নিউজ

টাটার বিনিয়োগ নিয়ে জয়ের বক্তব্য প্রসঙ্গে মাহমুদুর রহমান-শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সব সদস্যই মিথ্যাবাদী

বাংলাদেশে টাটার বিনিয়োগ নিয়ে শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সাম্প্রতিক একটি ভিডিও বার্তা সম্প্রতি আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এই ভিডিও বার্তার মাধ্যমে সজীব ওয়াজেদ জয় আবার প্রমান করেছেন যে শেখ হাসিনা এবং তার পরিবারের প্রতিটি সদস্যই মিথ্যাবাদী।

এক। আমি জ্বালানি উপদেষ্টা থাকাকালীন সময়ে ২০০৪ সালে টাটা গ্রুপের প্রধান রতন টাটা বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহ প্রকাশ করেন এবং একটি সার কারখানা, একটি ইস্পাত কারখানা ও সেগুলো পরিচালনার জন্য একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দেন। তাদের প্রস্তাবে শর্ত রাখা হয়েছিল যে, এই তিনটি প্রকল্পের জন্য তাদেরকে ২০ বছর যাবৎ ১.১০ মার্কিন ডলার মূল্যে প্রতি ইউনিট (এক হাজার ঘন ফিট) গ্যাস সরবরাহ করতে হবে। সেই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের মূল্য ছিল প্রতি ইউনিট ৫.৮৯ ডলার। টাটার প্রস্তাবে গ্যাসের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজার তো বটেই, দেশের অভ্যন্তরীন গৃহস্থালী কাজে ব্যববহৃত গ্যাসের মূল্যের চেয়েও অনেক কম ধরা হয়েছিল। সেই কারণে আমি তাদের ঐ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি এবং গ্যাসের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজার দর অনুযায়ী নির্ধারণ করতে বলি।২০০৬ সালে তারা গ্যাসের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি করে সার কারখানার জন্য ৩.১০ ডলার এবং ইস্পাত কারখানা ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জন্য ২.৬০ ডলার প্রতি ইউনিট দামে আবারও ২০ বছরের জন্য গ্যাস সরবরাহের গ্যারান্টি ক্লজ সহ নতুন প্রস্তাব দেয়। উল্লেখ্য যে, ইতিমধ্যে ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছিল- ৬.৭৩ ডলার। বাংলাদেশের জনগণের সম্পদ আন্তর্জাতিক বাজার মূল্যের চেয়ে কম দামে বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রী করে দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়ার মানসিকতা আমার এবং তৎকালীন সরকারের ছিল না। দিল্লির প্রভুদের কাছে বাংলাদেশের স্বার্থ বিলিয়ে দেয়ার ইতিহাস এবং ঐতিহ্য আওয়ামী লীগেরই রয়েছে। ফলে, আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সাথে টাটা গ্রুপের প্রস্তাবিত দামের এই বিপুল পার্থক্যের কারণ দেখিয়ে আমি তাদের গ্যাস ক্রয়ের প্রস্তাব ও বাতিল করে দেই। এই সময় তারা তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাব স্থগিত করে। আমিও নিয়মিতভাবে সংবাদ সম্মেলন করে পুরো বিষয়ে জনগণকে সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে অবহিত রেখেছিলাম।এরপরও টাটা গ্রুপ কম দামে গ্যাস ক্রয়ের জন্য ২০০৮ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় থাকা অন্তর্বতীকালীন সরকারের কাছে তদবির চালিয়ে যায়। কিন্তু, সেই সরকারও টাটার আবদার পুরণ করতে না পারায় ২০০৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে টাটা ঘোষণা দেয় যে, তারা তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাব ফিরিয়ে নিচ্ছে। টাটা গ্রুপের কম দামে গ্যাস চাওয়ার প্রস্তাব এবং বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তা প্রত্যাখ্যান করার বিষয়টি সেই সময়ে সকল দেশি এবং বিদেশি মিডিয়াতেই প্রচারিত হয়েছে।

