নিউজ

পরীমনিদের না বাঁচালে দেশি শিল্প সংস্কৃতি টিকবে না

পলাশ রহমান, ভেনিস, ইটালী থেকে।


বাংলাদেশের করোনাবস্থা ভালো না। সারা দেশে ব্যাপক সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিদিন যতো মানুষের মৃত্যু এবং সংক্রমণের খবর বলা হচ্ছে ধারণা করা হয় বাস্তবে তা অনেক বেশি। কারণ কম পরীক্ষা, কম সংক্রমণ থিওরির বাইরেও প্রতিদিন অনেক মানুষের মৃত্যু খবর পাওয়া যাচ্ছে করোনার উপসর্গে। এসব নিয়ে পত্র-পত্রিকায় খবরও ছাপা হচ্ছে মাঝেমধ্যে। করোনার টিকা সংগ্রহের ক্ষেত্রেও সরকার ব্যপক পিছিয়ে পড়েছে। চরম রকমের অসচ্ছতা, অনিশ্চয়তা এবং সমন্বয়হীনতার খবর পাওয়া যাচ্ছে নিত্যদিন। এর মানে হলো সরকারের করোনানীতি বা ভ্যাকসিননীতি কাজ করেনি। সরকারের ব্যর্থতা এবং গাফিলতি দেখে মনে হয়েছে, সরকার হয়তো বিশ্বাসই করেনি দেশে করোনার মহামারি হতে পারে।করোনা সংক্রমণের মধ্যে মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে নাজিল হয়েছে ডেঙ্গু। চালের দাম বেড়েছে। কাঁচা মরিচ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হচ্ছে। মানুষের ঘরে পর্যাপ্ত খাবার নেই। দারিদ্র বেড়েছে ৩০ শতাংশ।

এত এত সংকটের মধ্যেও আলোচনা সমালোচনার প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছেন একজন পরীমনি।তিনি বাংলাদেশের একজন চলচিত্রশিল্পী। সিনেমায় অভিনয় করেন। সম্প্রতি সময়ে ঢাকার একটি ক্লাবে তিনি নির্যাতনের শিকার হন। ওই নির্যাতনের সত্যতা জানার আগে বা বিচারের আগেই পরীমনির উপর গজব নেমে এসেছে। তিনি মাদক, পর্নোগ্রাফিসহ বিভিন্ন অভিযোগে ফেঁসে গেছেন। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে এখন হাজতে আছেন।পরীমনি বড় কোনো সন্ত্রাসী নন। ভয়ানক কোনো গ্যাং ডিলার নন। একজন অভিনেত্রী এবং বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত একজন মানুষ। তাকে ধরতে বা তার ঘর তল্লাশি করতে পুলিশ বাহিনী যে শক্তি ব্যয় করেছে তা নজিরবিহীন। পুলিশের অতিরঞ্জিত মহড়া জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। আসলেই কী পরীমনির বিরুদ্ধের অভিযোগগুলোর জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে? নাকী অন্য কারো, অন্য কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য পরীকে বলির পাঠা বানানো হচ্ছে?

পরীমনির বিরুদ্ধের অভিযোগগুলো এখনো প্রমাণিত নয়। বিচার কাজও শুরু হয়নি। এখনি কেনো দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো পরীমনিকে নিয়ে টাল-মাটাল আচারণ করছে? কেনো সাংবাদিকতার নিয়ম-নীতি ছেড়ে যাচ্ছে-তাই লিখছে? কেনো সংবাদ মাধ্যমকে ‘বিচার মাধ্যম’ বানানো হচ্ছে? কেনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভাষায় সংবাদ মাধ্যম কথা বলছে? দেশের সিনিয়র সাংবাদিকরা কেনো এসব দিকে নজর দিচ্ছেন না?অভিযোগ প্রমাণের আগেই কেনো শিল্পী সমিতি পরীমনিকে অব্যাহতি দিলো? তাদের এত তাড়াহুড়ো কিসের? এখন যদি প্রমাণ হয় পরীমনির ঘরে পাওয়া শিশি বোতলে গঙ্গার জল ছিল। তার বিরুদ্ধের অন্যান্য অভিযোগগুলো সত্য নয়, তখন কী করবে শিল্প সমিতি? নাকখত দেবে?অল্প দিন আগে আমরা দেখেছি ঢাকার একজন সরকার দলীয় নেতার ছেলে ব্যাপক অস্ত্রপাতিসহ RAB এর হাতে ধরা পড়েছিলেন।

