মুক্তচিন্তা

কিংবদন্তি সাংবাদিক শফিক রেহমানের ৮৭তম জন্মদিন


।। শামসুল আলম লিটন ।।

সমকালীন ইতিহাসে পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিক যায়যায়দিন সম্পাদক, নির্যাতিত সাংবাদিক শফিক রেহমানের আজ (১১ নভেম্বর,’২১) ৮৭তম জন্মদিন। ১৯৩৪ সালের ১১ নভেম্বর তিনি বগুড়া সদরে সিভিল সার্জনের বাসভবনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নানা খান সাহেব ফজলুর রহমান খান বাংলা-বিহার-উরিষ্যার প্রথম মুসলিম সিভিল সার্জন ছিলেন। তাঁর পিতা অধ্যাপক সাইদুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের একসময়ের শিক্ষক) বাংলাদেশে শিক্ষা ও দর্শনশাস্ত্রে অসামান্য অবদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন।

বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের প্রবর্তক, গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার জন্য লড়াকু এই কিংবদন্তি সাংবাদিক তাঁর চিন্তা ও লেখার জন্য বর্তমান সময়েও দেশান্তরী হয়ে আছেন। ক্যান্সারে চিকিৎসাধীন স্ত্রী মহীয়সী নারী তালেয়া রেহমান এর পাশে তিনি এখন তার জটিল দিনগুলো কাটছে।

এই কিংবদন্তি সাংবাদিক একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিলাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। বিবিসি সংবাদ বিভাগে কাজ করার পাশাপাশি বিলাতে মার্কিন দূতাবাসের সামনের সড়কে পাকিস্তানের জাতীয় দিবস ১৪ অগাস্ট ১৯৭১ বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গনহত্যার উপর নাটক মঞ্চায়ন করেন। এসময় তিনি মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার দেখাতে গিয়ে বন্দুকের রাইফেলের বাটের আঘাতে তিনি গুরুতর আহত হন। অল্পের জন্য তিনি প্রাণে রক্ষা পান।

আশি ও নব্বইয়ের দশকের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাগজ যায়যায়দিন বাংলাদেশের গণমাধমের জগতে নতুন ধারার সূচনা করে।প্রতিষ্ঠিত লেখকের স্থলে তিনি পাঠকদের মধ্য থেকেই গড়ে তুলেন অসংখ্য লেখক। ‘দিনের পর দিন’ শিরোনামে শফিক রেহমানের নিয়মিত কলামে মঈন মিলার সংলাপের মাধ্যমে সমকালীন কঠিন ও জটিল পরিস্থিতি গুলোকে সহজভাবে পাঠকের কাছে তুলে ধরতেন। গল্প কিংবা কথিকা নয়, বরং তাবৎ পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও প্রামাণ্য তথ্যের ভিত্তিতে লেখা তাঁর প্রতিটি কলাম পাঠক মহলে আলোড়ন তুলতো । তাঁর শক্তিমান লেখনীর কারণে বারবার তিনি শাসকগোষ্ঠীর হামলা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। স্বৈরাচার এরশাদের পুতুল সংসদকে ব্যঙ্গ করে “ত্রিশ সেট অলংকার” শিরোনামে কভারস্টোরির কারণে এরশাদ তাঁকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। এরশাদের নিরাপত্তা বাহিনী তাঁকে লন্ডনগামী বিমানে তুলে দেন।

আশির দশকে শেষ থেকে তিনি বাংলাদেশ ভালোবাসা দিবস প্রবর্তন করেন সেই থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারী ভালোবাসা দিবস এখন বাংলাদেশের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। কিংবদন্তি সাংবাদিক, সঙ্গীত ও চলচ্চিত্র বিষয়ে গভীর জ্ঞানের অধিকারী শফিক রেহমানের টেলিভিশন অনুষ্ঠান “লাল গোলাপ” গত দুই দশকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জনপ্রিয় টিভি শো । বাংলাদেশে গণমাধ্যমে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছাড়াও তিনি বিলাতে প্রথম এশিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস  “স্পেকট্রাম রেডিও’ প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থেচার স্পেকট্রাম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেছিলেন। এছাড়া সাপ্তাহিক সুরমাসহ বিলাতের বাংলা সংবাদপত্র জগতের পাশে থেকেছেন তাদের যেকোনো প্রয়োজনে। 

