নিউজ

রাজনীতিতে ব্যস্ত দূতাবাসগুলো

বিদেশে-দেশের ভাবমূর্তি ও সম্পর্ক দুটোই তলানিতে

** রাজনীতিই এখন মুখ্য
** কন্সুলার সার্ভিসে রাজনীতিকরণ
** সরকারবিরোধীদের হয়রানি নিপীড়ন আর হুমকি
** প্রবাসীদের ভিডিওচিত্রগ্রহণের দায়স্বীকার

|| আব্দুর রব ভুট্টো ||
লণ্ডন, ১৬ মার্চ : বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কার্যক্রম নিয়ে দিনে দিনে হতাশ হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশি কমিউনিটির লোকজন। দূতাবাস কনসুলার সার্ভিস ও প্রবাসীকল্যাণের কাজের পরিবর্তে দলীয় কর্মসূচিতেই ব্যস্ত। কোনো কোনো মিশনে প্রতি সপ্তাহে দলীয় কোনো না কোনো কর্মসূচি লেগেই আছে। বিদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে সেবা নিতে যাওয়া কিংবা মানবাধিকারসহ নানা বিষয়ে আবেদন দিতে যাওয়া লোকজনের গোপনে ভিডিও রেকর্ড গ্রহণ, তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও পরিচয়ের কারণে সেবা প্রদানে অনীহা প্রকাশের মতো গুরুতর অভিযোগ দিনে দিনে উদ্বেগের পর্যায় অতিক্রম করেছে। এমনকি প্রকাশ্যে সরকারবিরোধীদের (সরকারী ভাষায় দেশবিরোধী) সেবা প্রদান না করার হুমকিও প্রদান করা হচ্ছে। ব্যাপক রাজনীতিকরণের আড়ালে একশ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী কোনো কোনো দূতাবাসে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছেন। অনেকেই বলছেন, ঘুষ ছাড়া ওইসব দূতাবাসে কোনো সেবাই পাওয়া যায় না । ফ্রান্স, মালয়েশিয়াসহ মধপ্রাচ্যের বেশিরভাগ মিশনে পাসপোর্ট সংকটের কথা বলে প্রবাসীদের পকেট কেটে লাখ লাখ ডলার/পাউণ্ডের রমরমা বাণিজ্য চলছে অবাধে।

জানা গেছে, দলীয় কাজে ব্যস্ত থাকায় সময়মতো সরকারকে সতর্ক করেনি বলেই যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারী বিভাগ বাংলাদেশের উপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। অন্য অনেক দেশ তার জের ধরে বহুবিধ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে অথবা করতে যাচ্ছে। ইউক্রেন ইস্যুতেও বাংলাদেশের অবস্থান রাশিয়ার পক্ষে থাকায় জাতিসংঘে নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত থাকার সিদ্ধান্তকে কূটনৈতিক নয়, বরং রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত মনে করছেন বিশ্লেষকগণ। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সবচেয়ে বড় অবদান রাখার জন্য বাংলাদেশ গত কয়েক দশক বিশ্বব্যাপী বিশেষ মর্যাদা পেয়ে আসছে। সেই বাংলাদেশ কিভাবে শান্তি প্রস্তাবে ভোট দানে বিরত থেকে রাশিয়ার আগ্রাসনকে পরোক্ষ সমর্থন দিতে পারে? এই চরম আত্মঘাতী “কূটনৈতিক সিদ্ধান্তের” দীর্ঘমেয়াদী প্রতিক্রিয়া হতে পারে বলে কূটনীতি অভিজ্ঞ মহল আশংকা করছেন। এখানেও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়া জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্হায়ী মিশন সরকারকে সঠিক বার্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। 

লণ্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তারা সমবেত বৃটিশ বাংলাদেশীদের বিনা-অনুমতিতে ভিডিওচিত্র গ্রহন করছেন। ছবি: সুরমা (২৮ জানুয়ারী ২০০২)

