মুক্তচিন্তা

ইউনিয়ন পরিষদ ও গ্রামের উলামায়ে কেরাম

গ্রামীণ পঞ্চায়েত

।। আহমদ কুতুব।।
লেখক: প্রাবন্ধিক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী

প্রবন্ধের ভূমিকা পর্বে গ্রাম, পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন প্রসঙ্গে কিছু পুরানো নথিপত্র তুলে ধরতে চাই। এরপর পর্যালোচনা করবো শিরোনামের মূল প্রসঙ্গটি। আমরা যা কিছু করছি, এর একটা ক্রমধারা রয়েছে যা পরম্পরা ভিত্তিতে বিকশিত হয়েছে। প্রসঙ্গের গুরুত্ব বোঝার জন্য এর ক্রমবিকাশ চোখের সামনে পুনরাবৃত্তি করা জরুরী।ইউনিয়ন নির্বাচনে গ্রামগঞ্জের হাট বাজারে ও অলি-গলিতে উৎসবমুখর আমেজ তৈরী হয়। দোকানে চা-এর কাপে আলোচনার ঝড় ওঠে। বাড়ি বাড়ি উঠান বৈঠক চলতে থাকে। ঘরের বৈঠকখানায় প্রার্থী বাছাই চলে এবং বিজ্ঞজনেরা নির্বাচনী কৌশল তৈরীতে সচেষ্ট হন। এমন নির্বাচনী পরিবেশ পুরো বাংলার গ্রামীণ জনপদ সমানভাবেই দৃশ‍্যমান। সমর্থকদের আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। দেয়াল লিখন রংবেরঙের ফেস্টুন, পোষ্টার ও ব্যানারে গ্রামবংলাকে বাসরঘরের মতো সাজিয়ে তোলা হয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাচীনতম একটা প্রক্রিয়া যা কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তৃণমূলের মেলবন্ধন তৈরীর একটা মাধ্যম।

প্রাক্-মধ্যযুগ থেকে কেন্দ্রীয় সরকার স্থানীয় সরকারের হাত ধরে তৃণমূলকে ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত রেখেছে স্থানীয় এই সংস্থাটি। প্রাক-মধ্যযুগে রাজা মহারাজাদের সরকারে হেডম্যান ও পঞ্চায়েত পদ্ধতিতে স্থানীয় সরকার পরিচালিত হতো। হেডম্যান কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত প্রতিনিধি। ট্যাক্স সংগ্রহ ও কেন্দ্রের নীতিমালা বাস্তবায়নের দায়িত্ব পালন করতেন।
সিলেকশন পদ্ধতি বা ইলেকশন প্রক্রিয়ায় পঞ্চায়েত জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতো। পঞ্চায়েত পরিষদ রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সমন্বয় রক্ষা করে স্থানীয় প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা, অসামাজিক-অনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ, বিয়ে সম্পাদন, সস্পদ সংগ্রহ ও উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জনমত তৈরী, ফসল ও রবিশস্য উৎপাদনের জন্য সেচ, বাঁধ ও নদী, বিল, পুকুর, জলাশয়ের পরিচর্চা এবং সেতু নির্মাণসহ বনজসম্পদ রক্ষা ও অনাবাদি জমির সংস্কার পঞ্চায়েতের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হতো। এক কথায় (মোদ্দাকথা) পঞ্চায়েতই ছিলো গ্রামীণ প্রশাসনিক কার্যক্রমে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান।

প্রশাসনিক বিভিন্ন কাঠামোগত পদ্ধতি:

