মুক্তচিন্তা

ইয়েমেনে জাতিসংঘ স্বীকৃত সরকার ও হুতি বিদ্রোহীদের মধ্যে অন্যরকম এক মুদ্রাযুদ্ধ

|| আখলাক আহমেদ ||

লেখকঃ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক। কূটনৈতিক সম্পাদক, সাপ্তাহিক সুরমা, যুক্তরাজ‍্য।।

আফগানিস্তানের যুদ্ধ থেমে গেছে কিন্তু ইয়েমেন এর গৃহযুদ্ধ থামাথামির কোনো লক্ষণ নেই। মার্কিন ও সৌদি মদদপুষ্ট ইয়েমেন এর মনসুর হাদীর সরকার দেশের বেশিরভাগ এর উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে এমনকি রাজধানী সানা থেকেও উৎখাত হয়েছে – এ বহু পুরনো খবর। সৌদি মার্কিন সহায়তায় ২০১৬ সালে দেশে ফিরতে পেরেছে এবং অদ্যাবধি দক্ষিণের এডেন গিয়ে রাজধানী স্থাপন করে সেখান থেকেই সরকার পরিচালনা করছে। তবে এর মাঝে এক নতুন ধরনের যুদ্ধ শুরু হয়েছে যার সম্পর্কে বাকি বিশ্ব অনেকটাই বেখবর। আর তা হলো দুই পক্ষের মধ্যে মুদ্রা নিয়ে যুদ্ধ। ইয়েমেনের মুদ্রার নাম রিয়াল, এক দেশে দুই সরকার থাকলেও হুথি বিদ্রোহী ও এডেন সরকার উভয়ই একই মুদ্রার ব্যবহার করে আসছিল। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মুদ্রা রিয়াল নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে জমজমাট অর্থনৈতিক লড়াই পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে।

হুথি বিদ্রোহীদেরকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করতে জাতিসংঘ সমর্থিত এডেন সরকার ২০১৯ সালে তাদের মুদ্রা রিয়ালের নতুন ব্যাংক নোট ইস্যু করে। সানা হুথিদের হাতে পতনের পূর্ব পর্যন্ত তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেখানেই অবস্থিত ছিল। হুতি বিদ্রোহীরা সানা দখল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং পূর্বের নোটগুলো জারি রাখে। তবে এডেনে নতুন সরকার গঠনের পরে জাতিসংঘ সমর্থিত ইয়েমেন সরকার সেখানে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থানান্তরিত করে এবং ২০১৯ সালে নতুন ব্যাংক নোট ইস্যু করে। হুথিদের সরকার তাৎক্ষণিকভাবে সেই ব্যাংক নোটগুলোকে অকার্যকর ঘোষণা করে এবং পূর্বের নোটগুলো দিয়েই আদান-প্রদান জারি রাখে। এদিকে সমগ্র ইয়েমেনের জনগণ (বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত বা সরকার নিয়ন্ত্রিত যেই অঞ্চলেই বাস করুক) সবাই পূর্বের নোটের প্রতি তাদের আস্থা ধরে রাখে। মুশকিল হল পরস্পর বিরোধী দুই সরকারের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলসমূহে ডলারের সাথে মুদ্রা বিনিময় হার দুই রকম। হুথি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ডলারের সাথে রিয়ালের বিনিময় হার এক ১:৬০০ কিন্তু এডেন সরকারের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ডলারের সাথে রিয়ালের বিনিময় হার  ১:১০০০। স্পষ্টতঃ  এখানে হুতি বিদ্রোহীরাই সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।

একই দেশে একই মুদ্রার দুই রকম বিনিময় হার এক অভাবিতপূর্ব ঘটনা বটে। তবে এর মূল্য দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান সমূহকে। বিবদমান দুপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন দেশের উভয় অংশেই ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিয়েছে। একই মুদ্রার একই দেশের ভেতরে একাধিক বিনিময় হার একটি নতুন ব্যবসারও সুবিধা করে দিয়েছে কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্য। হুথিদের ব্যাংক নোট গুলো দক্ষিনে গেলে সেগুলো শতকরা ৪০ ভাগ মূল্য বেশি পাচ্ছে।