দুই। টাটা গ্রুপের বিনিয়োগ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে সেই সময়ে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিটিং মিছিল করেছে। এমনকি তাদের তৎকালীন নেতা তোফায়েল আহমেদ সহ আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতা টাটার বিনিয়োগ প্রস্তাব বাতিলের জন্য দাবি করেছেন। টাটা গ্রুপের এই বিনিয়োগ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছে আনু মুহাম্মদের নেতৃত্বাধীন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি। তারা মিটিং মিছিল সভা সেমিনার করার পাশাপাশি ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন অন্তর্বতীকালীন সরকারের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টার কাছে আমার নামে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। সেখানে তারা উল্লেখ করেছে- “টাটা’র কয়লা এবং গ্যাস ও কয়লাজাত পণ্য রপ্তানিমুখী প্রকল্পের ১ম প্রস্তাব বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়নে নাকচ হয়। তিনি স্বীয় বিবেচনায় ২য় প্রস্তাব বিশেষজ্ঞদের উপেক্ষা করে তথাকথিত সচিব কমিটির মতামতের ভিত্তিতে গ্রহণ করে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পেশ করেন। সরকার গণপ্রতিরোধের মুখে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরত থাকে। তিনি টাটার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে সরকারের উপর চাপ অব্যাহত রাখেন।”আওয়ামী লীগ সমর্থিত আনু মুহাম্মদ গং এর উপরোক্ত দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল। জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে টাটার দ্বিতীয় প্রস্তাবও আমিই নাকচ করেছিলাম এবং দর-কষাকষির কোন পর্যায়েই এতদসংক্রান্ত কোন প্রস্তাব সরকারের কাছে প্রাথমিক কিংবা চুড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয় নাই। এই কারণেই আমি ভারত সমর্থিত মঈন-মাসুদ সামরিক সরকারের প্রচন্ড বিরোধিতা করা সত্ত্বেও সেই সরকার আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তুলতে সক্ষম হয় নাই।এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে- তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’র নেতৃত্বাধীন সকল আন্দোলন এর সাথেই সেই সময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সরাসরি সংযুক্ত থাকতো এবং তারা যৌথভাবে আন্দোলন করতো।সুতরাং সেই সময় টাটা গ্রুপের বিনিয়োগের বিরোধিতা করা আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কাছ থেকে টাটা গ্রুপের বিনিয়োগ না হওয়ার বিষয়ে অশ্রু বিসর্জন রীতিমতো ভন্ডামি।

তিন। বাংলাদেশে রতন টাটাকে আমন্ত্রণ জানানো, টাটা গ্রুপের প্রস্তাব প্রদান, সেটা বিচার বিবেচনা করা, তাদের সাথে দর-কষাকষি করা এবং শেষ পর্যন্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পুরো বিষয়টি বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান এবং জ্বালানি উপদেষ্টা হিসাবে আমার তত্ত্বাবধানে সরকারি আমলাদের মাধ্যমে করা হয়েছে। শুধুমাত্র রতন টাটার সম্মানে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া টাটা গ্রুপের সাথে যোগাযোগ বা আলাপ আলোচনার কোনো ক্ষেত্রেই তৎকালীন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিএনপি’র কোন মন্ত্রী, এমপি বা নেতৃবৃন্দের যোগাযোগ ছিল না এবং সেটা করার কোন অবকাশও ছিল না।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় তার মায়ের উপদেষ্টা হিসেবে বিশাল অঙ্কের বেতন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসে এসকল মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাদের পারিবারিক মিথ্যাচারের ধারাবাহিকতা কেবল রক্ষা করে চলেছেন। আমি তার মিথ্যাচারের তীব্র নিন্দা জানাই এবং আশা প্রকাশ করতে চাই যে, ভবিষ্যতে এই ধরনের মিথ্যাচার থেকে তিনি বিরত থাকবেন।

অবশ্য, একটি ফ্যাসিস্ট পরিবারের কাছ থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করা যায় না।

** মাহমুদুর রহমান- সম্পাদক, আমার দেশ ও প্রাক্তন জ্বালানী উপদেষ্টা ও নির্বাহী চেয়ারম্যান, বিনিয়োগ বোর্ড।

Tags
Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close