পেশাগত কারণে দেশান্তরী হয়েছেন, এমনকি জেল খেটেছেন। কিন্তু গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকারের প্রশ্নে লড়াকু ব্যক্তিত্ব শফিক রেহমান কখনো আপস করেননি। এবছর ভালোবাসা দিবসে তিনি সাপ্তাহিক সুরমা ও এলটিভি বাংলা’র সঙ্গে অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, একমাত্র  ভালোবাসাই আমাদের পৃথিবীকে বহু অনাকাঙ্খিত সংঘাত থেকে মুক্তি দিতে পারে। তিনি আজীবন এজন্য কাজ করে যেতে চান বলে দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেন। একজন সফল পেশাদার হিসাববিদ, সম্পাদক, সাংবাদিক, ব্রডকাষ্টার শফিক রেহমান সকল কর্মে তাঁর সহধর্মিণী, কৃতি শিক্ষক ও মানবিক ব্যক্তিত্ব তালেয়া রেহমানের সর্বাত্মক সমর্থন ও আত্মত্যাগের কথা ওই অনুষ্ঠানে উল্লেখ করেন। ভালোবাসা দিবসের ওই অনুষ্ঠানে সর্বশেষ তাঁরা দুজনে একই সঙ্গে যোগ দেন এবং তাঁদের জীবন, সংগ্রাম ও ভালোবাসার নানাদিক আর পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দেশপ্রেমের সংগ্রামে জয়যুক্ত হবার আহবান জানান।

সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পরবর্তীতে দৈনিকে রূপান্তর হয় এবং ক্রমশ পাঠকপ্রিয়তা পেতে থাকে। কিন্তু ১/১১-র জেনারেল মঈন -ফখরুদ্দিনের সরকার পত্রিকাটি তাঁর কাছ থেকে জোরপূর্বক কেড়ে নেয় এবং ভিন্ন কর্তৃপক্ষের কাছে  হস্তান্তর করতে তাঁকে বাধ্য করে। এছাড়া তিনি রাজনৈতিক রম্য কাগজ ‘মৌচাকে ঢিল’ পত্রিকা দীর্ঘ সময় ধরে সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থের প্রণেতা শফিক রেহমান ২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ড বিলোপের লক্ষ্যে জনমত গঠন শুরু করেন। এই লক্ষ্যে তিনি সাপোর্ট লাইফ বলে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। “মৃত্যুদণ্ড- দেশে দেশে যুগে যুগে” (২০১৫) শিরোনামে তাঁর লেখা গ্রন্থ নানা মহলে চিন্তা ও আলোচনার সূত্রপাত ঘটায়। তাঁর লেখা অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- ১. রিপু কাহিনী (১৯৭২) ২. মানুষ তৈরির মেশিন (১৯৭৮) ৩. যায়যায়দিন (১৯৮৪) ৪. সোনার হরিণ (১৯৯৪) ৫. খ্যাতির শিখরে প্রেমের গভীরে (১৯৯৪) ৬. ভালোবাসা-১ (১৯৯৫) সম্পাদিত ৭. ভালোবাসা-২ (১৯৯৫) সম্পাদিত ৮. ভালোবাসা-৩ (১৯৯৫) সম্পাদিত ৯. আই.কিউ. (১৯৯৫) ১০. যাত্রা হলো শুরু (১৯৯৫) ১১. ফেরারি চোখে (১৯৯৫) ১২. শ্রেষ্ঠ উপদেশ (১৯৯৬) সম্পাদিত ১৩. স্ত্রী ভাগ্য (১৯৯৬) ১৪. গণতন্ত্র (১৯৯৯) ১৫. গল্প লেখার টেকনিক (২০০৫) ১৬. নির্বাচিত ছোট গল্প ওয়ার্কশপ (২০০৫) ১৭. বিধ্বস্ত দেশ বিপন্ন মানুষ (২০১২) ১৮. নেড়িকুকুরের কাণ্ড (২০১২) ১৯. নেড়িকুকুরের কীর্তি (২০১২) ২০. সংগ্রামী নেত্রী খালেদা জিয়া (২০১২) ২১. ডেমোক্রেটিক লিডার খালেদা জিয়া (২০১২) ইংরেজি বই ২২. রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান (২০১২) সম্পাদিত ২৩. স্টেটসম্যান জিয়াউর রহমান (২০১২ ইংরেজি বই সম্পাদিত ২৪. উই রিভোল্ট (২০১২) ২৫. চিরদিনের কবিতা (২০১৩) সম্পাদিত ২৬. চট্টগ্রাম পোলো গ্রাউন্ড লুণ্ঠন (২০১৫) ২৭. ভালোবাসা এয়ারপোর্ট (২০১৭) ২৮. ভালোবাসা টার্মিনাল (২০১৭) ২৯. ভালোবাসা কাফে (২০১৭) ৩০. ভালোবাসা হোটেল (২০১৭) ৩১. ভালোবাসা পার্ক (২০১৭)।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close