নিউজ
চলমান

একাকীত্ব ও বৃদ্ধাশ্রম

।। ডরিনা লাইজু।।

দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই থাকি না কেনো বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে আমাদের ধ্যান ধারণা এখনও প্রায় একই। বৃদ্ধাশ্রম বলতে এখনও কানে বেজে উঠে নচিকেতার সেই গানটি:-
“ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার/মস্ত ফ্লাটে যায়না দেখা এপার ওপার/নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী/ সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি/ ছেলের আবার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম/আমারই ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম”

একবিংশ শতাব্দীতে বসবাস করেও বৃদ্ধাশ্রম বা Old home এর ইতিবাচক দিকটি এখনো অনেকে মানতেই রাজী নয়। বৃদ্ধাশ্রমের সাথে সাথে সন্তানদের গলায় অপবাদের মালা জুড়ে দিতেই সবাই বেশি আনন্দ পায়।আক্রমনাত্মক ভাষায় তুলনা শুরু করে দেয় ছোটবেলায় বাবা-মা সন্তানের জন্য কি কি কষ্ট বা ত্যাগ করছে।


অথচ তারা ভুলে যায় যে জীবিকার প্রয়োজনে এই বৃদ্ধ বাবা মাও অতীতে দুধের শিশুকে ডে- কেয়ারে রেখে গিয়েছেন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কিংবা অর্থ আর স্বর্নালংকারে তালা দিয়ে নিরাপদে রেখে নিজ সন্তানকে কাজের লোকের কাছে রেখে গিয়েছেন অনিরাপদ করে।


বৃদ্ধাশ্রমের সমালোচকরা ভুলে যায় তিন থেক পাঁচ কেজি ওজনের একটি শিশু সন্তানকে একা পরিচর্যা বা সেবা করা সম্ভব কিন্তু একক পরিবারে একজন প্রবীণ মা/ বাবাকে তাদের আকার এবং ওজনের কারনে একার পক্ষে পরিচর্যা করা অনেক ক্ষেত্রে সম্ভব হয়ে উঠেনা।


শিশু সন্তানের বয়স যত বাড়ে তারা হাঁটতে শিখে, নিজের কিছু কিছু কাজ নিজে করতে শিখে, সেই সাথে মা-বাবার দায়িত্ব বা শারিরীক কষ্ট ধীরে ধীরে কমতে থাকে এবং বলা চলে সন্তানের বয়স ১২ থেকে ১৫ বছর হলে তাদের প্রতি মা-বাবার শারিরীক পরিশ্রমের মাত্রা অনেকটাই কমে যায় । অর্থাৎ সন্তানের প্রতি বাবা মায়ের কায়িক পরিশ্রমের সময়সীমা সীমিত বা অনেকটা সুনির্দিষ্ট । পক্ষান্তরে বৃদ্ধ মা বাবার বয়স যত বাড়তে থাকে সন্তানের উপর তত বেশী নির্ভরশীল হতে থাকে এবং চিকিৎসা ব্যাবস্হার উন্নতির কারণে মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ায় নির্ভরীলতার এ দায়িত্ব এবং স্হায়িত্ব কতদিনের সে সময় সীমা কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়।


মা-বাবা যখন সন্তানকে লালন পালন করে তখন তারা বয়সে তরুন থাকে তাই তারা শারিরীকভাবে সক্ষম থাকে কিন্তু অতি প্রবীন মা-বাবাকে দেখাশুনার ভার যখন সন্তানের উপর এসে পড়ে তখন কিন্তু সেই সন্তানদের বয়স ও অনেক বেড়ে যায়, তখন বয়সের কারনে তাদের পক্ষে মা বাবাকে যথাযথ সেবাযত্ন করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এই দিক থেকে বৃদ্ধাশ্রমের বিকল্প নেই।

আর্থিক সংগতি থাকার কারণে নামমাত্র সেবক নিয়োগের মাধ্যমে অনেকেই মা-বাবাকে নিজের কাছে রাখতে গিয়ে অনেক সময় মা-বাবার জীবনকে নিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, কারন যে পরিবারে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কর্মজীবি তারা বৃদ্ধ মা বাবাকে সেবক বা কাজের লোকের দায়িত্বে রেখে যান; অথচ পারিশ্রমিক পাওয়া সত্বেও তারা হয়তো তাঁদের নিয়মিত ঔষধ সেবন করানো বা অন্যান্য সেবা যত্ন সঠিক ভাবে করেনা, তার উপর তাদেরকে নির্মম ভাবে অত্যাচার করে। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে আমরা এধরনের চিত্র সকলেই কমবেশী দেখেছি।


