লণ্ডনেও বেগমপাড়া: তারিক সিদ্দিকী পরিবারের আলিশান বাড়ি

|| আব্দুর রব ভুট্টো ||

লণ্ডন, ৩ মার্চ : বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব:) তারিক আহমেদ সিদ্দিকীর পরিবার লণ্ডনে একাধিক আলিশান বাড়ির মালিক। পরিবারের যে সদস্যদের নামে বাড়ী কেনা হয়েছে, তাদের স্বল্প সময়ে এতো বিপুল সম্পদের মালিকানা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লোকজনের অর্থপাচার ও বিনিয়োগের মাধ্যমে কালো অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা ভণ্ডুল করতে তদন্ত শুরু করেছে। বাংলাদেশ থেকে বাইরে অর্থ প্রেরণ বেআইনী হলেও অতি স্বল্প সময়ে বাংলাদেশী অন্ততঃ ৪২টি পরিবার প্রতিটি পরিবার দুই মিলিয়ন পাউণ্ড দিয়ে স্থায়ী অভিবাসন কিনেছেন, তাদের অনেকেই এখন তদন্তের আওতায় আছেন বলে জানা গেছে। বিপুল অংকে কেনা সম্পদের বিষয়ে লণ্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশনের মাধ্যমে জানতে চাইলে জেনারেল তারিক সিদ্দিকীর বরাতে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২ আগষ্ট প্রায় দুই মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে বাড়িটি কেনা হয়েছে। লন্ডনের ফিঞ্চলি এলাকার গোল্ডারস গ্রীণ কোনাট ড্রাইভের বাড়িটিতে (Connaught Drive, Golders Green) তারিক সিদ্দিকীর ছোট মেয়ে বুশরা সিদ্দিকী ও তার স্বামী আশিক সালাম বসবাস করেন। ২০১৮ সালের ২ আগস্ট ল্যান্ড রেজিস্ট্রি অফিসে বাড়িটি রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে বুশরা সিদ্দিকী ও তার স্বামী মোহাম্মদ আশিক সালামের নামে। এই বাড়ি কিনতে ২৭জুলাই ২ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্য পরিশোধ করা হয়। দলিলটির অফিসিয়াল কপি যথাযথ প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করা হয়েছে।