মধ্যযুগের সুলতান, নবাব ও সম্রাটদের আমলে স্থানীয় সরকারকে প্রশাসনিক সুবিধার লক্ষ্যে চার স্তরে বিভক্ত করা হয়। (১) সুবা (২) চাগলা (৩) পরগনা (৪) থানা।
সুবা প্রধানকে নাজিম বা সুবেদার, ছাকলা প্রধানকে ফৌজদার, পরগনা প্রধানকে সিকদার ও থানা প্রধানকে থানাদার বলা হত। পরগনা প্রধান শিকদার আধি পঞ্চায়েতের সাদৃশ্যে কার্য্য সম্পাদন করতো এবং শিকদার পদবি প্রশাসনিক পদবি বলে বিবেচ্য ছিলো। মুগল সম্রাটদের সময় তৃণমূলবাসী শান্তি শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধ ছিলো বলে ইবনে বতুতার বর্ণনায় পাওয়া যায়।
পাশাপাশি প্রাক্-মধ্যযুগ থেকে বংশানুক্রমে জমিরস্বত্ব প্রাপ্ত ভূ-স্বামীরা (ভুঁইয়া) এবং সুলতান ও নবাবদের আশীর্বাদপ্রাপ্ত জমিদাররা জমি ও ফসলের শুল্ক আদায় করতো।
জমিদারী প্রথার শুরুতে জমিদাররা শুধু জমির শুল্ক আদায়কারি ছিলেন, জমির স্বত্বাধিকারী ছিলেন না। পক্ষান্তরে জমির মালিক ছিলো রায়ত বা চাষি, যাদের নামে জমাবন্দি বা রেন্ট—রোল তৈরী হয়েছিলো।

১৫৮২ সালে সম্রাট আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী বা সুবাদার টোডরমলের ভুমিবন্দোবস্ত পদ্ধতি জমিদার প্রথার সূচনা করে। ১৬৫৭ সালে সুবাহ বংলায় শাহ সুজাউদ্দৌলা জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।
পরবর্তিতে মুর্শিদ কুলী খান সুবা বংলাকে ১৩টি চাকলায় ভাগ করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জমিদারদেরকে বৃহৎ জমিদারদের অধীনস্থ করে চকলাদার নিয়োগ দেন। তাঁরা দক্ষতার সাথে রাজস্ব সংগ্রহ নিশ্চিতকরণের কর্মকর্তা রূপে অধিষ্ঠিত হন। রাজ্য সরকারের “কানুনগোতাকাভি” তহবিল থেকে স্থানীয় কৃষকদের সাহায্যে ঋণদানের ব্যবস্থা ছিলো।

উপনিবেশিক শাসন আমল:

১৬৯৮ সালে কলকাতায় জমিদারী প্রথার শুরুর পর থেকে স্বার্থান্বেষী ও লোভী মহাজন ও জমিদার শ্রেণীর আনুকুল্যে বংলায় ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানির প্রভাব ও প্রতিপত্তি ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়।
১৭৫৭ সালে ক্ষমতালোভী চক্রের সহায়তায় কোম্পানির পাতানো যুদ্ধে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ে ইস্ট-ইণ্ডিয়া কোম্পানি সর্বস্তরে আধিপত্যশালী হয়ে ওঠে। রাজ্য শাসনের পূর্ণ প্রস্তুতি তাঁদের ছিলো না। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি ছিলো বণিক বা সওদাগর সম্প্রদায় গোষ্ঠী। তাঁদের কর্মকর্তারা ছিলো হিসাব রক্ষককেরানী, দক্ষ সেইলসম্যান, মার্কেটিং অফিসার, ব্যবসার নথিপত্র সংরক্ষক কিন্তু রাজ্য শাসনে তাঁরা ছিলো একেবারে অনভিজ্ঞ। অপর্যাপ্ত দক্ষ প্রশানিক জনবল, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার অজ্ঞতা, প্রতিদ্বন্দ্বী বৈদেশিক বণিকদের আগ্রাসনের কারণে ভারতীয় মিত্রদের যোগসাজশে উপনিবেশিক সম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পন্থা গ্রহণ করে সর্তক পায়ে অগ্রসর হয় কোম্পানী। কার্যতঃ কোম্পেনী প্রকৃত শাসক হয় বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী দায়িত্ব গ্রহণের পর।