অন্যদিকে আমাদের সামাজিক ব্যবস্হায় স্বল্প আয়ের পরিবার গুলোতে বৃদ্ধ বাবা মায়ের দায়িত্ব বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুত্রবধূর উপর এসে পড়ে। যদি সেই পুত্রবধূ একজন দায়িত্বশীল ভালো মানুষ হয় তাহলে তার কথা একবার ভাবুন। তার ব্যক্তি স্বাধীনতা কতটা শৃংখলিত হয়ে পড়ে ! বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ীর কিংবা নানা- নানী বা দাদা-দাদীর যত্নে সামান্যতম অবহেলা করলে তাকে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তার জীবন যাত্রা পুরোটাই আবর্তিত হয় শ্বশুর শাশুড়ী বা বয়োবৃদ্ধদের কেন্দ্র করে। পরিবারের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তার আর নিজের জন্য একান্ত বা নিজস্ব বলে কিছু থাকেনা।
আর সে যদি একজন বিবেক বর্জিত মানুষ হয় অথবা অনিচ্ছার সাথে এই দায়িত্ব পালনে বাধ্য হয় তাহলে তা মা-বাবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কতটা ভয়াবহ হতে পারে আজকাল তা আর কারো অজানা নয়।


একারনে বৃদ্ধাশ্রম প্রসংগে সন্তানকে অপবাদ না দিয়ে বাস্তবতার নিরীখে যদি বৃদ্ধাশ্রমকে মূল্যায়ন করা যায় তাহলে অনেক সমস্যার সঠিক মোকাবেলা সম্ভব হতে পারে। একবার ভেবে দেখুন তো নি:সংগ একাকী অবহেলায় পরিবারের সদস্যদের মাঝে পড়ে থাকার চেয়ে বৃদ্ধাশ্রমে সমবয়সীদের সাথে সারাদিন গল্প করে কিংবা তাদের সাথে পিকনিক, বৈকালিক ভ্রমন, নিয়মিত চায়ের আসরে অতীত বর্তমানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তুমুল আড্ডা,টুকটাক খুনসুটি সবকিছু মিলিয়ে তাঁদের জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো হয়ে উঠতে পারে ছন্দময় এবং অর্থবহ।


সুতরাং বৃদ্ধ মা- বাবাকে অবহেলায় গৃহে ফেলে না রেখে কিংবা শুধুমাত্র বৃদ্ধাশ্রমে ফেলে না রেখে তাদের সুস্বাস্হ্য এবং আনন্দময় জীবন যাপন নিশ্চিত করতে বৃদ্ধাশ্রমের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। ছুটির দিন গুলোতে এবং উৎসবের সময় গুলোতে তাঁদের বৃদ্ধাশ্রম থেকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসা, তাঁদের সাথে সময় কাটানো কিংবা তাঁদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার মতো কাজগুলো অনায়াসেই করা যেতে পারে। এতে করে একক পরিবারের সমস্যা মোকাবেলা করা অনেকাংশেই সম্ভব। সেইসাথে বয়োবৃদ্ধরাও সন্তানদের কর্ম ব্যস্ততার কারণে নিজেদের একাকীত্বের যন্ত্রনা ভুলে থাকতে বৃদ্ধাশ্রমে থেকে নিজেদের সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের সাথে আনন্দঘন পরিবেশে সময় পার করে নিজেদের শরীর ও মন দুই-ই ভালো রাখতে পারেন । সময় এসেছে বৃদ্ধাশ্রমকে নিয়ে নতুন করে ভাববার। পেশাগত সমাজকর্মীর সমন্বয়ে যথাযথ নীতি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তত্বাবধানের মাধ্যমে পেশাগত মনোভাব সৃস্টি করা এবং জনমনে এই বিষয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভংগী গড়ে তোলার।

আসুন বৃদ্ধাশ্রমের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করে আধূনিক বিশ্বের কর্মব্যস্ত প্রাত্যহিক জীবনের চ্যালেন্জ মোকাবেলা করতে প্রয়োজনে বৃদ্ধাশ্রমের সহযোগিতা নেই। এতে করে আমাদের সমাজের সিনিয়র সিটিজেনদের জীবনের অবশিষ্ট সময়গুলোকে আনন্দময় করে তোলা সম্ভব হবে। সেই সাথে পরিবারের সকল সদস্যের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কেরও বহুমাত্রিক ইতিবাচক উন্নতি সাধিত হবে, এর মাধ্যমে একাকীত্ব বা নি:সঙ্গতার শিকার হয়ে আত্মহননের মতো ভয়াবহ বিষয়টিকে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে আপনার আমার আমাদের সকলের সক্রিয় ভূমিকা পালনের সুযোগ তৈরী হবে।

পরিশেষে একটি অনুরোধ রেখে যেতে চাই, যদি আর্থিক সংগতি আর যথাযথ লোকবল থাকে, তবে পরিবারের বয়োবৃদ্ধদের নিজেদের কাছে রাখুন, তাঁদের ভালোবাসুন, তাঁদের পাশে থাকুন। সেই সাথে নিজে সুস্হ্যভাবে বাঁচুন এবং নিজ বার্ধক্যকে মোকাবেলার প্রস্তুতি নিন।

ডরিনা‌ লাইজু: লেখক-সাংবাদিক ও বিভাগীয় সম্পাদক, সাপ্তাহিক সুরমা।

Sheikhsbay

সম্পরকিত প্রবন্ধ

Back to top button
Close
Close