
।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ২০ জুলাই : অস্কার খ্যাত ব্রিটিশ কারি এওয়ার্ডের প্রবর্তক এনাম আলী এমবিই আর নেই। দুরারোগ্য লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দুই সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ১৭ জুলাই, রোববার ভোর রাত তিনটায় সারের একটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো প্রায় ৬২ বছর। তিনি স্ত্রী, এক মেয়ে ও দুই ছেলেসহ চার ভাই, তিন বোন এবং অসংখ্য আত্মীয় স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
পরিবর্তিত ঘোষণা অনুযায়ী ২২ জুলাই, শুক্রবার বাদ জুম‘আ ইস্ট লণ্ডন মসজিদে মরহুমের প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর এপসম সেমিট্রিতে দ্বিতীয় জানাযা শেষে তাকে সেখানে দাফন করা হবে বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে। এর আগে ১৯ জুলাই, মঙ্গলবার জানাযার দিন ধার্য করা হয়েছিলো। তাঁর দাফনের জন্য নির্দিষ্ট এপসমের সেমিট্রির একজন কর্মীর কোভিড ধরা পড়ায় তা পরিবর্তন করা হয় বলে জানা যায়।
কারিশিল্পের এই পথিকৃত ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ প্রায় পুরো কমিউনিটি। তাঁর মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ব্রিটিশ-বাংলাদেশী কমিউনিটির পক্ষ থেকে আবেগমথিত শোক ও সমবেদনা জ্ঞাপন অব্যাহত রয়েছে। বৃটেনে বাংলাদেশের হাইকমিশন, লণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে শোক প্রকাশ করা হয়েছে।
বৃটেনে কারিশিল্পের ব্যাপক পরিচিতি ও উত্থানে ব্যক্তিগতভাবে মরহুম এনাম আলীর একক অবদান সর্বজন স্বীকৃত। তাঁর হাত ধরেই ব্রিটিশ মূলধারার মিডিয়া থেকে শুরু করে রাজনীতির অন্দরমহল ১০ নাম্বার ডাইনিং স্ট্রিটের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয় পর্যন্ত পৌঁছে দেয় বাংলাদেশী রন্ধনশিল্পীদের সুস্বাদু টিক্কা মসলা ও ভিন্দালুর লোভাতুর সুঘ্রাণ ও সুখ্যাতি। একই সাথে ওই শিল্পের কারিগরদের কদর ও কাজের গুরুত্ব ব্যাপকভাবে উপস্থাপিত হয় তাঁর শৈল্পিক ও কৌশলী উপস্থাপনায়। স্টাফ সংকটসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত কারিশিল্পের উন্নয়নে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন থেকে শুরু করে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে ও সদ্য পদতাগী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সাথে ঘনিষ্টভাবে কাজ করে গেছেন এনাম আলী। এনাম আলীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তাঁরই প্রবর্তিত ব্রিটিশ কারি এওয়ার্ডকে অস্কার বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। কারিশিল্প ছাড়াও ব্রিটিশ-বাংলাদেশীদের অগ্রগতি কল্পে বিভিন্নভাবে সক্রিয় ভূমিকা রেখে গেছেন মরহুম এনাম আলী, যা অনেকদিন বিলেতের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
মরহুম এনাম আলীর ঘনিষ্ট বন্ধু সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম লিখিতভাবে জানিয়েছেন যে, “বাংলাদেশ তথা এশিয়ান রন্ধন শিল্পকে ব্রিটিশ মূলধারার অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারিগর ছিলেন এনাম আলী।তিনি নব্বই দশকের শুরুতে গিল্ড অব বাংলাদেশী রেস্টুরেটসর গঠন ও এর মাধ্যমে হাউজ অব কমন্সে “ডাইন বাংলাদেশ” ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট ব্যবসাকে স্বনামে পরিচিতি করার কাজে হাত দেন। তিনি প্রথমত শেফ অব দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হয়ে লাইম লাইটে আসেন এবং সেই সময়ে লীরাজ এভিয়ন নামে উড়ন্ত রেস্টুরেন্টের জন্ম দিয়ে ব্রিটিশ মিডিয়ায় আলোড়ন সৃষ্টি করেন।
এনাম আলী ১৯৯৮ সালে রেস্টুরেন্ট ম্যাগজিন স্পাইস বিজনেস প্রকাশের মাধ্যমে ব্রিটিশ অর্থনীতির নিয়ামক শক্তি বাঙালির কারী ইন্ডাষ্ট্রিকে ব্রিটিশ মূলধারায় নিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম শুরু করেন। সারের বিখ্যাত লী রাজ রেষ্টুরেন্টের স্বত্বাধিকারী স্বপ্নবাজ মি. আলী স্পাইস বিজনেস প্রকাশনা শুরু করেই ক্ষান্ত হননি, কারী ইণ্ডাষ্ট্রিকে ব্রিটেনসহ বিশ্ব নাগরিকদের মনোযোগের কেন্দ্রে নিয়ে যেতে চালু করেন ঝাকঝমকপূর্ণ বার্ষিক এওয়ার্ড অনুষ্ঠান ‘ব্রিটিশ কারী এওয়ার্ড’। বিগত ১৬ বছর ধরে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত এই এওয়ার্ড অনুষ্ঠানগুলোতে কয়েকজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সহ মেইন ষ্টীম রাজনীতিবিদসহ হাই প্রোফাইল সেলিব্রেটিরা অংশ নিয়ে আসছেন।কারী ইন্ডাষ্ট্রির সাথে জড়িতদের মূলধারায় স্বীকৃতি সর্ব প্রথম ব্রিটিশ কারী এওয়ার্ডের মাধ্যমেই শুরু হয়।
