মুক্তচিন্তা

নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়: মুজিব থেকে হাসিনা, গণতন্ত্র থেকে একনায়কতন্ত্র — ইতিহাসের দুঃখজনক পুনরাবৃত্তি

।। শামসুল আলম লিটন।।

লেখক: সম্পাদক সাপ্তাহিক সুরমা
যুক্তরাজ‍্য


গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের জন্য সাক্ষাৎ জাহান্নাম তৈরি করে ফেলা হলো। একনায়কতন্ত্রের রাজনৈতিক দর্শন বাকশাল কায়েমের জন্য তৎকালীন ব্যবস্থাকে নাম দেয়া হলো “দ্বিতীয় বিপ্লব”। জাতীয় মুক্তির কথা বলে বাক স্বাধীনতা হরন স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে গণমাধ্যমের উপর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক নিপীড়ন।

সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্নীতি লুটপাট আর দূঃশাসন যখন প্রতিটি নাগরিকের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে, তখন একনায়ক স্বৈরাচার শেখ মুজিবের পক্ষে গণমাধ্যমকে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া কোন বিকল্প ছিলনা। চারটি অনুগত সংবাদপত্র রেখে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হলো। প্রতিবাদীদের জেলে পুরা হলো। আর এভাবেই দ্বিতীয় বিপ্লব ক্রমান্বয়ে কথিত ‘সাফল্যের’ দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো।

আজকের প্রেক্ষাপটে গনমাধ্যমের সেদিনের অবস্থা হয়তো কল্পনাও করা যাবে না। কিন্তু একথা নিশ্চিত ভাবে সবাই কল্পনা করতে পারেন, কিভাবে একটি জাতির স্বপ্নভঙ্গ হলো তারই প্রিয় নেতার হাত ধরে? পাকিস্তানিদের দু:শাসন ও শোষণের অবসানের ডাক দেওয়ার কারণে যে জাতি ব্যক্তি শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করলো, সেই তিনিই দলীয় ও গোষ্ঠীর দু:শাসন চাপিয়ে কিভাবে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করলেন? পরিবারের কয়েকজন সদস্য আর কিছু চাটার দল (তাঁর নিজের ভাষায়) দেশের সমস্ত সম্পদ কে ভাগবাটোয়ারা করে অবাধে লুটপাট আর সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতনের মাধ্যমে সদ্যস্বাধীন জাতি রাষ্ট্রটিকে ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করলেন।সেই নির্দয় দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কেউ যাতে কথা বলতে সাহস না পায়, সেজন্য একে একে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করলেন অথবা সকলকে বাকশালে যোগ দিতে বাধ্য করলেন। পরবর্তী ধাপে সকল পত্রিকা বন্ধ করে জাতির কন্ঠনালী চূড়ান্তভাবে টিপে ধরলেন।

এভাবেই প্যাট্রিয়ট কবিতার নায়ক এর মতো ধীরে ধীরে গণবিরোধী শক্তির প্রতীকে পরিণত হয়ে গেলেন জাতির সেই মহীরুহ। গনমাধ্যমের টুটি চেপে ধরার পর জনগণের সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ অবশিষ্ট সম্পর্কটুকুও অবলুপ্ত হয়ে গেল। দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য বহু অত্যাচারের শিকার হয়েও একজন জাতীয় নেতা কিভাবে জাতির বোঝায় পরিণত হয় ১৬ জুন তার দৃষ্টান্ত মাত্র।

সেদিনও ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বন্দনায় ব্যস্ত দুর্নীতিবাজ আর দুঃশাসনের সহযোগীরা বেশিরভাগই গণমাধ্যমের টুটি চেপে ধরার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল। আর আজ পরিস্থিতি কি তা’ থেকে খুব বেশি ব্যাতিক্রম? একটুখানি ব্যতিক্রম তো আছেই! এখন আর গণমাধ্যমকে বন্ধ করে দিতে হয় না। টুটি চেপে ধরার নানা কৌশল প্রয়োগ করলেই চলে। আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়নি। প্রেস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সাংবাদিকদেরকে কারারুদ্ধ করা হয়েছে। জেল জরিমানা করা হয়েছে । পত্রিকায় সত্য প্রকাশের সুযোগ নেই। দিগন্ত টিভি ইসলামিক টিভি, টিভি ওয়ান পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে বন্ধ করে দেয়া হলো ।আর যে গণমাধ্যম অবশিষ্ট আছে, তার জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হলো যাতে তারা সূর্যের দিকে তাকিয়েই সংবাদ প্রচার করে। যেখানে সরকারের জন্য কোনো উদ্বেগ থাকে না । সুতরাং ফলাফল হলো দু’রকম। গণমাধ্যম আছে আবার গণমাধ্যম নাই। গণমাধ্যম আছে, আবার গণমাধ্যম এর উপরে মানুষের কোনো ভরসা নাই ।

ঠিক এমনিভাবে সংবিধানে সেদিনও গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র সবই ছিল। মানুষের জীবনে তার কোনো প্রভাব ছিল না। আজও সংবিধানে মানুষের সব অধিকার আছে। শুধু ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, অফিশিয়াল সিক্রেসী এ্যাক্টসহ নানা কালাকানুন এমন ভাবে গনমাধ্যমের শ্বাসরুদ্ধ করেছে যে এই গণমাধ্যম সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা ছাড়া আর কিছুই নয়।

এই দায় রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের পরিচালনাকারী সরকারের। বিশ্বের দেশে দেশে ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলোকে অনেক চড়া মূল্যে এই দায় শোধ করতে হয়। গণমাধ্যম স্বাধীন হলে গণতন্ত্র- ব্যক্তি-রাজনীতিক সবাই নিরাপদ থাকেন। কিন্তু গনমাধ্যমের টুটি চেপে কোন ফ্যাসিবাদের ভালো পরিণতি ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না । তাই গনমাধ্যমের এই কালো দিবস বাংলাদেশের ইতিহাসের অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য এক কঠিন শিক্ষা হয়ে থাকবে। যদি ইতিহাস থেকে আমরা শিক্ষা নিতে চাই । যদিও ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হচ্ছে- ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close