প্রান্তিক মানুষজন ও সৈয়দ আব্দুল হান্নান

|| আহমদ ময়েজ ||

কমরেডরা চলে যাচ্ছেন, একে একে দেশ আজ রাজনীতিশূন্য হয়ে পড়ছে। রাষ্ট্র চালাচ্ছে মাফিয়ারা। কী কারণে এই সামান্য কথাগুলো? কারণ অনেক, কিন্তু আপাতত একজনকে নিয়ে অনেকের কথা বলবো। সেই একজন জননেতা সৈয়দ আব্দুল হান্নান। এর পূর্বে তাঁর আদর্শের রাজনীতির মর্মভেদ কিছুটা বুঝার চেষ্টা করবো।
ধর্ম, কর্ম, সমাজতন্ত্রের প্রবর্তক প্রফেসর মোজাফফর আহমদ। তাঁর অনুসারীরা সারা বাংলা চষে বেড়িয়েছেন এ বক্তব্য নিয়ে। কিন্তু উপরতলার রাজনীতি ও ধর্মবাদীরা ছিলো এসবের ঘোর বিরোধী। কী কারণে ঘোর বিরোধী? এক পক্ষ শুধু বস্তুবাদী রাষ্ট্র চায় অন্য পক্ষ কেবল ধর্মবাদী রাষ্ট্র চায়। মধ্যখানে আরো কিছু পক্ষ রয়েছে যারা কেবলই পুজিবাদী দাসত্বে আত্মতৃপ্ত। কেউ কি কখনো সাধারণের মনের কথা পাঠ করার চেষ্টা করেছেন?
বয়োজ্যেষ্ঠরা চলে যাচ্ছেন। দক্ষিণ সুনামগঞ্জ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রবীণ রাজনীতিবিদ সৈয়দ আব্দুল হান্নানও চলে গেছেন। যে সময় তিনি ও তার সমবয়সী প্রাজ্ঞজন পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন সে সময়টা আমাদের জন্য ঘোর অন্ধকার কাল। প্রাজ্ঞজনের ভুলের কারণে নাকি বাঙালি জাতির নিয়তি, সেটা বিশ্লেষণের দাবী রাখে। বিগত পঞ্চাশ বছরের রাজনীতিতে খুব বেশী দিন আমরা স্থিতিশীল পর্ব দেখতে পাইনি। যারা বিভিন্ন সময়কে স্থিতিশীল সময় বলে ব্যাখ্যা করতে চান তারা কোনো অর্থেই বহুমাত্রিক রাজনীতির ধারক নন। তারা দলকেন্দ্রীক ভাবনায় সব সময় আবর্তিত। এর জন্য এ শ্রেণীর রাজনৈতিক ভাবনাটা একরৈখিক।

ন্যাপনেতা সৈয়দ আব্দুল হান্নান আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্কে আমাদের প্রিয় হান্নান ভাইসাব। ৯০ দশকের শেষের দিকে তাঁর গ্রামকেন্দ্রীক কিছু কর্মসূচীর সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলাম। ভাটি অঞ্চলের একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সহজ ও অনেক উপকারী ছিলো সে কর্মসূচী। ঘরের আঙ্গিনায় কয়েকটা পেপের চারা, পাঁচ ছয়টা হাসের বাচ্চা তাদের হাতে তুলে দিয়ে তিনি যে ব্যাখ্যা করতেন তাতে আমি অবাক হয়ে যেতাম। বারো মাস খদ্দরের কাপড় পরিধান করতেন। এমন নয় যে, দামী পোশাক পরিধানের যোগ্যতা তার ছিলো না। বিষয়টি খুব গুরুতর রহস্য নয়। একেবারেই সরল জীবনের প্রতিচ্ছবি তিনি ধরে রাখতেন। যে প্রতিচ্ছবি দ্বারা সাধারণের একজন বলে তাকে সহজে চিহ্নিত করা যেতো। আবার রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আমি যেন তোমাদেরই লোক’—এমনটিই যেন তাঁর অন্তরলোক আলোকিত করে রাখতো । তিনি কেন্দ্রীয় নেতা হলেও ব্যাক্তি জীবনে ছিলেন মাঠকর্মী।

ভাটি অঞ্চলে যাত্রাকালে প্রথমে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, এই কটা পেপের চারা আর হাসের বাচ্চা দিয়ে গরীব লোকের কী উপকারে আসবে। তিনি তাঁর চিরচেনা হাসি দিয়ে বললেন, এসব চারাগাছের খুব বেশী যত্ন লাগে না। এসব গাছ দ্রুত বেড়ে ওঠে এবং ফসল দিতে শুরু করে। একটি পেপে গাছ সপ্তাহে কম পক্ষে দুই কেজি পেপে ফল খাবার যোগ্য করে তুলে। পাঁচটা গাছ থেকে সপ্তাহে উৎপাদন পাওয়া যাবে ১০ কেজি পেপে। ঐসময় দশ কেজি পেপের বাজার মূল্য ছিলো ১০০ টাকা। সৈয়দ আব্দুল হান্নান একটু দম নিয়ে বললেন, এবার আসা যাক ৫টা হাসের বাচ্চা ভবিষ্যতে কী দেবে। এরা যদি বাঁচে তাহলে প্রতিদিন ৫টা ডিম পাওয়া যাবে। ডিমে রয়েছে প্রচুরপরিমান প্রুটিন। প্রতি সপ্তাহে নগদ কিছু টাকা ও নিজস্ব প্রুটিন খাবার সামান্য দেখভাল করলে এরা তা অর্জন করতে পারবে। যদি সাহায্যের জন্য দানখয়রাতের মতো কেবল অর্থ সাহায্য দেই তাতে মানুষ অলস হয়ে যাবে। বরং কর্মের মধ্যেমে তাদের সচেতন করে তুললে গরীব মানুষদের অন্যের মুখাপেক্ষি হতে হবে না।
