এ লেভেল শীর্ষ গ্রেডের উচ্চতর রেকর্ড: ফলাফ বৈষম্যে উদ্বেগ প্রকাশ
প্রাইভেট বনাম স্টেইট স্কুল এবং বর্ণ, লিঙ্গ ও অঞ্চলভেদে ফলাফলে বৈষম্য
শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থান পেয়েছে বিপুল ব্রিটিশ-বাঙালী শিক্ষার্থী
গ্রেড সিস্টেমে পরিবর্তনের চিন্তাভাবনা
উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা
নিউহ্যামের ব্রাম্পটন ম্যানর একাডেমীর রেকর্ড: ৫৫ শিক্ষার্থী অক্সব্রিজে
।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ১৩ জুলাই : এবারের এ লেভেল ফলাফলে সর্বোচ্চ সংখ্যক শীর্ষ গ্রেড পেয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে বৃটেনের শিক্ষার্থীরা। ১০ আগস্ট, মঙ্গলবার প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে যে, প্রায় ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এ স্টার গ্রেড পেয়েছে। সন্তানদের অসাধারণ ফলাফল এবং একই সাথে বেশীরভাগেরই তাদের স্বপ্নের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে পারায় কৃতী শিক্ষার্থী এবং তাদের গর্বিত মা-বাবার মাঝে অফুরন্ত আনন্দের স্ফূরণ লক্ষ্য করা গেছে। এসব গর্বিতদের মধ্যে বিপুলসংখ্য ব্রিটিশ-বাংলাদেশী শিক্ষার্থীও রয়েছেন। এ লেভেলের অভাবনীয় ফলাফলে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ব্যাপক প্রকাশ ঘটেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। অনেক কৃতী শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের তৃপ্তি ও আবেগ আপ্লুত স্ট্যাটাস সমাদৃত হয়েছে ব্যাপকভাবে।
এদিকে, ফলাফলে প্রাইভেট এবং স্টেইট স্কুলের মধ্যকার ব্যাপক ব্যবধান অনেকক্ষেত্রে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বর্ণ, লিঙ্গ এবং স্থান ভেদে ফলাফল বৈষম্যের বিষয়টিও আলোচিত হচ্ছে বিজ্ঞমহলে। প্রশ্ন উঠেছে বর্তমান গ্রেড সিস্টেম নিয়ে এবং প্রচলিত আলফাবেটিক গ্রেড সিস্টেম পরিবর্তন করে পুরনো নিউমারেসি ফর্মুলায় ফিরি যাওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকারের এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট।
প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে এবারের শিক্ষকদের দ্বারা মূল্যায়নকৃত গ্রেডে ধরা পড়েছে ব্যাপক অসমতা। দেখা গেছে যে, স্টেইট স্কুলের তুলনায় প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষার্থীরা সুবিধা পেয়েছে বেশী। প্রাইভেট স্কুলগুলো ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে শীর্ষ গ্রেড প্রদান করেছে। বিপরীতে স্টেইট স্কুলগুলো মাত্র ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থী এ স্টার বা এ গ্রেড পেয়েছে। এছাড়া এই মর্ডন যুগেও বর্ণ, লিঙ্গ এবং স্থান ভেদে ফলাফল তারতম্যের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কৃষ্ণাঙ্গ ও পুরুষ শিক্ষার্থীরা তুলনামুলক কম শীর্ষ গ্রেড অর্জনে সক্ষম হয়েছে। লক্ষণীয় যে, লিঙ্গের ব্যবধান ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। যেখানে মেয়েদের এ স্টার এর ৪৬.৪% এর বিপরীতে ছেলেদের ৪১.৭%। যা ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে দেখা প্রবণতার বিপরীত, যখন ছেলেরা মেয়েদের চেয়ে ভাল ফলাফল করছিলো। এছাড়া ল-নের সাথে বাইরের অঞ্চলের ফলাফলেও অসমতা লক্ষ্যণীয়। ল-নের স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা যেখান ৪৭.৯% এ স্টার ও এ গ্রেড লাভ করেছে সেখানে ইংল্যাণ্ডের উত্তর পূর্ব অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের ৩৯,২% এ স্টার ও এ গ্রেড লাভে সমর্থ হয়েছে। তবে সরকারের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণক সংস্থা অফক্যুয়াল প্রধান বলেছেন, শিক্ষকদের দ্বারা মূল্যায়নের ফলে শিক্ষার্থীরা কী অর্জন করতে পারে সেটির সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে।
উল্লেখ্য, মহামারি করোনা কারণে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে শিক্ষকদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের এবারের এ লেভেলের ফলাফল নির্ধারণ করা হয়।
প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী ইংল্যাণ্ড, ওয়েলস এবং নর্দার্ন আয়ারল্যাণ্ডের এ লেভেল পরীক্ষায় ৪৪.৮% শিক্ষার্থী এ স্টার বা এ গ্রেড পেয়েছে। ২০২০ সালে তা ছিলো ৩৮% এবং ২০১৯ সালে ২৫%।
মহামারির করণে প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করে নতুন প্রতিস্থাপিত নিয়মে গত বছরের তুলনায় আরও বেশী ফলাফল হয়েছে। গত বছর ৩৮.৫% শীর্ষ গ্রেড অর্জন করেছিল।