পত্রিকায় সেসব ছবি ছাপাও হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তদন্ত করে ওসবের সত্যতা পায়নি। ওগুলো নাকী খেলনাপাতি ছিল।সম্প্রতি একজন ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে তিনি একজন মেয়েকে রক্ষিতা রেখেছিলেন এবং তাকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেন। পুলিশ তদন্ত করে এই অভিযোগেরও সত্যতা পায়নি। ওই ব্যাবসায়ীকে মামলা থেকে খালাস দেয়া হয়েছে। পরীমনির ক্ষেত্রেও যে এমন কিছু ঘটবে না তার নিশ্চয়তা কী?বাংলাদেশের শিল্পী সমিতির নীতিমালা কী? একজন শিল্পী বিনির্মান করতে, শিল্পের আদর্শে, নৈতিকতায় ধরে রাখতে শিল্পী সমিতির দায় কী? আদৌ কোনো দায় আছে? নাকী শুধুই দলাদলি?একজন শিল্পীর আচারণবিধি কী? কী কী আচারণবিধি মানলে একজন মানুষ শিল্পী হিসাবে স্বীকৃতি পায়? শিল্পী সমিতিতে জায়গা পায়? বাংলাদেশে আদৌ কী শিল্পীদের জন্য কোনো আচারণবিধি আছে? না থাকলে সেটা আগে করা দরকার।যেসব অভিযোগে পরীমনি অভিযুক্ত হয়েছেন এগুলো আগে থেকে শিল্পী সমিতির অজানা থাকার কথা নয়। সবাই সব জানেন। এতদিন যা ঘটেছে তা আপনাদের চোখের সামনেই ঘটেছে। এতদিন আপনারা কোথায় ছিলেন? পরীমনিকে ফেরাতে, শিল্পের সাথে ধরে রাখতে কী করেছেন আপনারা? কিছুই করেননি। বরং পরীদের শিল্পী হয়ে ওঠার আগেই আপনারা ‘তারকা’ বানিয়েছেন। বাণিজ্যিক পণ্য বানিয়েছেন, বাজারি শিল্পী বানিয়েছেন। সত্যিকারের শিল্পী হওয়ার সুযোগ দেননি। আপনারাই গোড়ার গলদ জিইয়ে রেখেছেন। আপনাদের কারণেই পরীরা বিপথে যায়, সত্যিকারের শিল্পী হয়ে উঠতে পারে না।সরকারী-বেসরকারী কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া, সহযোগীতা ছাড়া পরীরা অনেক ত্যাগ করে, কষ্ট করে শিল্পী হয়ে ওঠে। তাদের প্রতিও দেশের, সরকারের, শিল্পী সমিতির অনেক দায়িত্ব আছে, কর্তব্য আছে। সেগুলো না মেনে শুধু রিমান্ডে নিলে সমাধান হবে না। দেশের শিল্প সংস্কৃতি বাঁচাতে হলে দায়িত্ব নিতে হবে। শিল্পীদের প্রতি কর্তব্য পালন করতে হবে। শুধু পরীমনিদের উপর দোষ চাপিয়ে পার পাওয়া যাবে না।বর্তমান সময়ের অধিকাংশ নাটক সিনেমায় কোনো গল্প থাকে না। সাহিত্য থাকে না। শিল্পের রস, অভিনয়ের রস থাকে না। আদিম রসে জবজবে কিছু একটা বানালেই যে নাটক সিনেমা হয় না এ কথা কে বলবে? কাকে বলবে? শুদ্ধ কথা শোনার মানুষ কই?সিনেমা নামের আবর্জনায় পরীমনিদের বাণিজ্যিক ব্যবহার করে যারা শিল্পের বাইরে অন্য সুখ, অন্য মজা বা অন্য লাভ খোঁজে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরীমনিদের বলি দেয়া যাবে, নির্মান করা যাবে না। দেশি শিল্প সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখা যাবে না। বিদেশ নির্ভর হয়ে পড়বে।সরকার হয়তো ভাবছে পরীমনির আড়ালে অনেক ব্যর্থতা ঢাকা পড়ে গেছে, যাচ্ছে। আসলে এ ভাবে ব্যর্থতা ঢেকে রাখা যায় না। সাময়িক স্বস্তি অনুভব করা যেতে পারে, কিন্তু এর দীর্ঘ মেয়াদী কুফল হয় অনেক বেশি, অনেক নিস্ঠুর।  

পলাশ রহমান- সাংবাদিক, বিশ্লেষক। ভেনিস-ইটালী। palashrahman@libero.it



Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close