দীর্ঘকালীন গৃহযুদ্ধ, খরা, বাস্তুচ্যুতি ফসলহানি ও জীবনহানির ফলে পর্যুদস্ত ইয়েমেন অর্থনৈতিকভাবে বলা যায় একেবারে পংগু অবস্থায় পৌঁছেছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তেমন নেই বললেই চলে। বেশিরভাগ স্কুল কল-কারখানা হসপিটাল এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গিয়েছে অথবা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় রিয়ালের মারাত্মক দরপতনের পরে সেখানে ভীষণ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধানে জানা যায় জাতি সংঘ সমর্থিত সরকার পুরনো ব্যাংক নোট বাতিল করে এডেনে স্থানান্তরিত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে নতুন ব্যাংক নোট চালু করেছে। কিন্তু সেই নতুন ব্যাংক নোটগুলো উত্তর ইয়েমেনে তেমন কোনো গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ফলে সেগুলো ঘুরেফিরে দক্ষিণ ইয়েমেনে থেকে গেছে। যেহেতু অল্প পরিসরে অনেক বেশি তরল মুদ্রা ঘনীভূত হয়েছে সেজন্য মুদ্রার দর পড়ে গেছে। হুথিদের দুর্বল করার জন্য গৃহীত মুদ্রানীতি দক্ষিণের সরকারের নিজেদের জন্যই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই অবস্থা থেকে বাঁচার জন্য জাতি সংঘ সমর্থিত হাদি সরকার নতুন বুদ্ধি বের করেছে। আর তা হল পূর্বের প্রচলিত ব‍্যাংক নোটগুলো এডেন থেকে নতুন করে ছাপানো হয়েছে। বিদ্রোহী হুথিরা এর জবাব দিতে সময় নেয়নি। তারা পুরনো মডেলের এই ঝাঁ-চকচকে নতুন নোট গুলো কে জালনোট বলে আখ্যায়িত করেছে এবং তাদের জনগণকে সাবধান করে দিয়েছে কেউ যেন এইসব জালনোট ব্যবহার করে প্রতারিত না হয়। সরকারের এই নতুন পুরনো দন্দে মুশকিলে পড়েছে ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণ। সেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বর্তমানে এতই খারাপ যে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লোক সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক রিলিফ এর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। তারপরেও আধুনিক যুগের প্রতিটি মানুষকে কিছুনা কিছু কেনাকাটা করতে হয় এবং কেনাকাটার একমাত্র গ্রহণযোগ্য মাধ্যম হলো মুদ্রা। কিন্তু এক দেশে একই নামে দুই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দু’রকম মুদ্রার প্রবাহ পরিস্থিতিকে ক্রমেই ঘোলাটে করে তুলছে।

হুতি বিদ্রোহীরা অবশ্য এজন্যে রাশিয়াকে অভিযুক্ত করেছে। রাশিয়ার সরকারি মালিকানাধীন একটি কোম্পানি গোজনাক এডেনে অবস্থিত সরকারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য তাদের ভাষায় প্রচুর পরিমাণে জালনোট ছাপিয়েছে বিশেষ করে এক হাজার রিয়াল এর জাল নোট। জালনোট বলতে তারা বুঝিয়েছে সা‘না সরকারের আমলে প্রচলিত ব্যাংকনোট সমূহ যেগুলো নতুন করে এডেন থেকে ছাপা হয়েছে।

এডেন সরকার অবশ্য বলার চেষ্টা করছে নতুন করে তারা কিছুই ছাপায়নি। এগুলো আগে থেকেই তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে স্টক হিসেবে পড়েছিল যা এখন তারা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী বাইরে ছাড়ছে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে কারো পক্ষেই সবকিছু দীর্ঘদিন ধরে গোপন করে রাখা সম্ভব নয়। একটা না একটা সময় ভেতরের খবর বাইরে চলেই আসছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন এডেন সরকারের প্রবর্তিত নতুন ছাপা পুরনো নোট গুলো বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত উত্তর অঞ্চলে ঢুকিয়ে দিতে পারলে দু’রকম কাজ হবে। এক অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রনটা এডেনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে আর দ্বিতীয়তঃ এইভাবে হুথিদের কে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে ফেলা হবে। উত্তরে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে যথেষ্ট পরিমাণ নতুন করে ছাপানো নোট ঢুকিয়ে দিতে পারলে আস্তে আস্তে একই মুদ্রার যে দুই বিনিময় হার বর্তমানে বিদ্যমান রয়েছে সেটা কমে আসবে বলে এডেনের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক মনে করে।

