প্রবন্ধ

‘জব ভাউচার’ প্রথা

|| ফারুক আহমদ ||
লেখক: গবেষক। বিলেতবাসী।

পাকিস্তান ও অন্যান্য ব্রিটিশ কমনওয়েলথ দেশের নাগরিকরা বিশ শতকের পাঁচের দশকের শেষ পর্যন্ত অবাধে ব্রিটেনে আসা-যাওয়া ও বসতি করতে পারতেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ব্রিটিশ অর্থনীতিকে নতুন করে দাঁড় করানোর জন্য ব্রিটিশ সরকারও এসব নাগরিককে বিলাতে আসতে উৎসাহও দিতেন। কিন্তু আমরা ইতোমধ্যে দেখেছি, বহিরাগত কালো মানুষের আগমনে বিলাতে বর্ণবাদী ও ফ্যাসিবাদী শক্তির বিকাশ লাভ করে। বহিরাগতদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও অসামাজিক তৎপরতা বেড়ে যায়। ১৯৪৮ সালের ব্রিটিশ নাগরকিত্ব তখনও বলবৎ ছিল বলে পৃথিবীর বহু দেশে ‘কমনওয়েলথ নাগরিক’ ও ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন, যাদের বিলাতে আসার অধিকার ছিল। এই পরিস্থিতি মোকাবিলা জন্যে সরকার তৎপর হয় এবং ১৯৬২ সালের কমনওয়েলথ ইমিগ্রেশন আইন পাস করে। এর বলে, যাদের কমনওয়েলথ পাসপোর্ট ছিল তাদের ব্রিটিশ নাগরিক হবার অধিকার খর্ব করা হয় এবং কমনওয়েলথের নাগরিকরা কোনো অপরাধ করলে আদালতের সুপারিশে তাদের বিলাত থেকে ডিপোর্ট করার ব্যবস্থা করা হয়। এবং মুখ্যত নতুন (বা কালো) কমনওয়েলথের নাগরিকেরা এ দেশে আসতে চাইলে তাদের দরখাস্ত করে, উপযুক্ত ‘জব ভাউচার’ নেয়া বাধ্যতামূলক করা হয়।

এই আইনে, ১৯৬২ সালের ১ জুলাইয়ের পর কারো চাকুরির জন্য ব্রিটেনে আসার ব্যাপারে কিছু শর্ত ছিল। প্রথমে, বিলাতে পৌঁছার আগেই তাঁকে দেখাতে হবে যে, কোনো বিশেষ কাজের জন্য দক্ষ এবং এদেশের শ্রম-বাজারের কোনো বিশেষ অভাবটি তিনি পূরণ করতে সক্ষম। এতে সফল হলে, ব্রিটিশ নিয়োগদাতার নিকট থেকে তাকে আমন্ত্রণপত্র বা ‘জব ভাউচার’ (বা ‘অ্যামপ্লয়মেন্ট ভাউচার’) জোগাড় করতে পারবেন। ভাউচার পাবার পর তিনি বিলাত আসতে পারবেন।
নতুন আইনে ‘অ্যামপ্লয়মেন্ট ভাউচার’ নিয়ে বাঙালি মালিকদের প্রত্যেকটি রেস্টুরেন্টের জন্য কমপক্ষে তিন জন দক্ষ কিংবা অদক্ষ শ্রমিক পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ববাংলা) থেকে বিলাত নিয়ে আসার সুযোগ ছিল। আইনটি কার্যকর হওয়ার পরে মিনিস্ট্রি অব লেবার থেকে কমনওয়েলথভুক্ত পাকিস্তান থেকে ১৯৬২ সালের জুলাই মাস থেকে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত দরখাস্তকারীর সংখ্যা, ইস্যু-করা ভাউচার ও ভাউচারে বিলাতে আগতদের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তা হচ্ছে :

