ফিচার

প্রাণের শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক

|| ডরিনা লাইজু ||
লেখক: বিভাগীয় সম্পাদক, সপ্তাহিক সুরমা

সংগীত বা গানকে যারা ভালবাসেন তারা জানেন এর মাঝে বিরাজ করে এক অকৃত্রিম সন্জীবনি সুধা, যা কিনা মানুষকে নতুন উদ্যমে ভরপুর করে তোলে। সংগীত মস্তিস্কে এক ধরনের অনুরণন ঘটিয়ে মানুষকে আন্দোলিত করে, পরিশীলিত করে বিশালতার ছোয়ায় এবং অনতিক্রম্য দূরকে সন্নিকটে এনে বিস্তৃতি ঘটায় সমাজ চিন্তার আর সেই সাথে বিশ্বব্যাপী মানবিক বন্ধনকে সুদৃঢ় এবংশক্তিশালী করে তোলে। বিশ্বব্যাপী মানববন্ধন তৈরীর অদৃশ্য মাধ্যম সুরের এই ধারার প্রতি রয়েছে আমার এক দুর্দান্ত টান। কোন তাল বা কোন রাগের গান তা যদিও বুঝতে পারিনা তারপরও গানের প্রতি রয়েছে আমার এক প্রচন্ড অনুরাগ। সেই ভালোলাগা থেকেই খুব ছোট বেলা থেকে গান শুনি, গুন গুন করে গাইতাম আর স্বপ্ন দেখতাম একদিন গানের শিল্পী হবো, যাই হোক শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি।

সব ধরনের গানই কমবেশী শুনে থাকি। প্রিয় শিল্পীর তালিকায় রয়েছেন অনেকেই। তাঁদের কেউ কেউ চলে গেছেন চিরবিদায় নিয়ে, আবার এখনো গান গেয়ে চলেছেন অনেকেই। তাঁদেরই একজনকে নিয়ে আজ দুটো কথা লিখতে চাই। বানিজ্যিক প্রতিযোগিতার বিচারে নয়, বরং এই শিল্পী তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও বহুমাত্রিকতার আঙ্গিকে মূল্যায়নের দাবি রাখেন। তাঁর গানে রয়েছে এক ভিন্ন মাত্রা, এক নিগূঢ় নির্যাস, যে নির্যাস হৃদয়ের মাঝে তৈরী করে অনাবিল স্রোতধারা যা কিনা ব্যক্তিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বিশালতার সলিলে। তিনি আর কেউ নন, তিনি — মৌসুমি ভৌমিক। সম্প্রতি বিলেতের সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকার অফিসে এই প্রথিতযশা শিল্পীর একান্ত সান্নিধ্য লাভের সুযোগ হয়েছিলো। গল্প, গান আর আড্ডায় সেই ক্ষণটি হৃদয়ের মাঝে প্রিয় স্মৃতির তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছে। মৌসুমী ভৌমিকের ব্যাক্তিগত সান্নিধ্য লাভ এবং তাঁর গান শুনে তার শিল্পী সত্বা সম্পর্কে যে অনুভূতি অনুভব করেছি তা আজ তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নিয়েও বাংলা গানের প্রতি তাঁর যে ভালোবাসা তা সত্যিই আমাকে অভিভূত করে। তাঁর গানে বাংলা এবং ইংরেজী বা পপ গানের মিশ্রণের মাধ্যমে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। যে কারণে সকল বয়সী মানুষের পাশাপাশি বিদেশেও তার গানের সমাদর রয়েছে সমানভাবে। তাঁর গানের বিশেষত্ব হচ্ছে, তাঁর গান বাদ্যযন্ত্র অপেক্ষা কন্ঠ নির্ভরতা বেশী। সচরাচর সংগীতে অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারের কারণে কণ্ঠ হারিয়ে যায়। তবে মৌসুমী ভৌমিকের গানে পরিমিত বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষনীয়। বাদ্যযন্ত্র কখনই তাঁর কন্ঠকে ছাপিয়ে যায় না। তিনি মিহি সুরেলা কন্ঠে গাওয়ার চাইতে প্রানখুলে দরাজ গলায় উদাত্ত অনূভুতির সাথে গাইতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, যা কিনা তাঁর গানের সাথে শ্রোতাদের সংযোগ স্থাপনে এক অনবদ্য ভূমিকা রাখে।

মৌসুমী ভৌমিকের গান মানুষকে প্রাণবন্ত করে তুলে, ক্লান্তি দূর করে উজ্জীবিত করে।তাঁর গানের কথাগুলো গানের বাইরে গিয়েও মানুষ কে ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে। যেমন তাঁর বৃষ্টি পড়ে রে… গানটির কথা ধরা যাক, অত্যন্ত সহজ সরল কথায় সেতারের মূর্ছনয়ায় গানটি যেন গান নয় একটি অংকন শিল্পের প্রতিচ্ছবি হয়ে ভেসে ওঠে শ্রোতার মানস পটে। গানটি চোখের সামনে বৃষ্টিস্নাত ছোট্ট কোনো শহরের এক প্রাণবন্ত চিত্রকে ফুটিয়ে তোলে মনের মাঝে। শ্রোতা আবিষ্কার করে গানের মাঝে নিজের অস্তিত্ব। ভেজা মাটির গন্ধ একেবারে জীবন্ত চিত্র হয়ে ধরা দেয় তার কাছে। সেই চিত্রের মাঝে শ্রোতা নিজেকেই অনূভব করে। গানের সাথ এক অবিচ্ছেদ্য টান অনুভব করে। গানের মাঝে নিজেকে খুঁজে পায়, আর এই খুঁজে পাওয়ার মাঝে গান আর প্রাণ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