জমিদার, মহাজন ও অন্যান্য এলিট সম্প্রায়কে পোষ্য করে জনসাধারণের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে তাঁরা। কোম্পনী ১৭৯৩ সালে দীর্ঘ ৩৬ বছর পর ঐতিহ্যবাহী স্থানীয় পঞ্চায়েত বিলুপ্ত করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পদ্ধতি চালু করে।
চিরস্থায়ীবন্দোবস্ত চুক্তির মাধ্যমে জমিদাররা উপনিবেশক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভূ-সম্পত্তির একচ্ছত্র স্বত্ত্বাধিকারী হয়। ব্রাহ্মণ্যবর্ণবাদীদের প্রতিনিয়ত বৈষম্যপূর্ণ আচরণে বর্ণহীন জাতি গোষ্ঠীকে অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত করে তৃণমূলে অশান্তি সৃষ্টি করছিলো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে আর্থ সামাজিকতাকে নতুন করে শ্রেণীভেদে উৎসাহী করে তোলে।

চিরস্থায়ী স্বত্বাধিকারী জমিদাররা কোম্পানীকে নির্দিষ্ট শুল্ক প্রদানের মাধ্যমে জমির স্বত্বাধিকারীত্ব অর্জন করে, সে আবার অন্য জমিদারের নিকট লাভ্য অংকে জমিপ্রদান করে। জমিপ্রাপ্ত জমিদার আবার রায়ত বা কৃষককে লাভ্য অংকে জমি চাষের জন্য প্রদান করা হতো। কৃষকদের শ্রমের বিনিময়ে অর্জিত অর্থে তিন সম্প্রদায় মুনাফা অর্জন করছিলো। কৃষকরা দিন দিন নিম্ন থেকে নিম্নে নেমে ভিখারি হচ্ছিলো, অন্যদিকে মুনাফা অর্জনের প্রকারভেদে আর্থ-সমাজিক শ্রেণীভেদ তৈরী হচ্ছিলো। কোম্পানী, জমিদার, মহাজন ও খয়রাতি জমিদারদের চাপিয়ে দেয়া অর্থভার একসময় চাষিরা বহণের শক্তি হারিয়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কৃষিউৎপাদনে স্থবিরতা নেমে আসায় কোম্পানীর সাথে চুক্তিপ্রাপ্ত শুল্ক প্রদানে জমিদাররা ব্যর্থ হয়। বহুসংখ্যক জমিদারের ভূ-সম্পদ সূর্য অস্ত আইনে নিলামে বিক্রি হতে থাকে। ১৮৭০ সালে চৌকিদারি এ্যাক্ট করে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রয়োজনে স্থানীয় সরকারের কিছু পরিবর্তন করে ইউনিয়ন পরিষদ ও চৌকিদারি পঞ্চায়েতের উপর প্রবর্তন করা হয। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তিন বছর মিয়াদি চৌকিদার পঞ্চায়েতর নিয়োগ দেয়া হতো। তাঁরা কেন্দ্রের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও শুল্ক আদায়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়।

১৮৮৫ সালে লোকাল সেল্ফ গভর্ণমেন্ট এ্যাক্টের মাধ্যমে কোম্পানি শাসনের অবসান করে সংসদীয় পদ্ধতির অঙ্গিকার ব্যক্তকরে। ফলে জনগণের অংশিদারিত্বের সুযোগ তৈরী হয়। স্থানীয় সরকারে নাগরিকদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায় এবং ঐতিহ্যবাহী পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আবার চালু হয়। ১৬টি জেলায় বাংলাকে ভাগ করে দিয়ে তিন স্তরে স্থানীয় সরকারকে বিন্যাস্ত করে।
(১) জেলা বোর্ড (২) স্থানীয় বোর্ড (৩) ইউনিয়ন কমিটি। ইউনিয়ন কমিটি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সর্বনিম্ন ৫ সদস্য ও সবোর্চ্চ ৯ সদস্য বিশিষ্ট ইউনিয়ন কমিটি গঠন করা হয়। তাতে ইউনিয়ন কমিটি স্থানীয় কাজে সংস্পৃক্ততার সুযোগ পায়। ১৯১৯ সালে লোকাল সেল্ফ গভর্ণমেন্ট এ্যাক্টের মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ভেঙে ইউনিয়ন বোর্ড করা হয়। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর ১৯৫৯ সালে সামরিক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান নির্বাহী আদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় মৌলিক গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন। ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতির স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডিয়েন্ট নির্বাহী আদেশে ইউনিয়ন কাউন্সিল পরিবর্তন করে ইউনিয়ন পঞ্চায়েত নামকরণ করেন। ১৯৭৩ সালে আরো একটি নির্বাহী আদেশে ইউনিয়ন পঞ্চায়েত পরিবর্তন করে ইউনিয়ন পরিষদ নামকরণ করা হয়।