তবে মুদ্রানীতি সম্পর্কে ওয়াকিফহাল বিশ্লেষকদের মতে পুরো দেশের জন্য একটি সমন্বিত মুদ্রানীতি ব্যতীত কোন স্থায়ী সমাধান আশা করা দুরাশা মাত্র। যেহেতু এডেনে অবস্থিত দক্ষিণের সরকার জাতিসংঘ দ্বারা সমর্থিত তাই আইএমএফ বা ইন্টারনেশনাল মানিটারি ফান্ড এর কাছে তাদের প্রবেশাধিকার রয়েছে। এর ফলে সরকারের দৈনন্দিন প্রয়োজন যেমন সরকারি কর্মচারী ও সেনাবাহিনীর বেতন প্রদান এবং অন্যান্য ঘাটতি মেটানোর জন্য এডেন সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক গত ছয় বছরে ৫.৩২ ট্রিলিয়ন রিয়াল নতুন নোট ছাপাতে পেরেছে। এটা হুতিদের রাজধানী সানায় অবস্থিত সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে গত ৬০ বছরে যত ব্যাংক নোট ছাপানো হয়েছে তার প্রায় তিন গুণ। বেহিসেবি ভাবে এই পরিমাণ কাগজের নোট ছাপালে যে কোন দেশের অর্থনীতিতেই মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেবে। এখানে অর্থনৈতিক মানদন্ডের চাইতে রাজনৈতিক বাস্তবতা অনেক গুরত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এর মাশুল দিতে হচ্ছে সাধারণ জনগণকে। সেখানে গত এক বছরে প্রায় ৮০% মূল্যস্ফীতি ঘটেছে যা এমনকি একটি শক্তিশালী অর্থনীতিকেও ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট।

এডেন সরকার নতুন নোট ছাপিয়ে যে সমাধান আশা করছিল তা হতে না দেখে এখন তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সৌদি আরবের দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আবু মনসুর হাদি যার সরকার সানা থেকে বিদ্রোহীদের দ্বারা ২০১৪ সালের শেষদিকে উৎখাত হবার পরে ২০১৬ সালে সৌদি সহায়তায় আবার এডেনে ফিরতে পেরেছে , তিনি কিছুদিন আগে অভিযোগ করেছেন যে হুতিরা রাজধানী সানার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে চার বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ লোপাট করেছে। জবাবে হুতিরা বলেছে জনগণের এই অর্থ জনগণের খাদ্য এবং ওষুধ আমদানি করার কাজেই ব্যবহার করা হয়েছে। আপাতত দেখা যাচ্ছে এডেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের তুলনায় সানায় অবস্থিত বিদ্রোহী সরকার মুদ্রানীতিতে ভালো সাফল্য দেখাচ্ছে । তবে অনেকে মনে করেন উত্তরের বিদ্রোহী সরকার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে মুদ্রার উচ্চতর দর ধরে রেখেছে, দক্ষিণের তুলনায় যা ৪০ শতাংশ বেশি।

আইএমএফ এবং জাতিসংঘ ২০১৮ সাল থেকে আলোচনার অংশ হিসেবে চেষ্টা করে যাচ্ছে যেন সবার আগে উভয় পক্ষ একটি একীভূত সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক পরিচালনার ব্যবস্থা করে। কিন্তু বিবদমান কোন পক্ষের কাছে সেই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য হয়নি। আর হবে বলেও মনে হয় না। দক্ষিণের লোকজন তাকিয়ে আছে কবে সৌদি আরব এবং আমেরিকা উত্তরের হুতিদের কে তাড়িয়ে তাদেরকে সানার তথা সারা দেশের ক্ষমতার মসনদে বসাবে আর উত্তরের বিদ্রোহী লোকজন তাকিয়ে আছে কবে দক্ষিণের প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদী আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির মতো দেশ ছেড়ে পালাবে। এই উভয় পক্ষের যুদ্ধংদেহী অবস্থার মধ্যে যেটা বাস্তবে ঘটবে সেটা হল মুদ্রার দরপতন অব্যাহত থাকবে এবং অচিরেই তা এক ডলারের বিপরীতে ২০০০ রিয়াল ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হবার কিছুই থাকবে না।

akhlaq.uk@gmail.com

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close