এ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, সর্বমোট ১৬৪,০৬০ জন পাকিস্তানি দরখাস্তকারীর মধ্যে ভাউচার ইস্যু করা হয়েছিল মাত্র ২৫,০৯০ জনকে। এর মধ্য থেকে বিলাতে আসেন মাত্র ১৭,১০৭ জন। অর্থাৎ ইস্যুকরা ভাউচারের শতকরা প্রায় (৩১.৮২) ভাগ মানুষই বিলাতে আসতে পারেননি। এর কারণ কী?
প্রথম ও প্রধান কারণ, পাকিস্তান সরকার এই শ্রমিকদের ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্ট দিত না।
দ্বিতীয় প্রধান কারণ, এক শ্রেণির শ্রমিক বিলাতে আসার জন্য খরচ জোগাড় করতে পারেননি।

সিলেট বিভাগ থেকে আগতদের ভৌগোলিক অবস্থান:
এ সময় যারা পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশ থেকে বিলাতে আসেন তারা বিশেষ কয়েকটি এলাকার অধিবাসী ছিলেন। এসব এলাকায় প্রধানত কিছু শ্রমজীবী মানুষ ছিলেন, কর্মসূত্রে আগে থেকেই যাদের ইংল্যাণ্ডে আসা-যাওয়া ছিল। শুধু তাদের আত্মীয়-স্বজনরাই বিলাত আসার সুযোগ নিয়েছিলেন। যেমন— তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের সিলেট (জেলা) থেকেই অধিকাংশদের আগমন ঘটে। সেই ‘সিলেট জেলা’ বলতে বর্তমান বৃহত্তর সিলেট বা সিলেট বিভাগ। এ বিভাগটি প্রবাসী-প্রধান অঞ্চল পরিচিত হলেও বিলাতে এসেছিলেন এর মাত্র কয়েকটি থানার হাতেগোনা কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ। এ বিভাগের কোন কোন এলাকা থেকে মানুষ বিলাতে এসেছেন, এর একটা পরিচয় নীচে দেয়া হলো:

সিলেট জেলা :
বর্তমান ১৩টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এই জেলার প্রবাসী-প্রধান (বা জনপ্রিয়ভাবে ‘লণ্ডনি’) অঞ্চল হচ্ছে: বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ, বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ— এই চার উপজেলা। আবার, এ উপজেলাগুলোর সব কটি ইউনিয়নের মানুষ বিলাত আসেননি। যেমন— বালাগঞ্জ উপজেলা ১৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। কিন্তু বিলাতবাসীদের মূল স্রোতটি আসে উমরপুর ও সাদিপুর ইউনিয়ন থেকে। লন্ডনে এদের বসবাস টাওয়ার হ্যামলেটস বারার স্পিটালফিল্ড বাংলা টাউন ওয়ার্ড এবং ক্যামডেন টাউন বারায়।
বিশ্বনাথ উপজেলার আটটি ইউনিয়নের প্রবাসীপ্রধান ইউনিয়নগুলো হচ্ছে দৌলতপুর, দশঘর ও বিশ্বনাথ— প্রধানত এ তিনটি ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নগুলোর বাসিন্দারা মূলত ব্র্যাডফোর্ড ও ওল্ডহ্যাম এবং আংশিকভাবে বার্মিংহাম, লুটন লিডস্্ ও পূর্ব লন্ডনে বসতি করেছেন।
বিয়ানীবাজার উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে বিলাত আসেন প্রধানত মাথিউরা এবং আংশিকভাবে কুড়ারবাজার ও মুল্লা¬পুর ইউনিয়ন থেকে। পূর্ব লণ্ডনের শেডওয়েল ছাড়াও এদের বসবাস দক্ষিণ লন্ডনের ক্ল্যাপহ্যাম এবং মিডিল সেক্সের অ্যান্ডফিল্ড এলাকায়।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার এগারোটি ইউনিয়নের মধ্যে প্রধান গ্রুপটি অথবা বলা যায় নব্বই শতাংশ মানুষই বিলাত আসেন পূর্ব আমুড়া ইউনিয়ন (বর্তমান বুধবারি বাজার ইউনিয়ন) থেকে। এদের বড় অংশের বসবাস টাওয়ার হ্যামলেটস বারার প্রধানত পপলার ও শেডওয়েল এলাকায়।

