“ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ” নিয়ে আবদুল গাফফার চৌধুরী’র কলাম প্রসঙ্গে

।। হাসান মাহমুদ ।।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিভিন্ন দেশে প্রবাসী বাংলাদেশি সংগঠকদের তালিকা বানিয়ে ধাপে ধাপে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর উদ্দেশ্যে লন্ডনভিত্তিক “ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ” সংগঠনের প্রথম অনুষ্ঠান ২৯শে মার্চ ২০২২। এই সংগঠনের ওপরে আমাদের কিংবদন্তী বাতিঘর গাফফার ভাই (আবদুল গাফফার চৌধুরী) ২১শে মার্চ দৈনিক সমকালে “বিদেশের মাটিতে দেশবিরোধী প্রচারণা” নামে কলাম লিখেছেন, সেই প্রেক্ষিতেই এই লেখা। আমি দীর্ঘকাল গাফফার ভাইয়ের অপরিমেয় স্নেহবর্ষণে ধন্য, নিবন্ধে তিনি লিখেছেন- “মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে নিয়ত সংগ্রামরত আমার বন্ধু ফতেহ মোল্লাও এই প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর বোর্ডে আছেন” (বছর পনেরো হল আমি কলমনাম “ফতেমোল্লা” ব্যবহার করিনা)। “ভয়েস ফর গ্লোবাল বাংলাদেশিজ” সংগঠনের ক্যানাডা নিবাসী নির্বাহী পরিচালক হিসেবে তাঁর লেখার ওপরে আমার বক্তব্য:-

এক। আমরা “মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান প্রদর্শনের নামে সম্মেলন” ডাকিনি (যা তিনি লিখেছেন), আমাদের সরকার ইতোমধ্যেই প্রশংসনীয় ভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান প্রদর্শন করছেন। আমরা একাত্তরে বিভিন্ন দেশে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রবাসী বাংলাদেশি সংগঠকদের তালিকা বানিয়ে ধাপে ধাপে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছি মাত্র। এটা কোন রকম প্রচারণা নয়, “দেশ বিরোধী প্রচারনা” তো নয়ই।
দুই। আমাদের সংগঠনে দলীয় বক্তব্য দেয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এ অনুষ্ঠানের জন্য জুমে আমাদের অজস্র মিটিং হয়েছে, আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি কখনোই কেউ বাংলাদেশের কোন রাজনৈতিক দল বা রাজনীতিকের নামটা পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। তেমন হলে আমি তৎক্ষণাৎ সংগঠন ছেড়ে দিতাম। এমনকি আমাদের স্যুভেনিরে নির্বাহী কর্মকর্তাদের পরিচিতিতে আমরা তাঁদের রাজনৈতিক দলীয় পরিচয় অন্তর্ভুক্ত করিনি। এভাবেই আমরা এ সংগঠনের অরাজনৈতিক চরিত্র সম্পূর্ণ বজায় রেখেছি, কারণ কোনো সেবাধর্মী সংগঠনে রাজনীতি ঢুকে পড়লে সেটা ধ্বংস হয়ে যায়। সংগঠনের বাইরে রাজনীতি করার বা না করার অধিকার সবারই আছে।
তিন। আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য কিছু ভালো কাজ করেছি। এসব কাজে কত কাঠখড় পুড়িয়ে কত দৌড়ঝাঁপ করতে হয় তা সবারই জানা। মালয়েশিয়ায় এক পাসপোর্টবিহীন বাংলাদেশি শ্রমিক মারা গেলে তার মৃতদেহ হাসপাতালের মর্গে ছিল দীর্ঘদিন। দেশে তার পরিবার কি দুঃসময় পার করেছে তা সহজেই অনুমেয়। পরিচয়হীন দলিলহীন একটা লাশকে বাংলাদেশি দূতাবাসের সাহায্যে বৈধভাবে হাসপাতাল থেকে বের করে, এয়ারপোর্টের বিভিন্ন ধাপ পার করে এয়ারলাইন্সের আইন কানুন মেনে দেশে পৌঁছে দেয়া যে কত জটিল এবং কত বড় একটা কাজ? এই দুঃসাধ্য কাজটা করেছেন আমাদের মালয়েশিয়া প্রবাসী নির্বাহী পরিচালক। তাছাড়া লেবাননে কয়েক হাজার নারীশ্রমিক কঠিন অবস্থায় পড়েছিলেন, আমরা আমাদের মন্ত্রণালয় এবং দূতাবাসের সাহায্যে তাদের ঘরে ফেরার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম। দলমতের ঊর্ধে উঠে এমন আরও বেশকিছু ভালো কাজ আমরা করেছি। অবশ্যই এই কাজগুলোর মানবিক মূল্য আছে, যাঁরা উপকৃত হয়েছেন তাঁরা তা জানেন।
চার। কোন সংগঠনকে শুভেচ্ছাবাণী পাঠানোর আগে মহামান্যা রানী কিংবা প্রধানমন্ত্রীর অফিস কত রকম তদন্ত করে তা সহজেই অনুমেয়, কোন প্রশ্নবিদ্ধ ও অস্বচ্ছ সংগঠনকে তাঁরা নিশ্চয়ই শুভেচ্ছাবাণী পাঠাবেন না। সব রকম কলুষতার প্রভাবমুক্ত মানব-সেবার এই ট্র্যাক-রেকর্ডের জন্যই আমাদের অনুষ্ঠানকে শুভেচ্ছাবাণী পাঠিয়েছেন গ্রেট বৃটেনের মহামান্যা রানী এবং প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। সেগুলো আমাদের স্যুভেনিরে যোগ করেছি এবং অনুষ্ঠানের প্রবেশপথে সেগুলো দেখা যাবে।
পাদটীকা: –
গাফফার ভাই আমাকে গত সপ্তাহে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন ফোন করতে। তাঁর আদেশ আমার চিরকালই শিরোধার্য, আমি ফোন করে কথা বলেছি। আমি তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম – “মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে প্রবাসী বাংলাদেশি নেতাকর্মীরা কত গভীর দেশপ্রেমে কত পরিশ্রমে মানব বন্ধন সহ কত কর্মকাণ্ড করেছেন, তাঁদেরকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানোর এই উদ্যোগটা কি ভালো নয়”? তিনি বলেছিলেন “হ্যাঁ ভালো, কিন্তু………….”।
এই “কিন্তু” একটা মহাশক্তিশালী শব্দ যা দিয়ে টেবিল উল্টে দেয়া যায়, ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া যায়। কোন এক মনিষী এরকম বলেছিলেন “আমাকে কয়েকটা ‘কিন্তু’ এবং কয়েকটা ‘যদি’ দাও, আমি প্রমাণ করে দেব যে রাস্তার ওই ল্যাম্পপোষ্টটাই স্রষ্টা”।
মতভেদের জায়গায় মতভেদ থাকুক, কিন্তু আমরা সব দলমতের বাংলাদেশীরা যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে পানিতে ডুবন্ত শিশুকে বাঁচাতে পারি, আর্ত মানবতার সেবা করতে পারি।
লেখক: গবেষক, মুসলিম রিফর্ম মুভমেন্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার কর্মী, শরিয়া আইনের ওপর গবেষক, লেখক ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের বক্তা।