প্রায় সব দোকানদার হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এদের অধিকাংশ ঈদ উপলক্ষে আত্মীয় স্বজনের নিকট থেকে টাকা ধার করে অথবা ব্যাংক লোন নিয়ে ঈদের জন্য মাল তুলছেন দোকানে। অথচ মাত্র অল্প কিছু মূহুর্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো সবার স্বপ্ন! তাদের এই ক্ষতি কোনোদিন পূরণ হবে না। এই দেশে বুকের ভেতরে আগুন ছাড়া অন্য সকল আগুনের গল্প অধিকাংশই গোপন থাকে। আমাদের জানা হয় না, কোথা থেকে লাগলো? কে লাগালো? কী উদ্দেশ্যে লাগিয়ে দিলো? আগুনের লেলিহান শিখার সাথে এমন অনেক গল্প হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ভুক্তভোগী পরিবারের মেরুদন্ড ভেঙে যায়। আর দাঁড়াতে পারে না। খুব নির্মম হলেও সত্য, বঙ্গবাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তবে তাদের সর্বনাশ ক্ষমতাসীনদের জন্য পৌষ মাস হয়ে উঠবে। শত শত দোকান যেখানে ছাই হয়ে মাটিতে মিশে গেছে, সেখানে নতুন মার্কেট গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। নতুন নতুন ব্যবসায়ীকে দোকান বরাদ্দ দেওয়া হবে। সেই সব বরাদ্দ দেওয়া নেওয়া নিয়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হবে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, মঙ্গলবার (৪ঠা এপ্রিল) ভোরে মার্কেটটিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। হঠাৎ আগুন জ্বলতে দেখেন তারা। খবর পেয়ে উদ্ধারে অংশ নিতে আসে ফায়ার সার্ভিস। এরপর অল্প সময়েই বাড়তে থাকে বাহিনীর ইউনিটের সংখ্যা। এক পর্যায়ে পানির সংকটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রমনা এলাকা থেকে বহন করে নেয়া হয় পানি। হাতিরঝিল থেকেও হেলিকপ্টারে পানি নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে দেখা যায়। বাতাসে আশপাশের ভবনে চলে যায় আগুন। ওই এলাকায় সড়ক বন্ধ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয় র‌্যাব। আগুন ছড়িয়ে পড়ার পর ফায়ার সার্ভিসের ৪৮ ইউনিটসহ সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী, বিমান বাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং র‍্যাবের বিভিন্ন ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয়। ফায়ার সার্ভিসসহ এসব বাহিনী গুলোর সদস্যদের প্রচেষ্টায় প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। কিন্তু ব্যবসায়ীদের মতে শুরুতেই ফায়ার সার্ভিস সচেষ্ট হলে আগুন এভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারত না। সকাল ৬টা ১০ মিনিটে মার্কেটটিতে আগুনের খবর পেয়ে ৬টা ১২ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের প্রথম ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিকভাবে আগুন নিভাতে ধীর পদক্ষেপ নেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। আগুনের সময় উত্তেজিত জনতার হামলায় ফায়ার সার্ভিসের ৩ সদস্য আহত হয়েছেন। এছাড়া আগুনের ধোঁয়ায় ও অন্যান্য ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের মোট ১২ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন,  ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ কর্মীসহ ১২ জনের মতো আগুনের ঘটনায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে আসেন। তাদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

আগুনে বঙ্গবাজার ও আশপাশে কত দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা না জানা গেলেও ধারণা করা হচ্ছে এই সংখ্যা ৫ হাজারের মতো। এসব দোকানে কাজ করতো কয়েক হাজার কর্মচারী। ধারণা করা হচ্ছে ৫০ হাজারের মত পরিবার এই অগ্নিকাণ্ডে সঙ্কটের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন জানিয়েছেন, বঙ্গবাজার মার্কেটে আড়াই হাজারসহ আশপাশের মার্কেটে আগুনে প্রায় ৫ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ঈদ সামনে রেখে বঙ্গবাজার ও আশে-পাশের মার্কেট গুলোর দোকানী এবং কর্মচারীদের অনেক স্বপ্ন থাকে। আগুনে স্বপ্ন পুড়ে ছাই হওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নিয়ে সঙ্কটে পড়বে অনেক দোকানী ও কর্মচারীরা।

বঙ্গবাজারে লাগা ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানতে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। তদন্ত কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য ৭ কার্যদিবস সময় দেয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গবাজার মার্কেটটি ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপর ১০ বার নোটিশ দেয়া হয়, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ঘটনাস্থল থেকে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘২০১৯ সালের ২ এপ্রিল এই ভবনটি ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করেছিলাম এবং ব্যানারও লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এরপরে ১০ বার নোটিশ দিয়েছি যে, এই ভবন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ফায়ার সার্ভিস বা আমার করণীয় যা যা ছিল তা করেছি। তারপরও এখানে ব্যবসা চলছিল।’ দশবার নোটিশ দিয়েছেন এরপরে বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের বা রাজউকের। তাদের অবহেলার কারণে কী ঘটনা ঘটেছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ডিজি বলেন, ‘এ প্রশ্নটার উত্তর আমার কাছে নেই। এ প্রশ্নটা যে সংস্থার নাম আপনারা উচ্চারণ করলেন, তাদের জিজ্ঞাসা করা ভালো।’

এদিকে রাজধানীতে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের পরও তদন্ত প্রতিবেদন সামনে না আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে এই ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এ সময় মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য মো. সেলিম রেজা ও অন্যান্য কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close