হবিগঞ্জ জেলা:
আটটি উপজেলা নিয়ে গঠিত হবিগঞ্জ জেলার প্রবাসীপ্রধান উপজেলা হচ্ছে নবীগঞ্জ। ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই নবীগঞ্জ উপজলার বিলাতবাসী মূল জনগোষ্ঠী আসেন কুর্শি, ইনাতগঞ্জ ও দীঘলবাগ প্রধানত এই তিনটি ইউনিয়ন থেকে। এরা ব্যাপকভাবে ওল্ডহ্যাম এবং আশিংকভাবে ইংল্যান্ডের অন্যান্য এলাকায় বসতি স্থাপন করেছেন।

সুনামগঞ্জ জেলা :
১১টি উপজেলা নিয়ে সুনামগঞ্জ জেলার প্রবাসী-প্রধান থানা হচ্ছে জগন্নাথপুর ও ছাতক। আটটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত জগন্নাথপুর উপজেলা থেকে বিলাতে আসেন মূলত মিরপুর ইউনিয়ন ও সৈয়দপুর-শাহারপাড়া ইউনিয়নের লোক। এরা আংশিকভাবে পূর্ব লন্ডন এবং ব্যাপকভাবে সান্ডারল্যাণ্ড বসবাস করেন। একইভাবে ১৩টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত ছাতক উপজেলার প্রধান অংশটি আসেন প্রধানত ছৈলা-আফজলাবাদ ইউনিয়ন থেকে।

মৌলভীবাজার জেলা:
মোট সাতটি উপজেলা নিয়ে গঠিত। কিন্তু বিলাতবাসী অধ্যুষিত উপজেলা হচ্ছে মাত্র দুটি— মৌলভীবাজার ও রাজনগর। মৌলভীবাজার সদর উপজেলা ১২টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। কিন্তু বিলাতবাসী হন শুধু একাটুনা ইউনিয়নের লোকজন। এই ইউনিয়নের প্রায় ৯৫ শতাংশ লোকই যুক্তরাজ্যবাসী। ওদিকে আটটি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত রাজনগর উপজেলার বিলাতবাসী মূল জনগোষ্ঠী আসেন মুন্সিনগর ইউনিয়ন থেকে। উল্লিখিত দুটি ইউনিয়নের লোকেরা প্রধানত লন্ডনের ক্যামডেন এবং ইংল্যান্ডের পোর্সমাউথ, সোয়ানসি, ব্রিস্টল ও কার্ডিফে বসবাস করেন।
এসব গ্রামের মানুষ, যারা ভাউচার পেয়েছিলেন, তাদের সকলেই নিজ বা পরিবারের জমানো টাকা দিয়ে রাহা-খরচের ব্যবস্থা করতে সক্ষম ছিলেন না। অনেককেই স্থানীয়ভাবে ধার-কর্জ কিংবা জমি বিক্রি করতে হয়েছিল। কিন্তু একই এলাকার হাতেগোনা কিছু গ্রাম থেকে একই সময়ে এত মানুষ বিদেশ যাবার ‘জব ভাউচার’ পাওয়ায় তাদের কারো কারো পক্ষে ধার-কর্জ বা জমির ক্রেতা পাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে ওঠে। ফলে রাহা-খরচের টাকা জোগাড় করা সম্ভব না হওয়ায় ভাউচার হাতে পেয়েও অনেকে বিলাতে আসতে পারেননি।
(বিলেতে বাঙালি অভিবাসন গ্রন্থ থেকে সংকলিত: ফারুক আহমদ)

Sheikhsbay
Back to top button
Close
Close