মুক্তচিন্তা

টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতি: ইতিহাসের পুনর্পাঠ

ব্রিটিশ রাজনীতিতে 'এক নিষিদ্ধ বাংলাদেশীর' চমক লাগানো প্রত্যাবর্তন

|| নজরুল ইসলাম বাসন ||
লেখক: সাপ্তাহিক সুরমার সাবেক সম্পাদক

গত ৫ই মে ২০২২, টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিল নির্বাচনে লেবার পার্টির জন বিগসকে প্রায় ১১ হাজার ভোটের ব্যবধানে এ্যাসপায়ার পার্টির লুতফুর রহমান পরাজিত করেছেন। লুতফুর রহমান পেয়েছেন ৪১ হাজার ভোট। লুতফুর রহমানের বিজয়ে তার বাংলা প্রচার মাধ্যমে তার শুভাকাংখীরা যেমন উল্লসিত ও উচ্ছ্বসিত তেমনি মেইনস্ট্রীম মিডিয়ায় ও টুইটারে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে কীভাবে এটা সম্ভব হল? মিডিয়ার মেইনস্ট্রীমের অভিযোগের জল কোথা থেকে কোথায় গড়ায় এখন বৃটিশ রাজনৈতিক সাহিত্যে এ নিয়ে চলমান বিতর্ক দেখার পালা।

গত ২৭শে মে বিবিসি নিউজ বাংলা-এর প্রতিবেদক জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন, লুতফুর রহমান: ‘এক বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত মেয়রের জয় নিয়ে ব্রিটিশ রাজনীতিতে কেন এত আলোড়ন।’ এই শিরোনামে যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছেন বিবিসি নিউজ বাংলাম্বএর ক্লিপে এই সংবাদটির শিরোনাম ছিল ব্রিটিশ রাজনীতিতে ‘এক নিষিদ্ধ বাংলাদেশীর’ চমক লাগানো প্রত্যাবর্তন।

ক্লিপের শিরোনাম দেখেই পড়তে আগ্রহী হলাম। বিবিসির জনাব মোয়াজ্জেম হোসেন এর সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রতিবেদনটি পড়ে মনে হল এই বিষয়ে গবেষণাধর্মী আরো বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশ করলে আমাদের মত পাঠকরা উপকৃত হতাম। কথাটা এই কারনে বলছি এই ধরনের লেখার লেখক যেমন লন্ডনে কম আর লেখকদের উ্সাহদাতা মিডিয়ারও অভাব রয়েছে। বাংলা  প্রিন্ট মিডিয়াই একমাত্র মাধ্যম যেখানে টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতির সাম্প্রতিক ইতিহাস ধরে রাখা যাবে , আগামীদিনের ইতিহাসের জন্য তথ্য অন রেকর্ড রাখা দরকার ও তা খুবই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জনাব মোয়াজ্জেম হোসেনের শিরোনাম ধার করে গত তিন দশকে আমার দেখা টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতির কিছু কথা এই প্রতিবেদনে তুলে ধরছি। কাউন্সিলর জন বিগস থেকে মেয়র জন বিগস পর্যন্ত সময়কাল তুলে ধরব তবে এই সময়কালটা লিখতে গেলে কিছু প্রাসংগিক বিষয় আসবে। সব তথ্য বস্তুনিষ্ঠ রাখার চেস্টা করেছি তার পরেও ভুল হতে পারে।

ফটো ক্যাপশন: ১৯৮৮ সালে সাপ্তাহিক সুরমায় জন বিগসকে ভোট দেয়ার আহবান

জন বিগসের উত্থান ও টাওয়ার হ্যামলেটসের সাম্প্রতিক কাউন্সিল নির্বাচনে লেবার পার্টির  বিপর্যয়

সদ্য বিদায় নেয়া মেয়র জন বিগস কি ভাবে ১৯৮৮ সালে বাই ইলেকশনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে আসেন, ১৯৯৪ সালে কাউন্সিলর লীডার,পরে জি এল এ মেম্বার, ও পরে মেয়র লুতফুর রহমান ট্রাইবুনাল কর্ত্তৃক নিষিদ্ধ করা বিগস দু’ই মেয়াদে ২০১৫ থেকে ২০০২ পর্যন্ত দুইবার টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র নির্বাচিত হলেন এ নিয়ে লিখতে গেলে পাঠকদের একটু পেছন ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। ১৯৮৮ সালে কাউন্সিলর সাদিক আহমদের অকাল প্রয়ানে সেন্টক্যাথারিন ওয়ার্ড আসনটি শুন্য হয়েছিল, জন বিগস এই আসনে লেবার দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। ঐ সময় লেবার পার্টির এ্যাকটিভিস্টরাই জন বিগসের পক্ষে ক্যাম্পেইন করেছিলেন। আমি তখন সাপ্তাহিক সুরমার বার্তা সম্পাদক।

