নিউজ

পাবলিক মানি অপচয়ে কাঠগড়ায় কাউন্সিল: আপসানা এমপি নির্দোষ প্রমাণিত

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ৪ আগস্ট : ‘অসৎ’ উদ্দেশ্যে করা জালিয়াতি মামলায় জুরিবার্ডের রায়ে অবশেষে নির্দোষই প্রমাণিত হয়েছেন পপলার এ- লাইমহাউজ আসনের এমপি আপসানা বেগম। দীর্ঘ আঠারো মাস শুনানি শেষে গত ৩০ জুলাই, শুক্রবার স্ন‍্যায়ার্সব্রুক ক্রাউন কোর্ট আপসানা বেগমকে নির্দোষ বলে রায় ঘোষণা করে। আপসানা বেগমের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করতে গিয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বিরাট অঙ্কের অর্থ খরচ হয়েছে দাবী করেছিলো কাউন্সিল। এখন আদালতে হারের পর উভয় পক্ষের আইনী খরচ বাবদ কাউন্সিলের কতো পরিমাণ পাবলিক মানি বা জনসাধারণের করের অর্থ অপচয় করলো সেটা জানার অপেক্ষায় সবাই। আদালতের রায়ে নিষ্ক্রিতির পর আপসানা বেগমের বিরুদ্ধে মামলা করে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল কেন পাবলিক মানির অপচয় করলো — এনিয়ে ইতোমধ্যেই নানা প্রশ্ন উঠেছে এবং জবাবদিহীতা চাওয়া হয়েছে।

আপসানা এমপি নির্দোষ প্রমাণিত

দীর্ঘদিন ধরে চলা মামলায় নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার মাধ্যমে অভিযুক্ত আপসানা বেগম যেমন নিজে মানসিক কষ্ট থেকে রেহাই পেয়েছেন তেমনি বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত এই এমপির কোর্ট কর্তৃক নির্দোষ প্রমাণে স্তস্তি এসেছে বৃটেনের পুরো বাঙালি কমিউনিটিতে। আপসানা বেগম যে কতটা মনোকষ্টে ভুগছিলেন সেটির দেখা গেছে আদালতে বিভিন্ন সময়ে তাঁর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ার মাধ্যমে। শুক্রবার যখন জুরিদের মতামতের ভিত্তিতে বিচারক তাঁকে নির্দোষ ঘোষণা করে রায় দেন-তখনও তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এমপি নির্বাচিত হওয়ার আগ থেকেই টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সেবা কর্তনের কঠোর সমালোচক এবং জনগুরুত্বপূর্ণ দাবী-দাওয়াতে সোচ্চার আপসানা বেগমের বিরুদ্ধে হাউজিং বা আবাসন জালিয়াতির অভিযোগ আনে কাউন্সিল। শুরু থেকেই মামলাটি অসৎ উদ্দেশ্যে ও ষড়যন্ত্রমূলকভাবে করা হয়ে থাকতে পারে বলে জনমনে অনেক গুঞ্জন ছিলো। শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে সেটিরই প্রতিফলন হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।

এদিকে, আদলতের রায়ে আপসানা বেগম এমপি নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার পর মামলা করে পাবলিক মানি অপচয়ের জন্য টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠেছে, জবাবদিহীতা চেয়েছেন খোদ লেবারের স্থানীয় সদস্যরা। এছাড়া লেবারের ন্যাশনাল উইমেন্স কমিটির সদস্য পামেলা ফিজপ্যাট্রিক এক টুইটে বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরে তাদের প্রথম সভায় যেসব লেবার সদস্য আপসানা বেগম এমপির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করেছেন তাদের বিষয়ে পুর্ণ তদন্তের দাবী জানাবেন তিনি। পামেলার টুইটের জবাবে সালমা আহমেদ নামের একজন বলেছেন, সত্যি! ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের শিকার একজন মহিলার পিছু নিয়ে কাউন্সিল কেন পাবলিক মানি অপচয় করবে তা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। একই বিষয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের কাছে পাবলিক মানি অপচয়ের জন্য জবাবদিহীতা চেয়েছেন স্থানীয় লেবার সদস্যরা।

