সিনজো আবে’র বিদায় ও রাজনীতির শিক্ষা

সম্পাদকীয় ।। ইস্যু ২২৫৯
রাজনীতি ব্যক্তিকে ক্ষমতাশালী করে। রাষ্ট্রনায়ক বানায় কিংবা সরকার প্রধান। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদ যিনি সুশাসন কায়েম করেন, দিনশেষে তিনিও তার জনতার কাছে পুরোপুরি নিরাপদ নন। রাজনীতি এক নির্মম খেলা। এই নির্মম শিক্ষা সর্বশেষ আমরা পেলাম জাপানি প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে’র নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। মহাসড়কে আপনি যত ভালো গাড়ি চালান না কেন, যে কোন অপ্রকৃতিস্থ চালকের বেপরোয়া কান্ডের জন্য যে কারো জীবন বিপন্ন হতে পারে। সমাজ বা রাষ্ট্রও তেমনি। অনেক দয়ালু, গণমুখী, দুর্নীতিমুক্ত আর মানবদরদী রাজনীতিবিদ হয়েও একজন রাজনীতিক তার ভালোবাসার জনতার মধ্যে এক দুজন রং হেডেড মানুষের কারণে নৃশংসতার মুখোমুখি হতে পারেন।
সিনজো আবে’র সন্দেহভাজন ঘাতক এক সময় জাপানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলো। জাপানি সমাজ জীবনে চার্চের গুরুত্ব বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সিনজো আবে’র ভূমিকায় ওই ঘাতক ক্ষুব্ধ হয়েছিলো। তার ধারণা(!) ছিল, চার্চের কারণেই তার মা দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছিলো।
শুধু জনপ্রিয়তাই শেষ কথা নয়। রাজনীতিকদের জীবন অন্য আর দশজন মানুষের জীবনের চেয়ে মর্যাদাবান। পাশাপাশি একই কারণে অনেক অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। যৌক্তিক বা অযৌক্তিক ভালোবাসা, পাশাপাশি ঘৃণা ও জিগাংসা তাদের আক্রান্ত করে অনেক সময় কোনো কারণ ছাড়াই। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী অফিসে কিংবা অফিসের বাইরে কোথাও আসলে পুরোপুরি নিরাপদ থাকতে পারেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লিংকন থেকে জন এফ কেনেডি, ফরাসি নেতা দ্যা গল, দক্ষিণ এশিয়ায় ইন্দিরা থেকে রাজীব গান্ধী, আর পার্শ্ববর্তী পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবারের একাধিক সদস্যের নৃশংস হত্যাকাণ্ড রাজনীতিকদের জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ বাস্তবতা বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়।সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে জনস্বার্থে নিবেদিত রাজনীতিকরা এ কারণেই সাধারণ মানুষের চেয়ে বাড়তি মনোযোগ ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা আশা করতে পারেন।
সিনজো আবে দুই দফায় জাপানে নয় বছর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকার পরিচালনা করেন। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই রাজনীতিক সততা, নিষ্ঠা ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে শুধু জাপানি জনগণ নয় শান্তিপ্রিয় বিশ্ববাসীর একটি বড় অংশের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন। তিনি কত বিবেকবান রাজনীতিবিদ ছিলেন তার প্রমাণ আমরা পাই ২০১৪ সালে তাঁর বাংলাদেশ সফরকালে। বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপানের নিঃস্বার্থ সহযোগিতা খুব গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়। ওই বছর সফরে গিয়ে তিনি ঢাকায় মেট্রো রেলসহ একাধিক মেগা প্রকল্পে জাইকার মাধ্যমে জাপান সরকারের সহায়তা নিশ্চয়তা দেন। এই সফরকালে তিনি বিরোধী দলের প্রকৃত নেতা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতে তার দূতাবাসকে নির্দেশনা দেন। সেই মোতাবেক তারা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও জননন্দিত নেত্রী অথচ সে সময়ে কোনো প্রটোকলবিহীন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সিনজো আবে’র সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। সরকারের অনেক বাধা সত্ত্বেও শুধুমাত্র জাপানি জননন্দিত প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ এবং দু’দেশের মানুষের বন্ধুত্বের শপথ থেকে ওই বৈঠকটি দীর্ঘ সময় নিয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। কূটনীতি ও রাজনীতির বাইরে মানুষের মধ্যে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে সিনজো আবে বাংলাদেশ জাপান তথা বিশ্বের অন্যান্য মানুষের কাছে অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন।
মানুষের জন্য রাজনীতিবিদদের আত্মত্যাগের ইতিহাসে সিনজো আবে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবেন। সাপ্তাহিক সুরমার পাঠক শুভানুধ্যায়ী ও সুরমা পরিবারের পক্ষ থেকে মহান জাপানি রাজনীতিবিদ সিনজো আবের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।