১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে হ্যামলেটস লেবার পার্টির কাউন্সিলর পদপ্রার্থী  জন বিগসকে ভোট দেয়ার আহধ্বান জানিয়ে তরুন বিগসের সুন্দর ছবিসহ একটি বিবৃতি আমাদের কাছে পাঠালেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। (সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম) । সাপ্তাহিক সুরমার বেক পেইজে খুব বড় করে আশরাফ ভাইর আহধ্বানটি গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো হয়েছিল। লিবডেম এসডিপি জোটের কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন আনহার উদ্দিন।

ত্কালিন সময়ে লিবডেম এর ধারনা ছিল সাপ্তাহিক সুরমা লেবার পার্টির সাপোর্টার, ৯০ সালে লিবডেমের এক বাঙালি কাউন্সিলর এর প্ররোচনায় সাপ্তাহিক সুরমায় বিজ্ঞাপন দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিল কাউন্সিল। কাউন্সিলর জেরেমি শো এর নেতৃত্বে লিবডেম ফোকাস টিম টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের হাউজিং, এডুকেশন এবং সোশ্যাল সার্ভিস প্রত্যেকটি বিভাগে বর্ণবাদি নীতি গ্রহন করতে থাকে। লিবডেম এমনও নীতি গ্রহন করে যে তারা হোম অফিসকে বলে যাদের বাসস্থান নেই তাদের যেন এন্ট্রি পারমিশন না দেয়া হয়। হোমলেসদের জাহাজে রাখার সিদ্ধান্ত তারা নিতে চেয়েছিল।

সাপ্তাহিক সুরমা লিবডেমের এসব বর্ণবাদি নীতির সমালোচনা করত, এবং তখনকার বর্ণবাদ বিরোধি এ্যকাটিভিস্টদের সংবাদ গুরুত্ব দিয়ে ছাপাত। এসব এ্যাকটিভিস্টরাই পরবর্তীকালে লেবার পার্টির কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাঙালী কাউন্সিলরদের মধ্যে সর্ব কাউন্সিলর হেলাল আবধ্বাস ও লুতফুর রহমান ছাড়া বাকীরা ডেপুটি লীডার ও অলংকারি মেয়র ও ডেপুটি মেয়র হয়েছিলেন। ২০১০ সাল পর্যন্ত কাউন্সিলে কেবিনেট পদ্ধতি ছিল এই পদ্ধতিতে লীডার, ডেপুটি লীডার নির্বাচিত করার জন্যে দুই ককাস ও দুই সৌইলেটের মধ্যে লেবার গ্রুপে ভোটাভুটি হত। টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতির সংস্কৃতির এই অধ্যায় ছিল ভিলেজ পলিটিক্স ও ডিভাইড এন্ড রুলের সংস্কৃতির খারাপ উদাহারন।

১৯৯৪ সালে লেবার গ্রুপ টাউন হলের নিয়ন্ত্রন নিল: জন বিগস হলেন কাউন্সিল লীডার

১৯৯৪ সালে লেবার গ্রুপ টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রন নেয়, সর্ব কাউন্সিল জন বিগস, ডেনিস টুমি, মাইকেল কীথ, জুলিয়া ম্যানওয়ারিং, ফিল ম্যাক্সওয়েল, ডেনিস জোনস, হেলাল আবধ্বাস, লুতফুর রহমান পর্যায়ক্রমে কাউন্সিল লীডার হলেন। তাদের সাথে একজন বাঙালি কাউন্সিলর ডেপুটি লীডার থাকতেন। ২০১০ সালে গণভোটের আয়োজন করা হয়। তখন লুতফুর রহমান কাউন্সিল লীডার। গণভোটে কেবিনেট প্রথা বাতিল হয় নির্বাহি মেয়র ব্যবস্থার পক্ষে গণভোটে রায় দেয়া হয়। ২০১০ সালের প্রধম মেয়র নির্বাচনের সিলেকশনের মাধ্যমে মেম্বরদের ভোটে লেবার পার্টি থেকে কাউন্সিলর ল্ফুুর রহমান কে মনোনয়ন দেয়া হয়। লুতফুর রহমানের মনোনয়ন বাতিল করে দেয় লেবার পার্টি ও কাউন্সিলর হেলাল আবধ্বাসকে মানোনয়য়ন দেয়া হয়। ২০১০ সালে লুতফুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে বারার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হলেন, ২০১৪ সালে ২য় টার্মের নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী ছিলেন জন বিগস। উল্লেখ্য যে জনাব হেলাল আবধ্বাস ও জন বিগস দুজনেই নির্বাহি মেয়র প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ছিলেন। তারা কেবিনেট পদ্ধতির পক্ষে ছিলেন।

