নিউজ

ফুলপরী: সন্ত্রাসের বুকে পদাঘাত

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ২৩ ফেব্রুয়ারী : দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ক্ষমতার দাপটে ভয়ে যখন কেউ তাঁদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না, ঠিক তখন সাহস করে ছাত্রলীগ নেত্রীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করে বসেছেন অদম্য সাহসী এক নারী। ছাত্রীর নাম ‘ফুলপরী খাতুন’।  ফুলপরী ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাসের বুকে পদাঘাত করেছেন। শুধু তাইনা, তিনি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের নাম পরিচয় প্রকাশ করে তাঁর উপর করা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনার বিবরণ ছবিসহ প্রকাশের জন্য সকলকে অনুরোধ করেছেন। 

ভুক্তভোগী ছাত্রী ফুলপরী খাতুন জানিয়েছেন, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে ছাত্রলীগের নেত্রীরা তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর, হলের প্রভোস্ট ও ছাত্র উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন। দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে প্রভোস্ট সামসুল হক গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সানজিদা চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। অপর অভিযুক্ত তাবাসসুম ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী। ভুক্তভোগী ছাত্রীও একই বিভাগের।

ফুলপরী খাতুনের ভাষ্যমতে, ৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু হয়। এ জন্য তিনি দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলের এক আবাসিক ছাত্রীর কাছে অতিথি হিসেবে থাকেন। বিভাগের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের তাবাসসুম নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চান, কারা দেশরত্ন শেখ হাসিনা হলে থাকেন। এ সময় তিনি হাত তোলেন। হলে ওঠার বিষয়টি আগে তাবাসসুমকে না জানানোয় চটে যান তিনি। এরপর তাঁকে হলের কক্ষে (প্রজাপতি-২) দেখা করতে বলেন। তবে অসুস্থ থাকায় দেখা করেননি তিনি। ১১ ফেব্রুয়ারি ক্লাসে গেলে তাঁকে বকাঝকা করেন তাবাসসুম। এই ঘটনার জেরে ১২ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে হলের গণরুমে (দোয়েল) তাঁকে ডেকে নেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি সানজিদা চৌধুরী। সেখানে পাঁচ থেকে ছয়জনের একটি দল তাঁকে দিবাগত রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত নানাভাবে নির্যাতন করেন। তাঁরা তাঁকে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল করছিলেন আর এর ফাঁকে ফাঁকে ক্রমাগত শারীরিক নির্যাতন করছিলেন। কিল, ঘুষি, থাপ্পড় কোনোটাই বাদ রাখেননি। কাপড় আটকানোর আলপিন তাঁরা তাঁর পায়ের ঊরুতে ঢুকাচ্ছিলেন। নির্যাতনের সময় ছাত্রলীগের আরেক নেত্রী মুঠোফোন দিয়ে ভিডিওধারণ করছিলেন। একপর্যায়ে তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণ করা হয়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি পা ধরে ক্ষমা চাইলেও তাঁরা তাঁর কোনো কথা শোনেননি। গণরুমে এ সময় উপস্থিত সাধারণ ছাত্রীরাও ভয়ে কোনো কথা বলেননি। তাকে বিবস্ত্র করে ভিডিওধারণের সময় হুমকি দেওয়া হয় যে, এই কথা কাউকে জানালে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া হবে। এমনকি প্রভোস্টের বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিষয় লিখে দিয়ে তাকে বলেছেন, “হাসবি আর এগুলা বলবি।” সব তারা ভিডিও করে রেখেছেন। তাকে মারার সময় ছাত্রলীগ নেত্রীরা একে অপরকে বলছিলেন “মুখে মারিস না, গায়ে মার যেন কাউকে দেখাতে না পারে।”’ রাতের কথা কাউকে জানালে ছাত্রলীগ নেত্রীরা তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেন এবং এ কথা কাউকে বললে হল থেকে বের করে দেবেন বলে শাসান। এমনকি এই কথা বাইরে গেলে ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি দেন। ছাত্রলীগের সদস্যরা বলেন, ‘তুই হলের প্রভোস্ট স্যারকে বলবি, সব আমার দোষ, এই হলে থাকব না। এসব বলে হল থেকে একেবারে চলে যাবি। এই কথা ১৪ তারিখ বলবি।’ ফুলপরী বলেন, ‘অনেকবার ক্ষমা চেয়েছি, কেউ কোনো কথা শোনেনি। রাত সাড়ে তিনটার পর তাঁরা চলে যায়। আমি গণরুমেই ছিলাম। এরপর গতকাল সকাল নয়টার দিকে ক্যাম্পাসের সামনে থেকে বাসে উঠে গ্রামের বাড়িতে চলে আসি। আমার শরীর ব্যথা। জ্বর অনুভব করছি। ঠিকমতো খেতে পারছি না। গালের ভেতর সামান্য কেটে গেছে। আমি এ ঘটনার বিচার চাই। যাঁরা জড়িত, প্রত্যেকের শাস্তি চাই।’

