নিউজ

মামলা লক্ষাধিক, আসামী বিএনপি’র ৩৬ লাখ : মামলাদেশ

* জোবায়দা রহমান ‘আইনের’ দৃষ্টিতে পলাতক * সবচে বেশি মামলা সোহেলের বিরুদ্ধে-২৫৭  * রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে মামলা দেড় শতাধিক * যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর ১৫৩ * সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল-১৩৪

।। সুরমা ডেস্ক ।।
লণ্ডন, ২ জুন : দলটির শীর্ষ নেতা থেকে তৃণমূলের অধিকাংশ নেতার নামে রয়েছে মামলা। কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবাই কারাগার ফেরত। অধিকাংশ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে আদালতে। চলছে বিচারকাজ। উচ্চ আদালতের আদেশে আটকে আছে অনেক মামলার বিচারকাজ। এসব মামলায় নিম্ন আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। হাজিরা না দেয়ায় জামিন বাতিল হচ্ছে অনেকের। সব মামলাতেই আসামি রয়েছেন শত শত। এদিকে, দলীয় প্রধান বেগম খালেদা জিয়াকে হত্যার হুমকির অভিযোগে সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশে করছে বিএনপি। সারা দেশে অনুষ্ঠিত প্রায় কর্মসূচিতেই হামলার অভিযোগ করেছে দলটি। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি স্থানে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। গত বৃহস্পতিবার খুলনা মহানগর বিএনপি’র এক সমাবেশে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে ব্যাপক সংঘর্ষ ও ভাঙচুর হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপি’র ৯২ জনের নাম উল্লেখসহ ৮৯২ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এ ছাড়া সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় মামলা হয়েছে। এতে আসামি করা হয়েছে দুই শতাধিক বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের। যদিও বিএনপি’র নেতারা বলছেন, এসব মামলা সত্ত্বেও তারা আন্দোলনে পিছপা হবেন না। আগামীর আন্দোলনের জন্য দলের নেতাকর্মীরা প্রস্তুত রয়েছে। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, ২০০৯ থেকে চলতি বছরের ১৭ই মে পর্যন্ত প্রায় ৩৬ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে এক লাখ ৬০৯টি মামলা হয়েছে। এ সময়ে অন্তত এক হাজার ৫২৯ জনকে হত্যা এবং কমপক্ষে এক হাজার ২০৪ জনকে গুম করা হয়েছে। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা ১১ হাজার ৩২৬ জনকে গুরুতর জখম ও আহত করা হয়েছে। নেতাকর্মীদের আইনি সহায়তা দিতে কাজ করছেন দলীয় অনেক আইনজীবী। 

বিএনপি’র অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ পুরোদমে মাঠে নিজেদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। অন্য দিকে বিএনপি নেতাদের যেকোনো কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হচ্ছে। হামলা চালানো হচ্ছে। দলীয় নেতাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় দ্রুত চার্জশিট দেয়া হচ্ছে। জামিনের মেয়াদ বাড়ানোসহ এসব মামলায় নিয়মিত আদালতেই থাকতে হচ্ছে তাদের। যাদের বিরুদ্ধে মামলা নেই তারাও ভয়ে আছেন। কারণ বেশির ভাগ মামলায় বিপুলসংখ্যক অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা নেই তাদের এসব অজ্ঞাতনামার অজুহাতে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়াতে বর্তমানে অনেক নেতাই বাড়িছাড়া।

সূত্র মতে, বিএনপি’র চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৭টি। এরমধ্যে দুটি মামলায় তার সাজা হয়েছে। উচ্চ আদালতে ১৬টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তার বিরুদ্ধে মূলত মামলা হয়েছে দুর্নীতি, মানহানি, রাষ্ট্রদ্রোহসহ হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার অভিযোগে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে মামলা হয়েছে ৬৭টি। তিনি বর্তমানে লন্ডনে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৮৬টি। এরমধ্যে ৩৫টি মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে উচ্চ আদালতে। বাকিগুলো চলমান। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে রয়েছে ১১টি মামলা। ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে ৪টি, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার বিরুদ্ধে ৬টি, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ৫৪টি। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৫৯টি। নজরুল ইসলাম খানের বিরুদ্ধে ৩টি, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ১৩টি। সেলিমা রহমানের ৬টি, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর বিরুদ্ধে ৯টি এবং ভারতের শিলংয়ে অবস্থানরত সালাউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে ১৭টি মামলা রয়েছে। বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দেড় শতাধিক। সবচাইতে বেশি মামলা হয়েছে দলটির যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের বিরুদ্ধে ২৫৭টি। বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে ৪টি, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের বিরুদ্ধে ৪টি, আলতাফ হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে ৬টি, আবদুল্লাহ আল নোমানের বিরুদ্ধে ৪টি, বরকত উল্লাহ বুলুর ২৭টি, আবদুল আউয়াল মিন্টুর ৬টি এবং মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা রয়েছে। উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে ২৪টি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানের ১২৩টি, আব্দুস সালামের ৩৭টি, মিজানুর রহমান মিনুর ৩৭টি, জয়নাল আবেদিন ফারুকের ২৩টি, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকনের বিরুদ্ধে ১৩টি, মজিবুর রহমান সারোয়ারের ৫৭টি, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের ১৩৪টি ও খায়রুল কবির খোকনের বিরুদ্ধে ৫৭টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর ১০৭টি, আসাদুল হাবিব দুলুর ৫৭টি, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এবিএম মোশাররফের ৪৭টি, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরবের ৮৬, যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর ১৫৩, যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক সরকারের দেড় শতাধিক, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদির ভুঁইয়া জুয়েলের ৫৩টি এবং ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি’র সদস্য সচিব সাবেক ফুটবলার আমিনুল হকের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা রয়েছে।

বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন মানবজমিনকে বলেন, সামনে আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম রয়েছে। এ অবস্থায় দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীর নামে মামলা। নতুন করে আবারো মামলা হচ্ছে সারা দেশে। এটা দলের জন্য কিছুটা হলেও চাপ। যেকোনো দেশের স্বৈরাচার সরকার বিরোধী দলকে দাবিয়ে রাখার জন্য মামলা হামলার কৌশল গ্রহণ করে। তবে আমরা এই চাপকে মোকাবিলা করেই এ পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছি এবং সামনে অগ্রসর হবো। 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা আইনগতভাবে এই মামলাগুলো মোকাবিলা করছি। আমাদের মতো সিনিয়র লোকদেরও মাসে বেশ কয়েকবার কোর্টে যেতে হয় হাজিরা দিতে। 

দলটির আরেক স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমাদেরকে তো সরকার সব সময় চাপে রাখার চেষ্টা করছে এবং করবে। তারা এসব মামলা দিয়ে আমাদের ব্ল্যাকমেইলিং করবে। আমাদের নেতাকর্মীদের এখন তো তেমন কোনো চয়েজ নেই। হয় আন্দোলন, না হয় আদালতের বারান্দায় গিয়ে পচা। আমি মনে করি- বিএনপি’র কর্মীরা তাদের জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করবে- এই বানোয়াট মামলার প্রতি উত্তরের জন্য।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া ও পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের প্রধান উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন মানবজমিনকে বলেন, কোনো ঘটনা ঘটলে সেখানে যদি আইনশৃঙ্খলার কোনো অবনতি ঘটে এবং কেউ যদি দুর্বৃত্তায়ন করে, ভাঙচুর করে, আগুন সন্ত্রাস করে তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। যারা রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাবে, জন শৃঙ্খলা বিনষ্ট করবে তাদের বিরুদ্ধে আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।

জোবায়দা রহমান আইনের দৃষ্টিতে পলাতক

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমান আইনের দৃষ্টিতে পলাতক বলে এক রায়ে উল্লেখ করেছেন আপিল বিভাগ। আজ বুধবার রায়ের বিষয়টি জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। দুদকের করা এক মামলা বাতিল চেয়ে জোবায়দা রহমানের করা আবেদন (লিভ টু আপিল) খারিজ করে গত ১৩ এপ্রিল এ রায় দেন আপিল বিভাগ।

১৬ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়েছে জানিয়ে আজ খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘জোবায়দা রহমান আইনের দৃষ্টিতে পলাতক বলে রায়ে এসেছে। হাইকোর্টে যখন তিনি (জোবায়দা রহমান) হলফনামা করে আবেদনটি (মামলা বাতিল চেয়ে) করেন, তখন পলাতক ছিলেন। ওই মামলা আমলে (বিচারিক আদালতে) নেওয়ার আগে হাইকোর্টে শুনানি করা ঠিক হয়নি। কারণ, এটি একটি স্বতঃসিদ্ধ নীতি যে পলাতক আসামি কখনোই কোনো আবেদন বা মামলা যেকোনো আদালতে করতে পারেন না। এটাই এই রায়ের মোদ্দাকথা। তাঁকে আদালতের আওতায় এসে, অর্থাৎ আত্মসমর্পণ করে তারপর প্রার্থনা জানাতে হয়। আত্মসমর্পণ না করে হাইকোর্টে জোবায়দা রহমানের আবেদন করা আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ।’

আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আরও বলেন, আপিল বিভাগ এ–ও বলেছেন, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান ও আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকারী। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, জোবায়দা রহমানকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতের দায়িত্ব ছিল এ বিষয়গুলো খেয়াল করা, অথচ তা খেয়াল করেননি। মামলা আমলে নেওয়ার পরে জোবায়দা রহমানকে আট সপ্তাহের মধ্যে আত্মসমর্পণ করতে হাইকোর্টের নির্দেশনা–সংক্রান্ত প্যারাটি বাতিল করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।

জোবায়দা রহমানের অন্যতম আইনজীবী কায়সার কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে জোবায়দা রহমানকে পলাতক বলা হয়নি। তবে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো হাতে পাইনি। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর এ বিষয়ে বলা যেতে পারে।’

আইনজীবী সূত্র বলেছে, সম্পদের তথ্য গোপন ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান, জোবায়দা রহমান ও তাঁর মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় মামলাটি করে দুদক। পরের বছর তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। পরে মামলা বাতিল চেয়ে জোবায়দা হাইকোর্টে আবেদন করেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল হাইকোর্ট জোবায়দার আবেদন খারিজ করে তাঁকে আট সপ্তাহের মধ্যে বিচারিক আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরই লিভ টু আপিলটি করেন জোবায়দা।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close