গত ৩ আগস্ট, মঙ্গলবার স্থানীয় সেইন্ট ম্যাথিয়াস চার্চে লেন্সবারি এণ্ড পপলার ওয়ার্ডের একটি সভায় এবিষয়ে উক্ত ব্রাঞ্চের সদস্যদের পক্ষ থেকে এক জরুরী মোশন উপস্থাপন করা হয়। প্রায় ৫০ জনের অধিক সদস্যের উপস্থিতিতে আগামী নির্বাচনের জন্য দলীয় মেয়র প্রার্থী মনোনয়নের প্রক্রিয়া নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় উত্থাপিত উক্ত জরুরী মোশনে বলা হয়, হাউজিং ফ্রড মামলায় পপলার এ- লাইমহাউজের এমপি আপসানা বেগম স্ন‍্যায়ার্সব্রুক ক্রাউন কোর্টের জুরিদের রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। আপসানা বেগম দাবী করেছেন যে, তবিদ্বেষপ্রসূত হয়ে করা এই মামলার কারণে তাঁর ব্যাপক মানসিক কষ্ট এবং মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। এসব কারণে তাঁর বিরুদ্ধে আইনী লড়াই যাওয়ার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সেসব বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ চিহ্নিত করে বলা হয় Ñ এই মামলা ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিস (সিপিএস) পরিচালনা করেনি, করেছে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। এই মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের প্রায় সিক্স ফিগারের মতো অর্থ খরচ হয়েছে। শোনানি চলাকালে কোর্টের পুলিশ রিপোর্টসহ ব্যাপক প্রমাণিত প্রদান করা হয়েছিলো তারপরও মামলায় তর্কাতীতভাবে আপসানার সাবেক স্বামী কাউন্সিলার ইহতেশামুল হকের নিয়ন্ত্রণ, জবরদস্তি ও অন্যায় আচরণ প্রমাণিত হয়েছে। এই কাউন্সিলার ইহতেশামুল হকই লোকাল হাউজিং এ- রিজেনারেশন স্ক্রুটিনি সাব কমিটির চেয়ার। আর কাউন্সিলার ইহতেশামুল হকের বোনের স্বামীই এই মামলার পেছনের মূল অভিযোগকারী ছিলেন। যা ২০১৯ সালে আপসানা বেগম পপলার এণ্ড লাইমহাউজ আসনে লেবারের এমপি প্রার্থী মনোনিত হওয়া পর অভিযোগ উপত্থাপন করে তা ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছিলো। বেশীরভার মিডিয়ার অনেকটা পক্ষপাতমূলক সংবাদ পরিবেশনে মনে হয়েছিলো আপসানা দোষী সাব্যস্ত হতে পারেন। আর এজন্য টোরি কাউন্সিলার, রাইটউইং ব্লগ এবং ট্যাবলয়েডগুলোকে অবিরত মামলার সব গোপন তথ্য সরবরাহ করা হয়েছিলো। মামলাটি চালু হওয়ার পর থেকে আপসানা বেগম অনলাইনে নারী বিদ্বেষী, বর্ণবাদী ও ইসলামফোবিক আক্রমণের শিকার হন। শুনানি চলাকালে কাউন্সিল অফিসাররা বাববার বলেছেন যে, আপসানাকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য তারা চাপে ছিলেন।

উত্থাপিত মোশনে আরো উল্লেখ করা হয় যে, আপসানা নির্বাচিত হওয়ার আগে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল কর্তৃক নার্সারি, কমিউনিটি ল্যাংগুয়েজ সার্ভিস এবং ইয়ূথ সার্ভিসসমূহের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। কাউন্সিলের কঠোরতা এবং বাজেট কর্তন বাস্তবায়নসহ লাইব্রেরী, ‘সে-’, এবং ডে-কেয়ার সেন্টারগুলোর বন্ধের বিরুদ্ধে আপসানা সবসময় প্রতিবাদী ভূমিকা রেখেছিলেন।
মামলাটি বাংলাদেশী অধ্যুষিত পূর্ব ল-নের টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকায় অপরাজনীতির আরও একটি নজির স্থাপন করলো। কেননা স্থানীয় জনসাধারণের কাছে বিপুলভাবে জনপ্রিয় আপসানা বেগমের এগিয়ে যাওয়ার পথে নানাভাবে বারবার বাধার সৃষ্টি করছে তাঁরই দলের কিছু কাউন্সিলার ও রাজনীতিকরা। তারই ধারাবাহিক আক্রমণ হিসেবে আফসানা বেগম ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে এমপি প্রার্থী হিসেবে লেবার দলের মনোনয়ন পাওয়ার পর পরই নাটকীয়ভাবে অভিযোগটি তোলা হয়। সেই মনোনয়ন প্রক্রিয়াও টাওয়ার হ্যামলেটসের বেশকিছু কাউন্সিলার ও স্থানীয় শীর্ষ লেবার রাজনীতিকরা বিরোধীতা করা সত্ত্বেও দলের সাধারণ সদস্যদের ব্যাপক সমর্থনে মনোনয় লাভে সমর্থ হন এবং নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে বিজয়ী হন আপসানা। তারপরও তাঁর পিছু ছাড়েনি ষড়যন্ত্র।

উল্লেখ্য, পূর্ব ল-নের টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকার পপলার এ- লাইমহাউজ আসনের লেবার দলীয় এমপি আফসানা বেগম দলটির সাবেক নেতা জেরেমি করবিনের সমর্থক বলে পরিচিত। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তিনি প্রথমবারের মতো এই আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ৩১ বছর বয়সী উদীয়মান রাজনীতিক আফসানা বেগম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। মামলার শুনানি শেষ দিকে কোর্টে সাক্ষী দিতে গিয়ে সাবেক শ্যাডো চ্যান্সেলরও আপসানার প্রশংসা করে তাকে খুবই ভালো মানুষ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, লেবার জয়ী হতে পারলে আপসানাকে মিনিস্ট্রেরিয়েল পোস্ট দেওয়া হতো। আদালতে আপসানা বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল যে, তিনি অসত্য তথ্য দিয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের কাছ থেকে আবাসন বরাদ্দ নিয়েছেন।