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সারা দেশের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ক্রমাগত ছাত্রলীগের মাধ্যমে ছাত্রছাত্রী হয়রানি, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের নিয়মিত ঘটনা ঘটে চলেছে। কুষ্টিয়ায় অবস্থিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগী ছাত্রী ফুলপরী খাতুন সাহস করে মুখ খুলেছেন, লিখিত অভিযোগ করেছেন। যাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে সাধারণ মানুষ সাহস করে না, তাদের বিরুদ্ধে তিনি সাহস করে অভিযোগ করেছেন। যারা রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় এবং আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সন্ত্রাস করে, তাদের বিরুদ্ধে তিনি অভিযোগ করতে পেরেছেন, এ জন্য তাঁকে সাপ্তাহিক সুরমার পক্ষ থেকে অভিবাদন জানাই। কিন্তু দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ফুলপরীকে আবারও তাঁর ক্যাম্পাসে ফেরত আসতে হবে। যখন তিনি ফেরত আসবেন তখন তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নিবেন? সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রশাসন এই সব নির্যাতন ও অরাজকতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নৈতিক সাহস ও ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের কার্যকলাপই এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরোক্ষ আইন হয়ে উঠেছে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করা একজনকে যদি এটুকু সহযোগিতা করতে পারা না যায় তবে বুঝতে হবে, অন্য অনেক ক্ষেত্রে দেশটা যেমন নষ্ট হয়ে গেছে, তেমনি দেশের পবিত্র শিক্ষাঙ্গনগুলোও ক্ষমতাসীনদের কালো ছায়ায় নষ্ট হয়ে গেছে।

উল্লেখ্য, এ বছরের শুরুর দিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে সিট রাখাসংক্রান্ত বিষয়ে অ্যাকাউন্টিং ও ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের ছাত্র রিয়াদ হোসেনকে ছাত্রলীগের সদস্যরা শারীরিক নির্যাতন করেন। গত ১২ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কামালউদ্দিন হলের গেস্টরুমে ছাত্রলীগের দুইজন নেতা ও কর্মী মিলে দ্বিতীয় বর্ষের পাঁচ ছাত্রকে শারীরিক নির্যাতন করেন। পরে অভিযোগ ঠেকাতে ওই নেতা নির্যাতনের শিকার একজনকে হুমকি দিয়ে ক্যাম্পাসছাড়া করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন আগে অন্তত ২৩ জন ছাত্রকে নির্যাতন করে তাঁদের জিনিসপত্রসহ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা হল থেকে বের করে দেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সামিউল ইসলাম নামের ফোকলোর তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রকে গত ২৫ জানুয়ারি ছাত্রলীগের কর্মীরা নির্যাতন করেন এবং ১০ হাজার টাকার দাবি করেন, না দিলে হত্যা করার হুমকি দেন। এছাড়া নিকট অতীতে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হাতে ধর্ষণ ও হত্যা-জাতীয় ঘটনা বারবার ঘটেছে। সিলেটের এমসি কলেজে সংঘটিত ধর্ষণের কথা গণমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে এসেছে। ২০১৯ সালে বুয়েটে ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে রাতভর নির্যাতনের শিকার হয়ে মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদের মৃত্যুবরণের কথাও সহজে ভোলার নয়। ওদিকে কিছুদিন আগে ইডেন গার্লস কলেজে ছাত্রলীগের নেত্রী ও অনুসারীদের হাতে নির্যাতিত হয়ে কয়েকজন ছাত্রী সাংবাদিক সম্মেলন ডাকেন। সেখানে ছাত্রলীগের নেত্রীর বিরুদ্ধে হলের সিট-বাণিজ্যের অংশ হিসেবে শুধু শারীরিক নির্যাতন নয়, সিটপ্রার্থী ছাত্রীদের ‘যৌনদাসী’ হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বদ্ধ ঘরে নির্যাতনের ঘটনায় একই ধরনের নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখান। তাঁরা তদন্ত কমিটি গঠন করেন, যা মূলত অপরাধটাকে একটি দীর্ঘসূত্রতার মধ্যে ফেলে সমাধানহীন ও বিস্মৃত করে তোলে। অপরাধ সংগঠন হলে তৎক্ষণাৎ ব্যবস্থা না নেওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও প্রতিষ্ঠানের হোস্টেলে অপরাধকারীকে আরও বেশি অপরাধে উৎসাহিত করে। অন্যদিকে নির্যাতনের শিকার ছাত্রছাত্রীর জন্য তাঁর নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ক্লাস শেষে পড়া ও বিশ্রামের ‘নিশ্চিন্ত’ স্থানটি শ্বাপদসংকুল হয়ে ওঠে। তাঁকে ভয়াবহ মানসিক আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাতে হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে সুস্থ থাকা ও লেখাপড়ায় মনোযোগ দেওয়া তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে ওঠে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রচুর অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংগ্রামের মাধ্যমে একটি সন্তানকে লালন করে জীবনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে দেশের সর্বোচ্চ কোনো বিদ্যাপীঠে পাঠানোর পর পিতা-মাতা যদি নিশ্চিন্তে থাকতে না পারেন, তবে তা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সার্বিক সরকারযন্ত্রের চরম ব্যর্থতাই প্রমাণ করে।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close