সুরমার সম্পাদক শামসুল আলম লিটন, শিল্পী মৌসুমী ভৌমিক ও বিভাগীয় সম্পাদক ডরিনা লাইজু

এর পর বলা যাক যশোর রোড গানটির কথা। এক অভাবনীয় হিমশীতল অনূভুতি চকিতে নেমে যায় শিড়দাঁড়া বেয়ে, আমি যুদ্ধ দেখিনি অথচ তাঁর গানে যুদ্ধের ভয়াবহ চিত্র এবং অসহায় মানুষের করুন আর্তি—নিদারুন কষ্ট, ভীত সন্ত্রস্ত চোখ নিমিষেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, এবং তা শুধু মাত্র একটি নির্দিষ্ট দেশ কালের জন্য প্রযোজ্য নয় বরং সর্বকালীন রুপে শ্রোতার অন্তরে ঠাঁই করে নেয়। কাঁটাতারের সীমানা ডিংগিয়ে বিস্তৃতি লাভ করে অসীমের মাঝে, ভাবতে বাধ্য করে ভৌগোলিক ভেদাভেদ ভুলে। এইতো সেদিন শুনছিলাম যশোর রোড গানটি অথচ আমার মনোজগতে ভেসে উঠেছিলো বর্তমান যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ইউক্রেনের রাস্তাঘাট আর মানুষের মুখচ্ছবি। গানটি যদিও বাংলাদেশের যুদ্ধচলাকালীন প্রেক্ষাপটকে চিত্রিত করেছে, কিন্তু তারপরও এ গান যেনো সর্বকালীন সকল যুদ্ধ, সকল ধ্বংস, সকল অসহায়ত্ব, সকল যোদ্ধা এবং সকল দখলদারিত্বের প্রতিচ্ছবিকেই বিবৃত করে।

মৌসুমী ভৌমিকের গানের মাঝে রয়েছে এক ধরনের নির্বাসনের অনুভূতি, গৃহহীনতা, ছন্নছাড়া মনোভাব, মনোজগতের কিছুটা টানাপোড়েনের অভিব্যক্তি যা কিনা ব্যক্তিকে ভাবায়, নাড়ায়, নিজের মাঝেই বিচ্ছেদ ঘটায়, এক ধরনের অপ্রাপ্তি বা শূন্যতায় ভরিয়ে তোলে। কোথায় যেনো নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবার এরই পাশাপাশি একই সাথে একধরণের উদ্দীপনাও বিরাজ করে, মানুষকে আশাবাদী করে তোলে, স্বপ্ন দেখায়, তাদের ভিতর বাচাঁর সাধ জাগায়।

এ প্রসংগে উল্লেখ করা যেতে পারে তার সেই জনপ্রিয় গানটির ক’টি লাইন— ‘আমি কখনো যাইনি নীলে, কখনো ভাসিনি জলে, কখনো রাখিনি চোখ ডানা মেলা গাং চিলে…/ আবার যেদিন তুমি সমুদ্র স্নানে যাবে আমাকেও সাথে নিও…/ নিবেতো আমায়? বলো নিবেতো আমায়?’

মৌসুমি ভৌমিকের ব্যক্তি জীবন যেমন খুব সাদামাটা তেমনি তাঁর গানের কথা এবং সুরও অত্যন্ত সহজ সরল। সেই সাথে একেবারে জীবন ঘনিষ্ট, যে কারণে শ্রোতাকূলের কাছে রয়েছে তাঁর ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা। তাঁর কথা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য তিনি গান করেন না, অথবা বিশ্বের সকলেই তার গান শুনবে বা পছন্দ করবে এটাও তিনি আশা করেন না। কোনো অলি-গলিতে বা কোনো এক কোনায় বসে যারা তাঁর গান শোনে তাদের জন্যই তিনি গান করেন, অথবা বলা চলে নিজের জন্যই তিনি গান করেন কিংবা গানকে ভালোবেসেই তিনি গান করেন।

বাংলা গানের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর গান নিয়ে সুগভীর গবেষণা ক্রমেই তার গানকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। সংগীতের নানা শাখায় তাঁর বিচরণ। মরমী, লোকজ, বাউল এবং আধুনিক ধারার পাশাপাশি পপ কিংবা পশ্চিমা সংগীতের মিহি মিশ্রণ। এই সবগুলো ধারায় সার্থক বিচরণ বাংলা গানের জগতে তাঁকে এক অনন্য স্তরে উন্নীত করেছে। প্রাণের শিল্পী মৌসুমী ভৌমিকের সুস্বাস্থ্য এবং দীর্ঘ জীবনের জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে রইলো আমাদের প্রার্থনা।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close