মুশতাক স্মরণে কার্টুনিস্ট কিশোরের লেখা- মৃত্যু, তুমিও বন্দী এখানে
।। আহমেদ কিশোর ।।
মুশতাক আহমেদ ভাই গুম থাকা অবস্থায় জিজ্ঞাসাবাদের সময় ইলেকট্রিক শকের কারনে কারাগার অভ্যন্তরে মারা গেলেন।
পত্র পত্রিকায় লেখালেখির কারনে আমরা ক্রমশ সংবেদনশীল হয়ে যাচ্ছি দেখে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুব [তত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অন্তরীণ শেখ হাসিনাকে সেল ফোনে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে বিশেষ আশীর্বাদপ্রাপ্ত, বিএনপি এর প্রভাবশালী কমিশনার বাড্ডার কাইয়ুম-সিজার তাভেল্লো হত্যাকান্ডের আসামী’এর আত্মীয়,ত্বকী হত্যাকান্ডের আসামী ওসমান পরিবারের আত্মীয়, সর্বোচ্চ দুর্নীতি পরায়ন জেলার, প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক] আমাদেরকে ‘ওয়ান ফাইন মর্নিং’ কাশিমপুর কারাগারে চালান করে দেয়। মুশতাক ভাই কাশিমপুর ৪ এ যেটা হাই সিকিউরিটি কারাগার নামে সর্বাধিক পরিচিত, আর আমি কাশিমপুর ২ এ চালান হয়ে আসি।
কাশিমপুর ২ কারাগার থেকে আবুবকর নামের এক বন্দীর পালিয়ে যাবার পর ভীষণ করাকড়ির সাথে সাথে তিন গুণতির প্রচলন হয়। কানের ব্যথার কারণে প্রতিসপ্তাহে টাকার বিনিময়ে হাসপাতালে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় (প্রাক্তন আইজি প্রিজন পাশা স্যারের আদেশে) জেলার সায়েম।
কারাগারের মধ্যে সবচে বড় হাসপাতাল কাশিমপুর ২ এর ২০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধার অধিকাংশই বিকল। আমি সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা দিতে না পারায় আমার ঠাই হয় হাসপাতালের রোগ সংক্রমণের সবচে আদর্শ স্থান জরুরি বিভাগে। সেখানে নতুন কিছু যন্ত্রপাতি আসে। তা ম্যানুয়াল দেখে আমি ব্রাদার মুখতার(বিডিআর এর মেডিকেল স্টাফ, বিষ্ফোরক মামলায় ৭ বছর সাজার পরেও বোনাস ৫ বছর খাটছে,বিনা বিচারে)কে তা বুঝিয়ে দিতে যেয়ে টের পাই ইসিজি যন্ত্রটার মাধ্যমে কিভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিডিআর সদস্যরা।
মুখতার ভাই প্রায়ই আমাদের প্রিয়ভাজন বড় ভাই প্রেস ক্লাবের প্রাক্তন সভাপতি শওকাত মাহমুদকে সেবা করার কথা বলতেন।
২৬ ফেব্রুয়ারী দুপুরের গুণতির পর কানের ব্যথায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পাশের বেডের ব্যাঙ্কের ম্যানেজার অর্থ আত্মসাতের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বয়স্ক চাচা আমাকে ঘুম থেকে ডেকে, যুগান্তর পত্রিকার শেষ পাতায় মুশতাক ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ দেখিয়ে নোয়াখালির আঞ্চলিক টোনে বলে ওঠেন- হেতিনা আপনার কেস পার্টনার?
মুশতাক ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদে আমি চিৎকার করে কাঁদতে থাকি। হাসপাতালের আমাদের ওয়ার্ডের সেবক/জলভরি/জলপরি দুজন মাদক ইয়াবা পাচারের/মামলায় সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি, আট বছর ধরে জেলে, আমার কান্না দেখে-‘মাইগ্যা পুরুষ’ বলে হাসতে থাকে। করোনার শুরুতে কারাগারে কোয়ারান্টাইন এর অভিজ্ঞতায় আমি করোনায় আক্রান্ত তিনজনসহ মোট ৬ জনের মৃত্যু দেখেছি।কারা হাসপাতালের জরুরী বিভাগে আমার পাশের বেডের দুজনকে চোখের সামনে ধুকতে ধুকতে মরে যেতে দেখেছি। দরিদ্র কয়েদিদের লাশ মৃত্যুর পরে কেউ ছুঁয়েও দেখতো না।
আমি লাশের নাকের মধ্যে তেলাপোকা ঢুকে যেতে দেখে মুখতার ভাইকে ডাকি। তিনি জরুরি বিভাগের জরুরি অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য ওয়ার্ডের কোনায় বেডে থাকতেন যাতে জানালা দিয়ে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে কারারক্ষীরা তাকে গভীর রাতে অসুস্থ রোগী এডমিট এর ড্রিল এর জ্বালাতন কম করতে পারে।
আমি কিছুক্ষণ আগে জীবিত বন্দীর নাকে তেলাপোকা ঢুকছে দেখে মুখতার ভাইকে ডেকে তুলি। তিনি বর্ণনা শুনে নির্বিকার ভাবে বলে ওঠেন- কিশোর ভাই, ঘুমায়া পরেন। আপনি আগে দ্যাখছেন, আপনারে সাক্ষী বানাইবো। যান ঘুমান। আর শোনেন-ওর বেডের পাশে বালিশের নীচে (ফাঁসির আসামীদের জন্য কারাগারে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাক্যো কতৃক বিনামূল্যে সরবরাহকৃত স্টার ব্র্যান্ডের ফিল্টার সিগারেট, যা অতিশয় নিন্ম মানের তামাকে প্রস্তুত, টাকার জন্য যা ৮০ টাকা দরে প্যাকেট হিসেবে সাধারণ বন্দীদের কাছে বিক্রি করে দেয়) সিগারেট আছে, নিয়া আসেন।
আমি জরুরি বিভাগের জরুরি সব মৃত্যু দেখে ততোদিনে কেরামন কাতেবিন এর মতো সাহসী হয়ে গেছি। আমি লাশের মাথার বালিশের নীচ থেকে সিগারেট এর প্যাকেট বের করে মুখতার ভাইকে দিলাম। তিনি শোয়া থেকে উঠে, মশারির ভেতরে বসে সিগারেট টানতে টানতে জরুরি বিভাগের সেবক, মাদক পাচার মামলার আসামী,সাক্ষাৎ শয়তান আমিনকে ডাকলেন।
আমিন বিরক্ত মুখে উঠে, কারাগারের মৃত সনাক্ত করণের সহজতম ড্রিলের অনুসরণে, লাশের লুঙ্গির গোছা ধরে একটা টান দিয়ে কিছুটা উপরে উঠালো,লাশের ঘাড় পলকে নীচে ঝুলে পরা দেখে,মুখতার ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো- খানকিরপোলা তো গ্যাছেগা। লাশের লুঙ্গির গিট্টু ধরে টানাটানি করলেও,ঝাঁকি দিলেও, তেলাপোকাটা লাশের নাকের ফুটোয় ঢোকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। আমি সাক্ষী হবার ভয়ে কিছু না দেখার ভান করে চোখ বুঁজে পাশ ফিরলাম।
ছাড়পোকার সাথে সহবাস করতে করতে নিজের মধ্যে নিজেকে ঘাপটি মেরে ভোরের অপেক্ষায় থাকলাম।
(চলবে)