ইউনিয়নকে তিনটি ওয়ার্ডে বিভক্ত করে একজন চেয়ারম্যান, একজন ভাইশ-চেয়ারম্যান ও নয় জন মেম্বার সদস্য নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনির মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং সংবিধানের ১১নং অনুচ্ছেদে উল্লেখিত প্রশাসনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বিলুপ্ত করে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যকারিতা স্থগিত করে দেন। বাংলার সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাকশাল নামে একদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। পাশাপাশি বিদ্যমান স্থানীয় সরকার বাতিল করে শুধুমাত্র জেলা এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল পদ্ধতি চালু করেন। যার ফলে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের পটভূমি তৈরী হয় বলে অনেকের ধারণা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের মর্মান্তিক ঘটনার পর সিপাহী জনতার হাত ধরে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন। যেটি ঐতিহাসিক ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব নামে পরিচিতি পায়।

১৯৭৬ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নতুন সরকারের অধ্যাদেশের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদকে তিন স্তরে বিন্যস্ত করেন। (১) ইউনিয়ন পরিষদ (২) থানা পরিষদ (৩) জেলা পরিষদ।
১৯৭৩ সালের জারিকৃত আধ্যাদেশে বর্ণিত ইউনিয়ন পরিষদের কার্য্যবলি অপরিবর্তিত রেখে অতিরিক্ত দুইজন মনোনীত মহিলা ও দু’জন মনোনীত কৃষক সদস্য সংযোজন করে ভাইস—চেরম্যানের পদ বিলুপ্ত করা হয়।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিএনপি সরকার স্বনির্ভর গ্রামাঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইউনিয়ন পরিষদের পাশাপাশি একজন গ্রামপ্রধান ও এগারোজন সদস্য নিয়ে গ্রাম সরকার গঠন করেন।
১৯৮২ সালে প্রেসিডেন্ট হুসেন মোহাম্মদ এরশাদ সরকার স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন ও পল্লী উন্নয়নে প্রচুর কাজ করে। ইউনিয়ন পরিষদকে পূর্বেকার অবস্থায় রেখে মনোনীত তিনজন মহিলা সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়।
রাজা, বদশাহ, সুলতান, সম্রাট, বণিক, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান মন্ত্রীদের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় রাষ্ট্রের প্রধান চালিকা শক্তি স্থানীয় সংস্থা তথা তৃণমূলকে নিয়ন্ত্রণে নেয়ার প্রচেষ্টা দীর্ঘ ও প্রাচীন একটি পদ্ধতি।
স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সময়ের ব্যবধানে, চাহিদার প্রয়োজনে বিবর্তন, পরিবর্তন ও পরিমার্জনের মাধ্যদিয়ে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।