সৈয়দ আব্দুল হান্নানের সাধারণ ভাবনাটা আমার কাছে এক অসাধার কর্মপন্থা বলে মনে হলো। আমি বললাম, এটা কি আপনার ন্যাপের রাজনীতি?
তিনি হেসে বললেন, তুমি কি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছ?
আমি বল্লাম, না ভাইসাব আমি কেবল জানতে চাচ্ছি। কারণ, রাজনীতিতে মাঠগরমের ভাষণ, নির্বাচন এসব ছাড়া অন্য কিছু আমাদের চোখে পড়ে না।
জগন্নাথপুরের ইকরসই গ্রামের সড়ক-পথ ধরে আমরা হাঁটছিলাম। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরবো। কিন্তু সৈয়দ আব্দুল হান্নান সাহেবের পথে অনেক লোকের সাথে কথা বলতে হচ্ছে। একটু পরপর দাঁড়িয়ে পড়ছেন। অবশ্য এ অঞ্চল আমারও পূর্ব পুরুষদের চষে বেড়ানো অঞ্চল। তিনিও মাঝেমধ্যে আমাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, তালইয়ের মাধ্যমে (আমার আব্বা সম্পর্কে হান্নান ভাইয়ের তালই হন) এ অঞ্চলের অনেক মানুষের পরিচয় হয়েছে। তোমরা তো এ পথ ভুলে গেছো, গেলে বুঝতে পারতে এদের সঙ্গে কেমন সংখ্যতার রাখি-বন্ধন ছিলো।
ফাঁক পেয়ে আমি পুরানো বিষয়ে ফিরে আসি। বলুন আপনা রাজনীতির কথা।
তিনি বললেন, আমি কাউকে আমার দল করার কথা বলি না। আমার কর্মসূচীর সঙ্গে কেবল তাদের সম্পৃক্ত করি। সে আমার দল করুক বা না করুক তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। কাজটা কল্যাণকর হলে উপকার সকলের হবে।
আমার মনে হলো ভাষানীর রাজনীতির কথা। এরা তো সেই আধারের মানুষ। মূলতঃ রুশ-চীন দ্বন্দ্বে তাদেরকে বিভাজিত করেছে।
সব কিছুর উর্ধ্বে সৈয়দ আব্দুল হান্নান তাত্ত্বিকদের বিভাজন নিয়ে ভাবতেন না, ভাবতেন জনগণের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে। এসব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় সকলের যৌথ প্রয়াস। যদি আমরা এটাকে রাজনীতি বলি তাহলে বলতে হয় এটাই ছিলো তাঁরা রাজনীতি। সৈয়দ আব্দুল হান্নানের বর্ণাঢ্য জীবনের ছোট্ট একটি উদাহরণ তুলে ধরলাম মাত্র। গোষ্ঠীর রাজনীতির সঙ্গে এর ছিটাফোটাও সম্পর্ক নেই। তিনি চাইলে বিদেশী এনজিও দ্বারাও এসব গরীব মানুষের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করতে পারতেন। একদিন এসব বিষয়ে উল্লেখ করেন যে, এনজিওরা মিলিওন মিলিওন ডলার হাতিয়ে কতো ভাগ গরীবদের জন্য ব্যয় করে? যার সারকথা হচ্ছে, এনজিওদের কাছে উন্নয়নশীল দেশের গরীবীও এক ধরণের ব্যবসা। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে এমন ব্যবসায় তাঁর অনিহা ছিল। সৈয়দ আব্দুল হান্নান সাহেবের রাজনীতি ভাবনায় এনজিও প্রজেক্ট এর খোলনলচে অনেক পরিস্কার ছিলো বলে এই লোভের পথে তিনি হাঁটেননি। নিজস্ব কর্মকৌশল ছাড়া বিদেশী অর্থ ও তাদের কর্মকৌশল আমাদের আমূল পরিবর্তন আনতে পারবে না, ভাবনাই ছিলো তাঁর মৌলিক রাজনীতি। ধর্মের বিষয়য়ে তিনি স্পষ্ট কথা বলতেন। একদিন উল্লেখ করেন, হাইয়া আলাসসালাহ অর্থ কি? বললাম, নামাজের দিকে আহবান করা হচ্ছে, অর্থাৎ নামাজের দিকে এসো। পরক্ষণে বললেন, হাইয়া আলাল ফালাহ অর্থ বুঝো?