২০১৪ সালের মেয়র নির্বাচনে জন বিগস ল্ফুুর রহমানের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে ইলেকশন ট্রাইবুনালে মেয়র লুতফুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন তিন ব্যক্তি। নির্বাচনি ট্রাইবুনাল গঠন করা হয় ঐ ট্রাইবুনালের বিচারক এর দেয়া রায়ে লুতফুর রহমানকে দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত করা হয় এবং৫ বছরের জন্যে নির্বাচনে প্রার্থী হবার অযোগ্য ঘোষনা করেন বিচারক রিচার্ড মাওরি। ২০১৫ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এতে লুতফুর রহমান মনোনীত প্রার্থী ছিলেন কাউন্সিলর রাবিনা খান রাবিনা খানকে পরাজিত করে জনবিগস বিজয় লাভ করেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে লুতফুর গ্রুপ ভেঙে যায় রাবিনা খান ও অহিদ আহমদ আলাদা আলাদাভাবে নির্বাচন করেন। জনবিগস দুজনকে পরাজিত করে বিপুল সংখ্যক লেবার কাউন্সিলর নিয়ে দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হন। এই দুই নির্বাচনে লুতফুর রহমান ছিলেন নিষিদ্ধ।

১৯৮৫ সাল থেকে আমি লন্ডনের বাংলা মিডিয়ার একজন কর্মী হিসাবে যা দেখেছি

এবার নিজের কথা বলি, ১৯৮৫ সাল থেকে আমি লন্ডনের বাংলা মিডিয়ার একজন কর্মী, সাপ্তহিক সুরমায় কাজ করেছি ১০ বছর, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে মিডিয়া ও প্রেস অফিসার হিসাবে কাজ করেছি আরো ১০ বছর। একজন মিডিয়া কর্মী হিসাবে ক্ষমতার করিডোরে ও বাইরে অনেক নেতা ও নেত্রীর উত্থান পতন দেখেছি। আগেই লিখেছি ১৯৮৬ সালে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও লিবারেল পার্টির জোট লেবার পার্টিকে পরাজিত করে টাওয়ার হ্যামলেটসের টাউন হলের নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয়, এক নাগাড়ে দুই টার্ম ক্ষমতার বাইরে থাকার পর ১৯৯৪ সালে লেবার গ্রুপ আবার ক্ষমতায় আসে। আগেই লিখেছি লেবার গ্রুপ ক্ষমতা নেয়ার আগে  লিবডেম এর লীডার কাউন্সিলর জেরেমি শোম্ব কাউন্সিল নীতিতে বিশেষ করে হাউজিং এ চরম বর্ণবাদি নীতি প্রণয়ন করেন যার ফলে, হোমলেস সমস্যা চরম আকার ধারন করেছিল। এ ছাড়াও বর্নবাদি আক্রমন চরম আকার ধারন করেছিল, প্রায় প্রতিদিনই বাঙালীরা স্কুলে, রাস্তাঘাটে বর্ণহামলার শিকার হতেন। কুদ্দুস আলি, মুখতার এর মত কিশোর তরুনরা নির্মম ভাবে আহত হয়। টাওয়ার হ্যামলেটসের তরুণরা এই বর্বর হামলার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে, রাস্তায় পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে জড়িত থাকার অভিযোগে অনেক তরুনের বিচার হয়, এই ঘটনায় সাজা প্রাপ্ত ভুক্তভোগিদের খোজ রাখার প্রয়োজন কেউ রাখেনি। সেদিনের সেই কিশোর তরুণদের উত্তাল বিক্ষোভ টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনৈতিক ইতিহাসের আরেক বিক্ষুব্ধ অধ্যায়। ১৯৯৩ সালের আর্কাইভ ঘাটলে ঐ ঘটনার সংবাদ ও ছবি পাওয়া যাবে। আগ্রহী গবেষকদের জন্যে এটি একটি ইন্টারেস্টিং সাবজেক্টও হতে পারে।

