বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করেছে, যখন স্বাধীনতার তিনটি মূল স্তম্ভ জাতীয় পর্যায় থেকে পুরোপুরি নির্মূল সম্পন্ন হয়েছে। গণতন্ত্র, সাম্য ও ন্যায়বিচার- এ তিনটি বিষয় এখন একশভাগ অনুপস্থিত বর্তমান বাংলাদেশে।
প্যাট্রিয়ট কবিতার নায়কের মতই বাংলাদেশের অন্যতম স্থপতি ও জাতীয়তাবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশ বরণ করেছিল নায়কের বেশে। তিন দশকের আন্দোলন-সংগ্রাম কারাবরণ আর মৃত্যুঝুঁকি উপেক্ষা করে গড়ে তোলেন স্বাধীকারের লড়াই । কিন্তু যুদ্ধের প্রথম প্রহরেই শত্রু পক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ নায়ককে মহানায়ক না বানিয়ে পরিণত করেছিল ভিন্ন এক ঐতিহাসিক চরিত্র। সমালোচকরা অনেকে শেখ মুজিবকে আজকাল পলাতক শ্রেষ্ঠ বিশেষণে ভূষিত করতে চান। পেট্রিয়ট কবিতার নায়ক জনগণের দেওয়া ফুলের মালা আর অফুরন্ত ভালোবাসার মূল্য দিতে ব্যর্থ হয়েছিল। যার ফলে কিছু সময়ের ব্যবধানে তাকে জনগণের নিন্দা আর ক্ষোভের প্রতীক হিসেবে জনগণেরই দেয়া জুতার মালা নিয়ে প্রস্থান হতে হয়েছিল নিজ স্বদেশভূমি থেকে।
নয় মাসের যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিবর্গকে তাদের বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে যেসব উপাধি দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বীরশ্রেষ্ঠ, বীর উত্তম, বীর প্রতীক ইত্যাদি। বীরত্বের এই স্বীকৃতির ধারায় শেখ মুজিবুর রহমান নিশ্চয়ই একটি বীরত্বের উপাধি জাতির কাছে আশা করতে পারেন। সম্প্রতিক সময়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট মিস্টার জেলেনস্কি রাজধানীতে থেকে সাধারণ পোশাকে সেনাবাহিনীর সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করেন। রাজধানীতে অবস্থান করেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। এই চিত্র যেন বাংলাদেশের মানুষকে হাজার ৭১-এর ইতিহাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সেদিন কোথায় ছিল তাদের নির্বাচিত নেতা? যার নেতৃত্বে সারা দেশ জেগে উঠেছিল। ছয় দফা আন্দোলন করেছে , স্বায়ত্ত্ব শাসনের আন্দোলন করেছে, অসহযোগ আন্দোলন করেছে। যার অঙ্গুলিহেলনে স্কুল-কলেজ অফিস-আদালত খুলেছে- বন্ধ থেকেছে । সারা জাতি যখন পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার মুখে, তখন কোথায় ছিলেন সেই নেতা?