বললাম, বুঝি।
তিনি নিজেই আবার বললেন, আজানের এই মর্মকথা হচ্ছে, কল্যাণের পথে এসো। এই কল্যাণই হলো আমার সমাজতন্ত্র। তাঁর এ ব্যাখ্যায় তাত্ত্বিকরা এক মত হবেন না জানি, কিন্তু কোনো কিছুকে কল্যাণকর অর্থে ভাবার মধ্যে আমি অন্যায় কিছু খুঁজে পাইনি।
আজ মনে হলো, এতো বছর পরও আমাদের কেন কোনো পরিবর্তন নেই। সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে প্রাতিষ্ঠানিক বা শাসকগোষ্ঠীর রাজনীতি কোনো মোহ এনে দিতে পারেনি। তিনি মোহমুক্ত মানুষ ছিলেন বলেই গদিওয়ালা রাজনীতি তাকে টানেনি। এটাই ছিলো তাঁর ব্যাক্তিত্ব। এই শক্তিই তাকে সারা জীবন একা করে রেখেছিলো। রাষ্ট্রভাবনায় তিনি আপোষহীন ছিলেন। অনেক খেদ ও ক্রোধে বলতেন, ‘কতো ধরণের বাম রয়েছেরে ভাই। ইণ্ডিয়ান বাম (মলম অর্থে), বামহাতের বাম। রাজনীতিবিদরা দল ত্যাগ করে, আমরা তো মল ত্যাগ করি। এসব বলতেন, সমকালিন দল পাল্টানো রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে। কিন্তু দল ত্যাগ করার কর্মটি তাঁর জীবনে ঘটেনি। বর্তমান রাষ্ট্র যন্ত্রের বেহাল জায়গা থেকে তাঁর দীর্ঘশ্বাস ছিলো। কীভাবে মাফিয়া চক্র একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে গিলে খাচ্ছে। মানুষমূল্য একেবারে তুচ্ছ হয়ে ওঠেছে, এসব ছিলো সৈয়দ আব্দুল হান্নানের কষ্টের কারণ।
দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় তিনি ঘরবৈটি ছিলেন। গত ৩১ আগস্ট এই প্রাণপুরুষ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। পাকিস্তান আমলে ঢাকার আদমজী শ্রমিক আন্দোলনের মাধ্যমে যার রাজনীতি শুরু কবরস্ত হবার আগ পর্যন্ত তিনি সেই মেহনতী জনতার ভাবনায় নিয়োজিত ছিলেন। তাঁর সবচে বড় অবদান তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তাঁর প্রভাবেই এই পরিবারের প্রজন্মরা আজ পযর্ন্ত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে কাজ করছে। বড় বেদনার কথা— তাঁর এতো বড় অবদান থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুর পর তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়নি। এ ব্যর্থা কার? রাষ্ট্রের এই লজ্জা আমরা রাখবো কোথায়?
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিয়োমিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। নামাজ এবং মানুষ ভাবনার সমান্তরাল চিন্তা এক শিক্ষনীয় বিষয়ও বটে। আল্লাহ আমাদের প্রাজ্ঞজন সৈয়দ আবদুল হান্নান ভাইকে জান্নাতবাসী করুন। তাঁর সন্তানদের ও সকল আত্মীয় স্বজনকে ধৈর্য ধারণ করার তৌফিক দান করুন।