তৃণমূল হচ্ছে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার গর্ভধারিনী মা। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত। জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ অংশ তৃণমূলের বিকাশ ও উন্নয়ন সরকার ও রাষ্ট্রের অর্জিত সফলতা। উন্নয়নকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ধার প্রান্তে পৌঁছে দেয়ার প্লাটফর্ম ইউনিয়ন পরিষদ। রাষ্ট্রের অর্জিত সুফল সুবিধাবঞ্চিত মানুষের হাতে তুলে দেয়ার গুরুদায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের উপর অর্পিত।
পরিকল্পনায় দক্ষ, সৎ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছার আত্মবিশ্বাসী ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যরাই রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ নিয়ে আসা সম্ভব। সকল সরকারই তৃণমূলের উন্নয়নের জন্য থোক বরাদ্দ দিয়ে থাকে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অদক্ষ জনপ্রতিনিধিদের লুঠপাটের মানসিক ব্যাধির কারণে সরকার প্রকলপ্তিত উন্নয়ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতে পৌঁছতে বাঁধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশ ৬৫ হাজার ইউনিয়নের মধ্যে সৈয়দ পুর শাহারপাড়া ইউনিয়ন হাজার বছরের ঐতিহ্যখ্যাত একটি ইউনিয়ন। প্রাক্-মধ্যযুগ থেকে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত আজকের সৈয়দপুর শাহার পাড়া ইউনিয়ন। অনেক বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ নেতৃত্বের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে ইউনিয়নটি।
১৩শ শতকের মহাপুরুষ হযরত শাহ সৈয়দ শামছুদ্দীন রহঃ ও হযরত শাহ কামাল রহঃ অত্র অঞ্চলের ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা, প্রচলিত সামাজিক প্রথা, রীতি-নীতি ও নেতৃত্বে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। তাঁদের কথা লিখতে গেলে ইতি টানা সম্ভব নয়।
তাঁরা কোরআনের আলোকে গড়া বৈপ্লবিক সৈনিক ছিলেন। তাঁদের উত্তরসূরী দাবিতে সামাজিক মর্যাদায় ধন্য হলেও তাঁদের হিজরতের মূল চেতনা সময়ের ব্যবধানে উপেক্ষিত।
আদ-দ্বীনু নসিহার আলোকে সমাজে, পরিবারে, ব্যক্তিতে কল্যাণ প্রতিষ্ঠার প্রেরণা এখন পরিত্যক্ত। ইসলাম শুধু তসবিহ ছড়ার বেষ্টনীতে আবদ্ধ ধর্ম নয়। জীবন-জিজ্ঞাসার বাঁকে বাঁকে ইসলামের সুনির্দষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। মানব সন্তানের যেমন দ্বীনি শিক্ষা অত্যাবশ্যক তারচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জিত জ্ঞানের বাস্তব প্রতিফলন। ইসলামের প্রত্যেকটি এবাদাহ ব্যক্তি ও সমাজ কেন্দ্রীক। বছরের পর বছর মসজিদ মাদ্রাসার সীমানায় স্তবির জিন্দেগী ইসলাম উৎসাহিত করেনি।
খ্যাতমান প্রবাদ পুরুষ হজরত মওলানা সৈয়দ জমিলুল হক (জেলিমৌলভী) রহঃ একজন বিজ্ঞ আলেম সর্বভারতের কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার পরও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিতে কুন্ঠাবোধ করেননি। এমনকি জেলিমৌলভী উপাধি অর্জনকে সৌভাগ্য মনে করেছেন। সরকারের সাথে অসংখ্য মতবিরোধ সত্যেও রাষ্ট্রীয় কল্যাণ জনগণের কাছে তুলে দেয়ার দায়িত্ববোধ থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সাথে সম্পৃক্ত রেখে ছিলেন নিজেকে।
আরেকজন আলেমে দ্বীন হযরত মওলানা সৈয়দ লুৎফুর রাহমান রহঃ যিনি সৈয়দপুর চৌধুরী বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব ছিলেন।