রাইট ফর হোয়াইট এর বৃটিশ ন্যাশনেলিস্ট পার্টির ডেরেক বিকনের কাউন্সিলর হওয়া

১৯৮৬ সালে লিবডেম টাওয়ার হ্যামলেটসের ক্ষমতা নেয়ার পর তাদের বর্ণবাদি নীতি প্রণয়নের ফলে চরম বর্ণবাদি বৃটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতিতে উ্সাহি হয়ে উঠে তার কাউন্সিলের বিভিন্ন উপ নির্বাচনে প্রার্থী দিতে থাকে। কোন কোন ওয়ার্ডে তারা ভাল ভোটও পেতে থাকে। ১৯৯৩ সালে আইল অব ডগসের মিলওয়াল ওয়ার্ডে বৃটিশ ন্যাশনেল পার্টির ডেরেক বিকন  (১৪৮০ ভোট পেয়ে লেবার পার্টির জে জে হান্টকে মাত্র ৭ ভোটে পরাজিত করেন) টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিলের কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়ে যান। ডেরেক বিকনের বিজয়ে সারা বৃটেন জুড়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে হৈ চৈ শুরু হয়। কাউন্সিলর ডেরেক বিকনের বিরুদ্ধে বর্ণবাদ বিরোধী সংগঠনগুলো আন্দোলন শুরু এমনকি কাউন্সিল অফিসাররাও তাকে অসহযোগিতা করার কথা ঘোষনা করেন। লেবার ও লিবডেমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বর্ণবাদ বিরোধী নেতাদের টনক নড়ে। টাওয়ার হ্যামলেটসে বৃটিশ ন্যাশনেল পার্টির বর্নবাদীদের উত্থানকে প্রতিহত করতে বর্ণবাদ  বিরোধি সংগঠনগুলো বিভিন্ন কর্মসুচি হাতে নেয়, বাঙালি এ্যকাটিভিস্টরাও বর্নবাদ বিরোধী আন্দোলনে শরীক হন।

১৯৯৩ সালে টাওয়ার হ্যামলেটসে বর্নবাদ বিরোধী বিরাট গণ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে বর্নবাদ বিরোধী সংগঠনগুলো। টাওয়ার হ্যামলেটসের রাস্তা প্রদক্ষিন করে গণ মিছিলটি হেকনি উইক মাঠে আয়োজিত বিরাট জনসভায় গিয়ে শেষ হয়। এই জনসভায় লেবার পার্টির উদীয়মান নেতা শেডো হোম সেক্রেটারি টনি ব্লেয়ার ভাষন  দিয়েছিলেন। ঐ সময়কার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের ফলে লিবডেমের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হয় যার ফলশ্রুতিতে ১৯৯৪ সালে কাউন্সিল ইলেকশনে লেবার গ্রুপ মেজরিটি নিয়ে নির্বাচিত হয়ে আসে,লেবার পার্টি ৪৩ আসন পায়,লিবডেম পায় ৭ আসন। কাউন্সিলর জন বিগস কাউন্সিল লীডার হিসাবে দায়িত্ব নেন এবং তার ডেপুটি ছিলেন কাউন্সিলর পলা মনজিলা উদ্দিন। ১৯৯৭ সালে এল সাধারন নির্বাচন এই নির্বাচনে লেবার পার্টির প্রার্থী দেয়া হল উনা কিং কে। টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনৈতিক সাহিত্যে ভিলেজ পলিটিক্স ও ডিভাইড এন্ড রুলের সংস্কৃতির আরেক নতুন অধ্যায়ের সুচনা হল। দুই টার্ম থাকার পর উনা কিংকে পরাজিত করলেন রেসপ্যাক্ট পার্টির জর্জ গ্যালেওয়ে। জর্জ গ্যালেওয়ে কথা দিয়েছিলেন তিনি এক টার্ম থাকবেন। বেথনাল গ্রীন ও বো এলাকা থেকে ২০১০ সালে রুশনারা আলি লেবার পার্টির মনোনয়ন দিলে নিরাপদ আসন থেকে সহজেই তিনি এমপি নির্বাচিত হলেন। ২০১৯ সালে পপলার ও লাইম হাউস থেকে এমপি নির্বাচিত হলেন আপসানা বেগম।