ইউক্রেনের নেতা মিস্টার জেলেনস্কি প্রায় ৮০ ভাগ ভোট পেয়ে তার দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের জনগণও ৯৯ শতাংশ আসনে বিজয়ী করে শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের একক নেতা নির্বাচিত করেছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য। দুই দেশের দুই নেতার ভূমিকার পার্থক্য! সাধারণ মানের টি-শার্ট আর জ্যাকেট পড়ে রাষ্ট্রপতি জেলিনস্কি রাজধানী কিয়েভে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসে প্রতিদিন যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। বিশ্ববাসী সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, আর আহত সেনাদের উৎসাহ দিতে ছুটে যাচ্ছেন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে। তাদের সঙ্গে সেলফি তুলছেন সেনাদের উদ্বুদ্ধ করতে। প্রতিদিন বক্তব্য দিয়ে চলেছেন সারা বিশ্ববাসীকে ইউক্রেনের পাশে দাঁড় করাতে। একের পর এক ভার্চুয়ালি ভাষণ দিচ্ছেন বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সংসদে। বিশ্বব্যাপী শহরে শহরে যুদ্ধবিরোধী সমাবেশগুলোতে বড় স্ক্রিনে বক্তব্য রাখছেন।
মিস্টার জেলেনস্কি নেতৃত্বে রাশিয়ার মতো বৃহৎ পরাশক্তির বিরুদ্ধে তিন সপ্তাহের বেশি সময় বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে চলেছেন। সারা পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়েছে। সেখানে রাশিয়া কয়েক ঘন্টায় দখলে নিতে পারত ইউক্রেন কেবল একজন নেতার উদ্দীপনায় একমাস সময় মহাশক্তিধর রাশিয়াকে ঠেকিয়ে রেখেছে ইউক্রেন। এই এক চরম বিস্ময়। একেই বলে জাতীয় নেতা, যুদ্ধের নেতা, সংগ্রামের নেতা আর বীরশ্রেষ্ঠ -বীরউত্তম কিংবা এ ধরনের উপাধি দিয়ে বরণ করার মতো বলিষ্ঠ নেতৃত্ব।
বাংলাদেশ এমনি চিত্রের মুখোমুখি হয়েছিল ৭১ সালে। কিন্তু বাংলাদেশের নেতা যুদ্ধ শুরুর কালরাতেই লোটাকম্বল গুটিয়ে পাকিস্তানি শত্রুপক্ষের সেনাদের জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করছিলেন আত্মসমর্পণের জন্য। তখন তারা এসে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। একটি সাহসী জাতির এরকম “কৌশলের নামে” চরম ভীতু ও আপোষকামী নেতৃত্তের উদাহরণ আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এই মহান নেতা সময়ের পরীক্ষায় নিজেকে পলাতক শ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করার মত একটি কালো অধ্যায় রচনা করলেন। “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর” এই শ্লোগান দিয়ে কোন নেতা তার শত্রু পক্ষের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে এটা কল্পনার অতীত!! এর জন্যই পলাতক শ্রেষ্ঠ উপাধি যথার্থ হতে পারে একদিকে তিনি স্বাধীন বাংলার অন্যতম স্থপতি আরেকদিকে তিনি যুদ্ধের মুখে রেখে যাওয়া বিপর্যস্ত এক জাতির সামনে পলাতক শ্রেষ্ঠ উপাধি প্রাপ্ত একজন নেতা বই কিছুই নন।
পরবর্তীতে পাকিস্তানের কারাগারে আটক থাকাকালীন যে বিচার চলছিল সেখানে তিনি স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেয়ার দাবি কখনো উল্লেখ করেননি। যদি সে প্রমাণ থেকে থাকে, তাহলে শেখ হাসিনা সরকারের উচিত পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে তাঁর আদালতে দেওয়া বক্তব্য জাতির সামনে প্রকাশ করা। পাকিস্তানের সেসময় নামজাদা আইনজীবী ব্যারিস্টার ব্রোহী ছিলেন শেখ মুজিবের জন্য রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী। আইনজীবীর মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের আদালতে শতাধিক পৃষ্ঠার একটি হলফনামা প্রদান করেছিলেন। শেখ হাসিনা সরকারের উচিত কূটনৈতিক চ্যানেলে সেই বক্তব্যটি এনে বাংলাদেশে সেটা প্রকাশ করা। আমরা বাংলাদেশ সরকারকে এই সুযোগটি দিতে চাই যাতে সরকার তার নিজস্ব বক্তব্য ইতিহাসের তথ্য-প্রমাণসহ জাতির সামনে প্রকাশ করে। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকবে। কিন্তু উপরের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ আকারে উপস্থাপন করছি এই কারনে যে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারের এই দাবিটি যে সর্বৈব মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন, এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তথ্য প্রমাণ সাপ্তাহিক সুরমার হাতে রয়েছে। আমরা সময়মতো প্রকাশ করবো।