স্পষ্টবাদী খ্যাত খতিব লুৎফর রহমান রহঃ বলতেন, আমরা দুই অক্ষর মাদ্রসায় পড়ার পরই একটা ভিন্ন মানসিকতা তৈরী হয়। পায়ে কাঁদা লাগাতে চাই না। হাল চাষ করতে চাই না। শস্যক্ষেতের পরিচর্চা করতে চাই না, এমনকি বাড়ীর আঙ্গিনায় রবিশস্যে হাত দিতে লজ্জাবোধ করি। অথচ আমার রব দুনিয়ার সফলতা কামনার শিক্ষা দিচ্ছেন, رَبَّنَاآتِنَافِيالدُّنْيَاحَسَنَةًوَفِيالْآخِرَةِحَسَنَةً
অন্য আয়াতে নামাজ শেষে ব্যবসা বাণিজ্য কর্মের শিক্ষা দিচ্ছেন, فَإِذَا قُضِيَتِ ٱلصَّلَوٰةُ فَٱنتَشِرُواْ فِى ٱلْأَرْضِ وَٱبْتَغُواْ مِن فَضْلِ ٱللَّهِ وَٱذْكُرُواْ ٱللَّهَ كَثِيرًا 
(নামাজ শেষে আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে জমিনে ছড়িয়ে পড়ো আর বেশি বেশি আল্লাহকে স্মরণ করো যেনো সফল হয়)
তিনি আরো বলতেন, ঈমানদার, পরহেজগার ও চরিত্রবান লোকরা যদি কৃষিতে, ব্যবসায়, পঞ্চায়েতে অংশগ্রহণ না করে জমিনে, ফসলে, মাছে, পশুতে, দুধে বরকত চলে যাবে এবং সমাজ ও পারিবারিক জীবনে অশান্তি ও অস্থিরতা তৈরী হবে। হযরতের নাসিহা ও নিজ জীবন-যাত্রায় এর প্রতিফলন ছিলো। তিনি ফজরের নামাজ শেষে পানিতে নেমে মাছ ধরতেন, সবার পূর্বে গবাদী পশুর জন্য তাজা ঘাঁস কেটে আনতেন এবং প্রত্যহ নিজ হাতে স্নান দিতেন। বড় মাপের আলেম হওয়ার পরও অহঙ্কার তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। গ্রামের ছোট বড় সকলকে সহজেই আপন করে নিতেন। নামাজের তেলাওয়াতে ও বয়ানে তাঁর প্রিয় পাঠ্য ছিলো পবিত্র আয়াত لَئِن شَكَرْتُمْ لَأَزِيدَنَّكُمْ ۖ وَلَئِن كَفَرْتُمْ إِنَّ عَذَابِي لَشَدِيدٌ …। ব্যক্তিজীবনেও শুকরিয়া আদায়ী ছিলেন এই আত্মসচেতন আলেম।

আরো এক প্রাজ্ঞ আলেমের নাম নেওয়া যায়। তিনি হযরত মাওলানা সৈয়দ আব্দুল ওয়াহিদ (রহ.)। যার আরবী ব্যাকরণে পারদর্শীতা ছিলো। সৈয়দপুর শামসিয়া সৈয়দীয়া আলিয়া মাদ্রাসায় দীর্ঘদিন বিভিন্ন পদে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। গ্রাম্য ও আঞ্চলিক বিচার-পাঞ্চায়েতে তিনি গুরুত্ব প্রাসঙ্গিক ব্যক্তি ছিলেন। নিরহঙ্কার, অনাড়ম্বর জীবনাচারণে অভ্যস্থ ছিলেন তিনি।
এক্ষেত্রে আরো অনেক আলেমের নাম নেয়া যায়। যেমন: যারা নামাজ ও সমাজে, দ্বীনদারি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় আমাদের আদর্শপুরুষ।
সমাজ জীবনের অসংখ্য প্রয়োজনিয়তাকে পাশ কাটিয়ে বা চোখ বন্ধ করে সামাজিক প্রলয় ঠেকানো যায় না। গার্হস্থ্যবিদ্যা উপেক্ষা করলে বাঁধভাঙ্গা প্রলয়ের মতো মসজিদ, মাদ্রাসা, তাহজিব তামাদ্দুন খর-কোঠার মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
আলেমরা আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয় রাখেন যার জন্য সৎচরিত্রের অধিকারী হওয়া তাদের স্বভাবের একটি অংশ। আল্লাহর ভয় অন্তরে না থাকলে ন্যায় ইনসাফ প্রতিষ্ঠা আক্ষরিক অর্থে সম্ভব নয়। সেই সাথে কল্যাণকামিতা না থাকলে ধার্মীকতাও অসম্পূর্ণ। কেননা রবের নির্দেশ হচ্ছে,
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ
(সর্বোত্তম দল তোমরা, যাদেরকে হেদায়েত ও সংস্কার বিধানের জন্য কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করো, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে লোকদেরকে বিরত রাখো এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলো।)