স্থানীয় কাউন্সিল অফিস থেকে ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে দেখা গেছে, ওই বাড়িটিতে বুশরা সিদ্দিকী ও তার স্বামী মোহাম্মদ আশিক সালাম বসবাস করেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা (অবসরপ্রাপ্ত) মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিকী লন্ডনে বেড়াতে এলে অভিজাত এলাকার ওই বাড়িতে উঠেন। এখানেই আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের নিয়ে বিভিন্ন্নন সময়ে পার্টি করেন। বাংলাদেশে লুট ও খুন গুমের সাথে জড়িতদের তালিকায় বিভিন্ন সময় মি. সিদ্দিকীর নাম উঠে এসেছেে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এব্যাপারে খবর প্রকাশিত হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেজর জেনারেল (অব:) তারিক সিদ্দিকী তার বড় মেয়েকে লন্ডনের পার্শ্ববর্তী শহর ক্যান্টে আরেকটি দামী বাড়ি কিনে দিয়েছেন। এইসব দামী আলীশান বাড়ি কিনতে স্থানীয়ভাবে যে আয় এবং ঋণ নিতে হয় সাধারণভাবে তার কোনোটাই বুশরা সিদ্দিক ও নওরিন তাসমিন সিদ্দিকের থাকার কথা নয়। তাহলে এই বিপুল অঙ্কের অর্থের উৎস কি? বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে বাড়িঘর কেনার জন্য অর্থ প্রেরণের সুযোগ নেই। দুর্নীতি ও নানা অবৈধপথে যুক্তরাজ্যে বিনিয়োগের এসব ঘটনা এখন যুক্তরাজ্য সরকারের তদন্তাধীন। এ নিয়ে Serious Fraud Office (SFO) এবং UK Financial Intelligence Unit (UKFIU) কাজ করছে বলে জানা গেছে। মেজর জেনারেল (অব:) তারিক সিদ্দিকী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোটবোন শেখ রেহানার দেবর। আর বুশরা সিদ্দিক ও নওরিন সিদ্দিক বৃটিশ পার্লামেন্টের এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের চাচাতো বোন।
জবাব নেই
গত ১১ ফেব্রুয়ারী যথারীতি ই-মেইলের মাধ্যমে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে জেনারেল তারিক সিদ্দিকীর কাছে এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। প্রশ্নমালার মধ্যে ছিল—
এক. এটা কি সঠিক যে মেজর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) তারেক আহমদ সিদ্দিকী লন্ডনে তার মেয়ে ও জামাতাকে প্রায় দুই মিলিয়ন পাউন্ড মূল্য পরিশোধ করে একটি বাড়ি কিনে দিয়েছেন। এই তথ্যটি সঠিক কিনা?
দুই. যদি তথ্যটি সঠিক হয় তবে লণ্ডনে বাড়ি কেনার কারণ কি? যদি তা না হয়ে থাকে, তবে কি তিনি সেই বাড়ির বিষয়ে অবগত?
তিন. মিলিয়ন পাউণ্ডর বাড়ি নগদ পরিশোধ করে কেনার মতো আর্থিক অবস্থানে নেই তারেক সিদ্দিকীর মেয়ে এবং জামাতা, এটা বিবেচনা করার মতো যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। তাহলে কি ভাবে তারা বাড়িটির মূল্য এককালীন পরিশোধ করলো? ইংল্যান্ডে এককালীন মূল্য পরিশোধ করে এমন বাড়ি কেনার ক্ষেত্রে তাদের আয়ের উৎস কি? বাংলাদেশ থেকে গত কয়েক বছরে বিদেশে বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা পাচার করা হচ্ছে। বুশরা সিদ্দিকী ও আশিক সালাম দম্পতির ওই বাড়ি বাংলাদেশ থেকে পাচারকৃত টাকায় কেনা কি না? কিন্তু ১৯ দিন পরেও (২মার্চ পর্যন্ত) সুরমা কোনো জবাব পায়নি। এই খবর প্রকাশের পরও জেনারেল সিদ্দিকী, তাঁর পরিবার অথবা হাইকমিশনের পক্ষ থেকে কোনো জবাব পেলে সাপ্তাহিক সুরমা তা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করবে।
উল্লেখ্য, সদ্য বিগত সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমদ এক টেলিকথপোকথনে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকারের হাতে যে সকল গুম ও রাষ্ট্রীয় খুন হয়েছে তার অন্যতম কুশীলব হলেন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক সিদ্দিকী। জেনারেল আজিজ তার কোর্সমেট কর্নেল শহিদের সাথে টেলিফোন কথপোকথনের সময় উল্লেখ করেছিলেন, (শেখ হাসিনার সকল খুন খারাবি করে থাকে ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল আহসান এবং ব্রিগেডিয়ার জোবায়ের। জেনারেল আজিজের জবানীতে,”যত কুকীর্তি আছে, জিয়া (ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল আহসান) আর জুবায়ের এই দুজনকে দিয়া (তারেক সিদ্দিকী) করায়—- এখনো করায়, দোস্ত এখনো করায়।… এই যে গুম থেকে শুরু করে এগুলা কিন্তু আমাকে আবেদীন (মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন, তত্কালীন ডিজিএফআই ও বর্তমানে চট্টগ্রামের জিওসি) অনেকবার বলছে, স্যার এগুলো সব জিয়াকে দিয়ে করায়। আমি কিন্তু জিয়াকে চেইঞ্জ করার জন্য প্রপোজাল নিয়া গেছিলাম একদম উপরে, কিন্তু রাজি হয় নাই। করে নাই। দোস্ত বুঝছস, চাইলেই কিন্তু অনেক কিছু হয় না!” এমনকি কর্নেল ব্যবসায়িক বিরোধের জের ধরে কর্নেল শহীদের দুই স্টাফ কর্মকর্তা ও ও তার আইনজীবীকে সরকারী বাহিনী দিয়ে গুম কর হত্যা করা হয়। এ সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরা।
বেগম পাড়ার দীর্ঘ তালিকা
সাপ্তাহিক সুরমার অনুসন্ধানের তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। লন্ডন কানাডা দুবাই ও মালয়েশিয়ায় এই পাচারের ঘটনা ঘটছে সবচেয়ে বেশি। এই শহর গুলোতে গড়ে উঠেছে একেকটি বেগম পাড়া। কোথাও থাকেন দুর্নীতিবাজদের বেগমরা আর কোথাও থাকেন সন্তান সন্ততি। এই তালিকায় পুলিশের আইজি ও সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার শিকার বেনজির আহমেদ, সদ্য সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ, এনএসআই প্রধান মেজর জেনারেল টিএম জুবায়ের আহমেদের পরিবার, দুবাইতে প্রধানমন্ত্রীর মেয়ে পুতুলের জামাই খন্দকার মাশরুর হোসেনের বাড়ী,বিপুল অংকের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ও ক্রিমিনাল কেস এবং ওই মামলায় এক বা একাধিক ভিভিআইপির জড়িয়ে পড়ার খবর, দুবাইতে শিক্ষামন্ত্রী দিপু মনি’র স্বামীর বিপুল সম্পদের খতিয়ান নিয়ে প্রামাণ্য তথ্য, ফারমার্স ব্যাংকের বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়া ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি চৌধুরী নাজমুল সিদ্দিক এবং সরকারী দলের আরও বেশ কয়েকজন লুটেরা ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার-আমলার সম্পদ ও ব্যবসা নিয়ে সুরমায় আসছে ধারাবাহিক প্রতিবেদন।