কারী শিল্পে অনন্য অবদানের জন্য ২০০৯ সালে এই কারি কিংবদন্তী ভূষিত হন এমবিই খেতাবে। ২০১১ সালে তাকে ‘ফ্রিডম অব দ্যা সিটি অব লণ্ডন’ সম্মাননায় সম্মানিত করা হয়। তিনি সব সময় বাংলাদেশী কমিউনিটির স্বার্থ সংরক্ষনে তৎপর ছিলেন। ২০১৭ সালে অক্টোবরে তিনি বিবিসিসিআই’র প্রেসিডন্ট নির্বাচিত হলে সিলেট চেম্বারের সাথে যৌথ ভাবে সিলেটে এনআরবি কনভেনশন এনআরবিদের নিয়ে বিশ্ব সম্মিলনীর আয়োজনটি ছিল ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। যেখান থেকে এনআরবি ডে’র ঐতিহাসিক ঘোষণা উচ্চারিত হয় আজকের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন সাহবের মুখ দিয়ে।”
উল্লেখ্য, মরহুম এনাম আলী পরিবারকে নিয়ে বসবাস করতেন লণ্ডনের সারে এলাকার কিংসউডে। বাংলাদেশের বাড়ি ছিলো সিলেট সদরের নিকটবর্তী মগলা বাজার এলাকার নইখাই গ্রামে। বেড়ে ওঠা ও বসবাস সিলেট নগরীর জিন্দাবাজার এলাকায়।
বাংলাদেশ হাইকমিশনের শোক:
বিশিষ্ট ব্রিটিশ-বাংলাদেশী উদ্যোক্তা এবং ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডের প্রবর্তক এনাম আলী এমবিই-এর মৃত্যুতে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এক শোকবার্তায় হাইকমিশনার বলেন— বিশিষ্ট ব্রিটিশ-বাংলাদেশী উদ্যোক্তা এবং ব্রিটিশ কারিশিল্পের নন্দিত নেতা জনাব এনাম আলী এমবিই-এর আকস্মিক মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে মর্মাহত এবং শোকাহত। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
তিনি বলেন, জনাব এনাম আলী শুধুমাত্র মর্যাদাপূর্ণ ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডের প্রবর্তকই ছিলেন না, তিনি ব্রিটেনের মূলধারায় বাংলাদেশি কারি শিল্পের ব্র্যাণ্ডিং এবং প্রোফাইলিংয়ের ক্ষেত্রেও অসাধারণ ও অনুসরণীয় ভূমিকা রেখে গেছেন। জনাব এনাম আলী তাঁর অনুকরণীয় নেতৃত্ব, অনুপ্রেরণামূলক উদ্যোগ, নিবেদিত জনহিতকর কাজ এবং কমিউনিটি সেবার জন্য শুধু ব্রিটিশ-বাংলাদেশী কমিউনিটির মধ্যেই নয়, ব্রিটেনের মূলধারার হসপিটালিটি সেক্টরেও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
তিনি আরো বলেন, আমি আশা করি, মরহুম জনাব এনাম আলীর জীবন এবং কর্ম তরুণ ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের ব্রিটিশ কারি শিল্পের প্রচারে ও প্রসারে এবং কমিউনিটির সেবায় নেতৃত্ব গ্রহণে অনুপ্রাণিত করবে।
হাইকমিশনার মরহুমের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং বাংলাদেশ হাই কমিশন, লণ্ডনের পক্ষ থেকে তাঁর শোক-সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়ে বলেন, আমি মহান আল্লাহ ত‘য়ালার দরবারে মরহুম জনাব এনাম আলীর জান্নাতুল ফেরদৌস প্রাপ্তির জন্যও বিশেষভাবে প্রার্থনা করছি।
লণ্ডন-বাংলা প্রেসক্লাবের শোক:
ব্রিটিশ কারি অ্যাওয়ার্ডসের প্রবর্তক মরহুম এনাম আলী এমবিই ছিলেন লণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের জীবন সদস্য। ক্লাবের একজন জীবন সদস্য ও শুভাকাঙক্ষী হিসেবে যুক্তরাজ্যের স্বনামখ্যাত ব্যবসায়ী এনাম আলী এমবিই’র মৃত্যুতে লণ্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে নেতৃবৃন্দ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। ক্লাব সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদ ও কোষাধ্যক্ষ সালেহ আহমেদ এক শোকবার্তায় মরহুমের রুহের মাগফেরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও সমবেদনা জ্ঞাপন করেন । তাঁরা এই কঠিন সময়ে মরহুমের স্বজনদের ধৈর্য ধারণের শক্তিদানের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করেন।
ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশীজ‘র শোক:
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা, অস্কার খ্যাত ব্রিটিশ কারি এওয়ার্ডের প্রবর্তক এনাম আলী এমবিই‘র মৃত্যুতে ভয়েজ ফর গ্লোবাল বাংলাদেশীজ এর পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয়েছে। এক শোকবার্তায় সংগঠনটির চেয়ার, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. হাসনাত হোসেন এমবিই কমিউনিটিতে মরহুম এনাম আলী অন্যন্য অবদান স্মরণ করে গভীর শোক প্রকাশ করে তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন। একই সাথে তিনি মরহুমের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তাদের ধৈর্য ধারণের তৌফিক দানে মহান আল্লাহ পাকের সাহায্য কামনা করেন।