 তিন দশকের টাওয়ার হ্যামলেটসে রাজনীতি দুর্বল লিবডেম ও বিলুপ্ত রেসপ্যাক্ট পার্টি

টাওয়ার হ্যামলেটসের গত তিন দশকের রাজনীতিতে লিবারেল ডেমোক্রেট দুর্বল হয়ে গেছে ও রেসপ্যাক্ট পার্টি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। লিবডেমের সর্বশেষ কাউন্সিলর ছিলেন শেডওয়েলের রাবিনা খান। লুতফুর রহমানের টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট এ্যাসপায়ার পার্টিতে রুপান্তরিত হয়েছে। তারা ২৪টি আসন পেয়েছে। মেয়র সহ তারা এখন ২৫ জন কাউন্সিলে রয়েছেন।

এবার নিজের কথা বলি, ১৯৮৫ সাল থেকে আমি লন্ডনের বাংলা মিডিয়ার একজন কর্মী, সাপ্তহিক সুরমায় কাজ করেছি ১০ বছর, টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে মিডিয়া ও প্রেস অফিসার হিসাবে কাজ করেছি কমবেশী আরো ১০ বছর। একজন মিডিয়া কর্মী হিসাবে ক্ষমতার করিডরে ও বাইরে থেকে অনেকের উত্থান পতন দেখেছি। প্রসংগত বলে রাখি, বাংলাদেশীদের দুর্দশা মুক্ত করতে, ১৯৮৬ সালে  হাউস অব কমন্স এর হোম এ্যাফেয়ার্স সিলেক্ট কমিটি বাংলাদেশিজ ইন বৃটেন নামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্ট এ পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশী কমিউনিটির উন্নতির জন্যে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল।কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারগুলোকে সুপারিশ মালা বাস্তবায়ন করার জন্যে দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল, বড় কথা হল টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল এই সুপারিশ কতটুকু বাস্তবায়ন করেছিল তা আজ অবধি জানা যায়নি। ১৯৯০ সালে হাউস অব কমন্সে এ নিয়ে আনা একটি মোশন নিয়ে আলোচনাও হয়েছিল। তবে টাওয়ার হ্যামলেটসের দুজন বাঙালি এমপি এ নিয়ে কোন উদ্যেগ আলোচনা করেছেন বলে এখনও দেখা যায়নি।

আগেই লিখেছি ১৯৮৬ সালে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও লিবারেল পার্টির জোট লেবার পার্টিকে পরাজিত করে টাওয়ার হ্যামলেটসের টাউন হলের নিয়ন্ত্রন নেয়, এক নাগাড়ে দুই টার্ম ক্ষমতার বাইরে থাকার পর ১৯৯৪ সালে লেবার গ্রুপ আবার ক্ষমতায় আসে। লেবার গ্রুপ ক্ষমতা নেয়ার আগে  লিবডেম-এর লীডার কাউন্সিলর জেরেমি শোম্ব কাউন্সিল নীতিতে বিশেষ করে হাউজিং এ চরম বর্ণবাদি নীতি প্রণয়ন করেন যার ফলে, হোমলেস সমস্যা ও বর্নবাদি আক্রমন চরম আকার ধারন করেছিল, প্রায় প্রতিদিনই বাঙালীরা স্কুলে, রাস্তাঘাটে বর্ণহামলার শিকার হতেন। কুদ্দুস আলি, মুখতার এর মত কিশোর তরুনরা নির্মম ভাবে আহত হলে টাওয়ার হ্যামলেটসের বিক্ষুব্ধ তরুনরা রাস্তায় নেমে আসে, পুলিশের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। রায়টে জড়িত থাকার অভিযোগে অনেক তরুনের বিচার হয়, সে আরেক অধ্যায়। ১৯৯৩ সালের আর্কাইভ ঘাটলে ঐসব ঘটনার সংবাদ ও ছবি পাওয়া যাবে। গত তিন দশকে টাওয়ার হ্যামলেটসে লেবার পার্টি, লিবডেম জোট, রেসপেক্ট পার্টি, ও টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট, এ্যাসপায়ার পার্টির রাজনীতি দেখেছি। বৃটিশ রাজনৈতিক সাহিত্যে টাওয়ার হ্যামলেটসের তিন দশকের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, সমালোচনা গবেষণা হওয়া দরকার।