অভিযোগ অনুযায়ী ২০১১ সালের ২২ জুলাই তিনি টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের হাউজিং রেজিস্টারে তালিকাভুক্ত হন আবাসন সুবিধার জন্য। তিনি তিন বেডরুমের ওভারক্রাউডেড ঘরে পরিবারের সাথে থাকেন বলে দাবী করেছিলেন। যেখানে তাঁর নিজস্ব কোনো রুম ছিলো না।
তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছিল, তা ছিল ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি হতে ২১ মে, ২০১৩ সালের ২১ মে হতে ২০১৪ সালের ২৪ মে, এবং ২০১৫ সালের ২৮ অক্টোবর হতে ২০১৬ সালের ২১ মার্চ সময়কালে নেয়া আবাসন সুবিধার জন্য।
মামলায় বলা হয়, টাওয়ার হ্যামলেটস বারায় বাবার পরিবারের সঙ্গে থাকার সময় ২০১১ সালে ফ্ল্যাটের জন্য লণ্ডন কাউন্সিলে আপসানার নামে আবেদন জমা পড়ে। পরে তিনি ২০১৩ সালে স্বামীর বাড়িতে ওঠেন। আপসানার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, স্বামীর বাড়িতে চলে যাওয়ায় তার আর ফ্ল্যাটের দরকার ছিল না। কিন্তু সে কথা তিনি কাউন্সিলকে অবহিত করেননি।
তাছাড়া আপসানার নামে জমা পড়া আবেদনে বলা হয়েছিল, তিন কক্ষের একটি বাসায় গাদাগাদি করে তাকে থাকতে হয়। সে অবস্থা বিবেচনা করেই তাকে ফ্ল্যাট বরাদ্দের ক্ষেত্রে প্রাধিকার তালিকায় রাখা হয়। অথচ ২০০৯ সালে তার খালার করা আবেদনপত্রে দেখা যায় ওই বাড়িতে চারটি বেডরুম আছে।

আপসানা বেগম পরে তার তৎকালীন স্বামী এহতাশামুল হকের সঙ্গে ভিন্ন একটা বাড়িতে চলে যান। তবে তিনি বিষয়টি টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলকে অবহিত করেননি বলে অভিযোগ করা হয়। এই বাড়িতে তিনি দুই বছর ছিলেন। আবাসন খাতে চাকরি করা আফসানার স্বামীর সঙ্গে আলাদা বাসায় থাকার সময়েও কাউন্সিল বাড়ির জন্য বিড করেছেন। তিনি তথ্য গোপন করে হাউজিং সুবিধা নিয়েছেন অব্যহতভাবে।

আদালতের শুনানীতে কাউন্সিল দাবী করেছে, আফসানা বেগম তাঁর পারিবারিক ঘরে বেডরুম তিনটি দাবী করলেও ২০০৯ সালের তাঁর এক আত্মীয়ের করা এক আবেদনে ওই ঘরে চারটি বেডরুম আছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আপসানার বক্তব্যই আদালতে সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। আপসানা বেগম আদালতকে জানান, এই বাড়িতে বেডরুম ছিল আসলে তিনটি, এবং সেখানে থাকার সময় তার নিজের কোনো আলাদা বেডরুম ছিল না। তবে কেন তাঁর ওই আত্মীয় বাড়িটিতে চারটি বেডরুম ছিল বলে দাবী করেন, সেটির ব্যাখ্যা তিনি দেননি।
বিয়ের পর আপসানা আলাদা ঘরে গিয়েও কাউন্সিল বাড়ির জন্য বিড করেছেন যে অভিযোগ করা হয়েছে Ñ সেটি সম্পর্কে আপসানা বলেছেন, তাঁর তখনকার স্বামী এহতেশামুল হক সবকিছু ‘নিয়ন্ত্রণ’ করতে চাইতেন এবং ‘জবরদস্তি’ করতেন এবং তাঁর ব্যাংকিংও নিজের হাতে নিয়েছিলেন। তিনি ওই সময়কালে আবাসন সুবিধা চেয়ে কাউন্সিলে কোনো আবেদন করেননি বলে জানান।

তিনি আদালতকে বলেন, এসব আবেদনের রেকর্ড দেখে তিনি অবাক হয়েছেন।
আপসানা আরো বলেন, এহতেশামকে একজন নির্যাতনকারী এবং তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতেন। যে কারণে এহতেশামের সঙ্গে তাঁর সংসার ভেঙ্গে যায়।
প্রসঙ্গত, এহতেশামুল হক টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের লেবার দলীয় একজন কাউন্সিলর।
আফসানার জন্ম ও বেড়ে ওঠা টাওয়ার হ্যামলেটসে হলেও বাংলাদেশে তাদের আদি বাড়ি সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে। এক সময় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের আবাসন বিভাগে চাকরি করতেন তিনি। কুইনমেরী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতিতে লেখাপড়া করা আফসানার বাবা মনির উদ্দিন টাওয়ার হ্যামলেটসের কাউন্সিলর ছিলেন।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close