ধর্ম কিছু আদেশ ও নিষেদের সমষ্টি। ধার্মিকতা আদেশ ও নিষেধের বাস্তবায়ন। বাস্তবায়নের ক্ষেত্র ব্যক্তি সমাজ পরিবার ও রাষ্ট্র। যদি হয় الدنيامزرعةالآخرة তাহলে কৃচ্ছ্বসাধনায় ধ্যানমগ্ন থেকে সমাজ পরিবার ও রাষ্ট্রের বিশাল ক্ষেত্রকে উপেক্ষা করে চলা ধার্মিকতা নয়। নবী আদমকে (আ.) আল্লাহপাক সর্বপ্রকার জ্ঞান দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ধীরে ধীরে সময়ের প্রয়োজনে সে জ্ঞান প্রকাশিত হচ্ছে, সে অর্থে জাগতিক জ্ঞানও আল্লাহ প্রদত্ত। আলেম অর্থ যদি হয় জ্ঞানী বা বিজ্ঞ তাহলে আলেমদের শুধু কিতাবের পাতায় চোখবন্দী থাকলে সমাজ চরিত্রে তা বিকশিত হবে না। এর ব্যাপ্তি হতে হবে সর্বব্যাপী।
সমাজ চরিত্রে আলেমদের প্রয়োজনিতা বিকশিত ও প্রস্ফুটিত হবে তখন যখন সর্বক্ষেত্রে আলেমদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
সৈয়দপুর একটা বিশাল জনবহুল গ্রাম। প্রায় প্রত্যেকটি পরিবারে একজন আলেম সদস্য রয়েছেন কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁদের উল্লেখযোগ্য বলয় তৈরী হয়নি। মানুষের নির্ভরতা অর্জনে ব্যর্থ রয়েছেন।

জাতীয় রাজনীতিতে কিছু সংখ্যক আলেমদের পদচারণা রয়েছে, ভালো কথা। জাতীয় রাজনীতি হচ্ছে বৃহত্তর দেশের জন্য এবং আদর্শিক কথা বলে জনগণের সমর্তন আদায় করা কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদ হচ্ছে সততা ও যোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে মানুষের কল্যাণে কাজ করা।
অবক্ষয়ের মহামারীতে তৃণমূলের সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে সৎ ও চরিত্রবান মানুষের বিকল্প নেই। ইউনিয়ন পরিষদ হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কল্যাণে কাজ করার একটা প্লাটফর্ম। এই প্লাটফর্ম থেকে ব্যক্তি ও সমাজের জন্য কাজ করার বিশাল সুযোগ রয়েছে। সেই সুযোগ হঠাৎ করে তৈরীও হবেনা। মসজিদের মিম্বর থেকে হঠাৎ ঘোষণায় জনগণের নির্ভরতা অর্জন কখনো সম্ভব নয়। প্রয়োজন লেন-দেন, আচার-ব্যবহার, বিচার-পঞ্চায়েত, দুর্যোগ-মহামারী ও মামলা-হামলায় অর্থবহ প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে জনকল্যাণে আলেমদের ভাবমূর্তি বিকশিত করা।

সারসংক্ষেপ কথা হচ্ছে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে উপেক্ষা করে প্রকৃত দ্বীনদার হওয়া যায় না। একই সঙ্গে ই’লম বা জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া সময়ের দাবী। এ বিজ্ঞানটা কি? বিজ্ঞান হচ্ছে যুক্তি। রাষ্ট্র ও সমাজ একটি বৈজ্ঞানিক কাঠামোর ভেতর স্থিতিশীল হয়। বর্তমান সময় আমরা একটি অস্থিরতার ভেতর দিয়ে অতিক্রম করছি। তৃণমূলের সঙ্গে আলেম সমাজের রয়েছে নাড়ীর সম্পর্ক। এখন তাদেরকে কৌশলগত চর্চায় আরো দক্ষ ও নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো। প্রবন্ধে ইতিমধ্যে দুয়েকজনের নাম উল্লেখও করেছি। সকলের মঙ্গল হোক।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close