শুরু হয়েছে পুরোনো খেলা: টোরি লর্ডের নির্বাচনি আইনে সংশোধনি আনার প্রস্তাব

টাওয়ার হ্যামলেটসে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক তোলা হচ্চেছ সেই ২০১০ সাল থেকে, টোরি সরকারের সাবেক কমিউনিটিজ সেক্রেটারি এরিক পিকল, মুলস্রোতের মিডিয়া,নির্বাচনি ট্রাইবনাল এর হস্তক্ষেপের পর লুতফুর পর্ব সাত বছরের জন্যে ছিল পর্দার আড়ালে, সেই নিষিদ্ধ ল্ফুুরের প্রত্যাবর্তনের পর আবার নাটক শুরু হয়েছে।  লর্ড সভার সদস্য টোরি লর্ড রবার্ট হেইওয়ার্ড নির্বাচনি সংশোধনি প্রাইভেট মে“ার বিল আনবেন বলে ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে। ভোটারের আতœীয় স্বজনেরা ভোট দেয়ার সময় যাতে কোন প্রভাব সৃস্টি না করতে পারে এ জন্যে পুলিশকে ক্ষমতা দেয়ার সুপারিশ থাকবে এই বিলে। ২০১৪ সালে নির্বাচিত মেয়র ল্ফুুর রহমানের বিরুদ্ধে আনা নানা অনিয়মের মধ্যে একটি অভিযোগ ছিল ভোটারদের বাচ্চচাদের ললিপপ উপহার দেয়া হয়েছিল,ললিপপ পেয়ে অনুপ্রানিত হয়ে অভিভাবক ভোটাররা লুতফুর রহমানকে ব্যাপক ভাবে ভোট দিয়েছিল।

এবারের টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাচন নিয়ে অনেকের মত ডানপন্থী রাজনৈতিক ও টক  টিভির উপস্থাপক রিচার্ড টাইস এ্যাসপায়ার পার্টির লুতফুর রহমানের বিজয় নিয়ে প্রশ্ন করেছেন এই দলের কোন ওয়েবসাইট নেই, সোশ্যাল মিডিয়ায় কোন ত্পরতা নেই,তাদের কোন দৃশ্যমান রাজনৈতিক ত্পরতা ছিল না, দলীয় কোন তহবিল ছিল না, তারা কিভাবে নির্বাচনে জিতে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রন নিয়ে নিল? এই প্রশ্নের উত্তর প্রতিদ্বন্দ্বি লেবার পার্টিকে খুজতে হবে।

টাওয়ার হ্যামলেটসের দুটি নির্বাচনি  আসনের দুজন নির্বাচিত এমপি লেবার দলীয় এবং বাঙালি, সিলেটি ও মুসলমান তাদেরকে সেইম ভোটাররা ভোট দেন। তাদেরকে ভোট দেয়া যদি পরিচ্চছন্ন ও প্রশ্নাতীত হয় তাহলে লকেল কাউন্সিলের নির্বাচনকে প্রশ্নাতীত রাখা যাবে না কেন । লকেল নির্বাচন নিয়ে যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিস্ট কর্ত্তৃপক্ষের। অতীতে টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকার লেবার পার্টিকে শক্তিশালি করার জন্যে সদস্য সংগ্রহ করে বাঙালীরাই বিরাট ভুমিকা রেখেছিলেন, সম্প্রতি যারা সেইফ সীট থেকে এমপি ও কাউন্সিলর হয়েছেন তারা পূর্বসুরিদের ধারাটি অব্যাহত রাখেননি।  বরং লেবার পার্টি থেকে শত শত মেম্বার বের হয়ে গেছেন, বিরাট সংখ্যক সদস্য নিস্ক্রিয় হয়ে গেছেন। এদের খোজও পার্টি করেনি যার মাশুল টাওয়ার হ্যামলেটসের লেবার পার্টিকে এবারে দিতে হয়েছে। টাওয়ার হ্যামলেটসের লেবার পার্টিকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের হাত থেকে বাচানোর জন্যে সংশ্লিস্টদের এখনই উদ্যেগি ভুমিকা নিতে হবে বলে পার্টির শুভাকাঙ্ক্ষিরা তাগিদ অনুভব করছেন।

লণ্ডন, ৩০শে মে ২০২২

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close