ইতোমধ্যে অবশ্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ইঙ্গিত দিয়েছে দিয়েছিলো যে, এবার এ লেভেল ফলাফলে শীর্ষ গ্রেডের ছড়াছড়ি হতে যাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি টিমের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে গত ৭ আগস্ট গার্ডিয়ান একটি প্রতিবেদন ছাপে। এতেও উঠে এসেছিলো যে এবার অন্ত ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী দুটি বিষয়ে শীর্ষ গ্রেড পেতে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সেটারই প্রতিফলন লক্ষ্য করা গেলো মঙ্গলবার প্রকাশিত এ লেভেলের ফলাফলে।
২০১৯ সালে শিক্ষার্থীরা সর্বশেষ অফক্যুয়ালের অধীনে নির্ধারিত সেন্টারে বসে এ লেভেল পরীক্ষা দিয়েছে। সে সময় দুটি বিষয়ে এ স্টার অথবা এ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ২৫ শতাংশ। ২০২০ করোনা মহামারীর কারণে গত দুটি পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের কোর্স ওয়ার্কের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয়েছে। আর নম্বর দিয়েছেন নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। ২০২০ সালে শীর্ষ গ্রেড প্রাপ্তির সংখ্যা বেড়ে ৩৮ শতাংশ হয়। আর এবার সেটি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশে। সমালোচনা উঠেছে নিজ নিজ শিক্ষকরা কোর্স ওয়ার্কের ভিত্তিতে নম্বর দেয়ার কারণে শীর্ষ গ্রেড প্রাপ্তির এমন প্রসার ঘটেছে। তবে, ন্যাশনাল এসোসিয়েশন অব হেড টিচার্সের সাধারণ সম্পাদক পল হোয়াইটম্যান দাবী করেছেন, প্রকৃত কাজের মূল্যায়নের ওপর শিক্ষার্থীদের গ্রেড বন্টন করা হয়েছে। এখানে গুণগত মানের কোনো ব্যতয় ঘটেনি। প্রতিটি গ্রেড প্রাপ্তির পেছনে শিক্ষার্থীদের মেধার প্রমাণ রয়েছে। ফলে শিক্ষকরা নিজ শিক্ষার্থীদের গ্রেড দেয়ার ক্ষেত্রে উদারতা দেখিয়েছেন এ কথা সত্য নয়।
ইউনির্ভাসিটি অব পোর্টসমাউথের প্রফেসর গ্রাহাম গলব্রেইথ বলেন, কীভাবে গ্রেড বন্টন হয়েছে সেই বিতর্কের সময় এখন নয়। সরকারী সিদ্ধান্ত মেনে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়েছে। এখন এসব শিক্ষার্থী নিজ নিজ পছন্দমত প্রতিষ্ঠানে তাদের উচ্চতর পড়াশোনা করতে পারবেন কি-না সে বিষয়ে নজর দেয়া উচিত।দ্যা প্রেস এসোসিয়েশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের ৩১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭ হাজার ৬০০ টি বিষয়ে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। গবেষণার জন্য প্রসিদ্ধ রাসেল গ্রুপের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স আছে ৩ হাজার। এবার ৬ লাখ ৮২ হাজার শিক্ষার্থী ইউকাসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেছে। যা গত বছরের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশী।
‘গ্রেড স্ফীতি’:
এবার ‘গ্রেড স্ফীতি’ বা অধিকসংখ্যক শীর্ষ গ্রেড প্রাপ্তির বিষয়টি বেশ আলোচিত হচ্ছে। দেখা গেছে যে, প্রচলিত পরীক্ষা নীতি পরিবর্তন হওয়ার পর এ-লেভেলে টপ গ্রেড প্রাপ্তি বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মহামারি শুরু হওয়ার আগে শেষবারের মতো ২০১৯ সালের প্রচলিত পরীক্ষা হওয়ার পর থেকে এ স্টার এবং ও গ্রেড পাওয়ার অনুপাত প্রায় ৭৫% বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করার জন্য এতো বেশী শীর্ষ গ্রেড সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি এবং কোর্সের স্থানগুলির উপর চাপ সৃষ্টি করবে। মঙ্গলবার সকালে, ভর্তি সেবা উকাস বলেছে যে রেকর্ডসংখ্যক ৩৯৬,০০০ শিক্ষার্থীর প্রথম পছন্দের কোর্স নিশ্চিত হয়েছে, যা গত বছরের তুলনায় ৮% বেশী।
পরীক্ষা পর্যবেক্ষক সংস্থা অফক্যুয়ালের অন্তরবর্তীকালীন চেয়ারম্যান সাইমন লেবুস বলেছেন, আমরা সবসময় বলেছি যে এই বছরের ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু তিনি শিক্ষার্থীদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে শিক্ষকদের উপর বিচার, বিশ্বাস করা যেতে পারে এবং “ন্যায্য আচরণ” এর ভিত্তি করে তাদের গ্রেড দেওয়া হয়েছে।
পরীক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, এই বছর উচ্চতর গ্রেডগুলি প্রতিফলিত করে যে পরীক্ষায় কারোরই “খারাপ দিন” ছিল না এবং শিক্ষার্থীদের ভাল করার ক্ষমতা দেখানোর “একাধিক সুযোগ” ছিল।
ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব হেড টিচার্সের নেতা পল হোয়াইটম্যান “গ্রেড ইনফ্লেশন” এর সতর্কবাণী প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, ২০২১-এর ফলাফল অন্য বছরের তুলনায় সহজে তুলনা করা যায় না। গ্রেড স্ফীতি মোকাবেলার জন্য মার্কিং সিস্টেমের পুরোপুরি পরিবর্তন করে আলফাবেটিক বা বর্ণমালার ভিত্তিক গ্রেডকে নিউমারিক্যাল বা সংখ্যাসূচক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হতে পারে, দ্য টেলিগ্রাফ জানতে পেরেছে। এডুকেশন সেক্রেটারি গেভিন উইলিয়ামসন বিবিসি রেডিও-৪ এর টুডে প্রোগ্রামে বলেছিন, তাঁর বিভাগ গ্রেডস্ফীতি মোকাবেলায় বিভিন্ন পদক্ষেপের দিকে নজর দেবে।