অনুসন্ধানে জানা যায়, লণ্ডনের বাংলাদেশ হাইকমিশনে সেবা নিতে যাওয়া লোকজনকে নানা অবাঞ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। তাদেরকে গোপনে কিংবা কখনো প্রকাশ্যে ভিডিও রেকর্ড করা হয়। এইসব নজরদারির জের ধরে দেশে তাদের আত্মীয়-স্বজনকে হয়রানি করার অভিযোগ দূতাবাসকে বিদেশের মাটিতে গোয়েন্দাগিরির হেড অফিসে পরিণত করেছে। আর পেশাদার কূটনীতিকদের গোয়েন্দাদের সহযোগীর নতুন ভাবমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই দূতাবাস অন্য আর দশটি দূতাবাস থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে কয়েক কদম এগিয়ে আছে! সরকারের সমালোচনার “অপরাধে” একজন গবেষককে পিএইচডি ডিগ্রি না দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে যুক্তরাজ্যের একটি নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠি দেয়া হয়েছে হাই কমিশনের নামে! অকূটনীতি সুলভ আচরণের ক্ষেত্রে এটি এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত।

কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন, পাওয়ার অফ এটর্নিকে জটিল করে চালু করা হয়েছে নতুন বাণিজ্য। তবে দলীয় লোকজন সাথে সাথে সেবা পেয়ে থাকেন। দূতাবাসের যাওয়া সাধারণ জনগণকে তাদের নিযুক্ত দালালদের মাধ্যমে সেবা নিতে হয়। ফলে নির্ধারিত ফি’র চেয়ে তিন চার গুন বেশি টাকা পরিশোধ করতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ভুক্তভোগী এ প্রতিবেদকে জানান, ইচ্ছা করেই দূতাবাসের লোকজন পাসপোর্টে নামের বানান বা জন্ম তারিখ ভুল করেন। পরবর্তীতে ওই ভুল সংশোধনের জন্য বিপুল অংকের টাকা খরচ করতে হয়।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থানরত সরকার সমালোচকদের তালিকা করছে বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা সরকারের সমালোচনা করেন, তারা কোনো ধরণের সেবা পাচ্ছেন না দূতাবাস থেকে। অনেকের পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে কয়েক বছর আগে। দূতাবাসে আবেদন করেছেন নতুন পাসপোর্টের জন্য, কিন্ত নতুন পাসপোর্ট ইস্যু না করে পুরাতন পাসপোর্ট আটকে রেখেছে বছরের পর বছর ধরে। সবচেয়ে করুন অবস্থায় আছেন মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত বাংলাদেশীরা। মালয়েশিয়া, দুবাই, সৌদি আরব, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দূতাবাসের অবহেলা আর নিষ্ঠুরতার স্বীকার বাংলাদেশীরা।

একই অবস্থা বিরাজ করছে ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল, ইতালি, জার্মানি, আমেরিকা ও কানাডায় বাংলাদেশ দূতাবাসে। ইতিমধ্যে কানাডায় বাংলাদেশ দূতাবাস ঘোষণা দিয়েছে, বিরোধী দলের (হাই কমিশনের ভাষায় “রাষ্ট্রবিরোধী”) সমর্থক  কোনো প্রবাসীকে তারা কনসুলেট সেবা দিবে না। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। অন্য মিশনগুলো প্রকাশ্য ঘোষণা না দিলেও কর্মসূচি ও কার্ক্রক্রম বেশিরভাগ মিশনেরই অভিন্ন।

সম্প্রতি ম্যানচেস্টার কনস্যুলেটে একজন ব্রিটিশ বাংলাদেশি নো ভিসা রিকোয়ারের আবেদন করেন। কনস্যুলেট থেকে তার পাসপোর্টে নো ভিসার স্টিকারে একটি বাচ্চার ছবি লাগিয়ে দেয়। যার ফলে তিনি নির্ধারিত তারিখে বাংলাদেশ সফর করতে পারেননি।

দূতাবাসগুলোতে প্রায় প্রতিসপ্তাহে নানা উপলক্ষে সরকারি দল আওয়ামী লীগের কর্মসূচি বিরামহীনভাবে চলছে। দূতাবাস প্রধানসহ অন্য কর্তারা ভুলে বসে আছেন তারা যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। কোনো দলের নন। শেখ মুজিবের জন্ম শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানাদি চলছে প্রায় দুই বছর যাবৎ। এ যেন আর কখনো শেষ হবার নয়! সরকারের উন্নয়নের গল্প চলছে দূতাবাসের মনিটরগুলোতে। প্রবাসীদের অভিযোগশোনার যেনো কেউ নেই। দ্রুত সেবা পাওয়ার জন্য বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত টাকা পরিশোধ করতে হয়। কখনো কখনো দলীয় অনুষ্ঠানের কারণে চার পাঁচ ঘন্টা সময় নষ্ট  করতে হয়।

লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে দেশে মানবাধিকার নিয়ে স্মারকলিপি দিতে যাওয়া বিক্ষুব্ধ প্রবাসী নাগরিকদের ভিডিওচিত্রগ্রহন ও দেশে এইসব তালিকা প্রেরণ, প্রবাসীদের পাসপোর্ট বাতিলে সরকারি ঘোষণার সঙ্গে এইসব তৎপরতার সম্পর্ক নিয়ে লণ্ডনে বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাইয়েদা মুনা তাসনিমের কাছে জানতে চাওয়া হয়। সাপ্তাহিক সুরমার পক্ষ থেকে প্রেস মিনিস্টারের মাধ্যমে পাঠানো প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে, হাই কমিশনের নিরাপত্তার স্বার্থে ওই ভিডিওগুলো করা হয়েছে। ডিপ্লোমেটিক জোনে বিশেষ নিরাপত্তা ও স্হানীয় পুলিশ কতৃপক্ষের ‘পরামর্শে’ এটা করা হচ্ছে বলেও দাবী করা হয়। তবে সরকার বিরোধীদের তালিকা প্রণয়ন ও পাসপোর্ট বাতিলে সরকারি ঘোষণা বাস্তবায়নের সঙ্গে এসব তৎপরতার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, হাই কমিশনার তা সযত্নে এড়িয়ে গেছেন।  

অনুমতি ছাড়া কোনো ব্যক্তির ছবি বা ভিডিও ধারণ করা যাবে না, এমনকি সেটা কূটনৈতিক এলাকায়ও নয়। ব্রিটেনের আইনে(জিডিপিআর)  এটা পরিষ্কার ভাবে বলা থাকলেও বাংলাদেশ হাইকমিশন আইনের তোয়াক্কা না করে আইন লঙ্ঘন করে চলেছে। হাইকমিশনের মূল ফটকে, সামনে এবং অভ্যন্তরে সিসিটিভি ধারণ আইনানুগ এবং তার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু তারপরও হাই কমিশনের সামনের সড়কে পুলিশের অনুমতি নিয়ে সমবেত বৃটিশ বাংলাদেশীদের পৃথকভাবে কয়েকটি ডিভাইসে ভিডিওচিত্রগ্রহনকে অনেকেই উদ্দেশ্যমূলক, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও অকূটনীতিসুলভ আচরণ বলে মনে করেন। বিক্ষুব্ধ অনেকেই লিখিতভাবে সাপ্তাহিক সুরমাকে জানিয়েছেন, এইসব ভিডিও এবং তালিকার কারণে দেশে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের আত্মীয়স্বজনকে হয়রানি করছে। কোনোক্ষেত্রে গ্রেফতার কিংবা অপহরণ, রিমান্ড ও চাঁদাবাজির গুরুতর অভিযোগও পাওয়া গেছে।

কূটনৈতিক কার্যক্রম বাদ দিয়ে দলীয় কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকায় ওয়াশিংটন, কানাডা, লণ্ডন, মালয়েশিয়া ও মধপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি মিশন এখন রীতিমতো দলীয় কার্যালয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে প্রবাসীদের কাছে। দেশগুলোতে কূটনৈতিক সম্পর্কেও তা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও কয়েকটি পশ্চিমা দেশে তার প্রমান দেখা গেছে। কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে পৌঁছায় বিদেশে বাংলাদেশের স্বার্থ যেমন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি দেশের ভাবমূর্তিও পৌঁছেছে তলানিতে। দুবাই থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দুবাইতে চলমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় প্রত্যেক দেশের স্টল ও প্রদর্শনীতে হাজারো মানুষের ঢল নামে প্রতিদিন, অথচ বাংলাদেশের স্টলে বড় বড় আলোকচিত্র (শেখ মুজিব, শেখ হাসিনা আর প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ) আর সারাক্ষন দলীয় ভাষণের বিরক্তিকর প্রদর্শনী দেখার জন্য কোনো দর্শনার্থীকেই দেখা যায় না। এই হচ্ছে দেশের স্বার্থ বাদ দিয়ে দলীয় কূটনীতির পরিনাম ও দেশে দেশে তার একেকটা সাক্ষাৎ প্রমাণ।

https://issuu.com/surmanews/docs/sur001_c31a43c88e8c5c
Sheikhsbay

সম্পরকিত প্রবন্ধ

Back to top button
Close
Close