হাসিনার ইসরাইল কেলেঙ্কারী
পাসপোর্টকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে এ সিদ্ধান্ত: ড. মোমেন
বাংলাদেশের দ্বিমুখী নীতি কষ্টদায়ক: ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত
‘মন্ত্রিসভা ও পার্লামেন্ট পাশকাটিয়ে গোপনীয় সিদ্ধান্তের নজির’
ইসরাইলকে খুশি করতেই এই সিদ্ধান্ত: বিভিন্ন দলের প্রতিবাদ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র অসন্তোষ
।।সুরমা প্রতিবেদন।।
লণ্ডন, ২৭ মে : কর্তৃত্ববাদী শাসনের বাংলাদেশে একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া কারও পক্ষে এমন একক সিদ্ধান্ত নেওয়া অসম্ভব বলেই পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। অন্যথায় মন্ত্রিসভা জানেনা, জানেনা সচিবালয়ের কোন দপ্তর; তাহলে পাসপোর্ট থেকে ইসরাইল বাদ দেয়ার নির্বাহী কর্তৃত্ব কে দেখাতে পারে? এই প্রশ্নের জবাব গত কয়েকদিনে সরকারের কোনো পক্ষ থেকে দেওয়া সম্ভব হয়নি । শুধু সরকার বলছে- পাসপোর্টকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার জন্যই এই সিদ্ধান্ত। যদিও এই যুক্তি ধোপে টেকে না । বাংলাদেশের পাসপোর্ট এর আগে যেমন ছিল তাই আছে এবং ভবিষ্যতেও তাই থাকবে । এধরনের শর্ত তুলে নেওয়ার সঙ্গে পাসপোর্ট-এর আন্তর্জাতিক মানের কোন সম্পর্ক নেই।
এদিকে, ইসরাইল কেলেঙ্কারি নিয়ে কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনার সরকার ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি ভয়াবহ গণহত্যায় বিক্ষুব্ধ বাংলাদেশের জনগণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না । ভারতের সঙ্গেও একইভাবে গোপনে কয়টি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে – তার কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। সংসদ ও সরকারকে পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কেলেঙ্কারি শেখ হাসিনার ইসরাইল কেলেঙ্কারি বলে পাবলিক ডোমেইনে আলোচিত হচ্ছে । সমালোচনার মুখে পড়েছে পুরো সরকার ও সংসদ। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ করলেও এখন পর্যন্ত শাসক দল আওয়ামী লীগ কোন জুতসই জবাব হাজির করতে পারেনি। হাসিনার ইসরাইল কেলেঙ্কারি নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সৃষ্টি হয়েছে আরেক দফা তোলপাড়।
এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন বাংলাদেশের এই দ্বিমুখী নীতি অপ্রত্যাশিত ও কষ্টদায়ক। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। তবে মন্ত্রীর সমালোচনা অনেকটা ব্যাখ্যামূলক বলে গণমাধ্যম বিশ্লেষকগণ মন্তব্য করছেন।
ইসরাইলের সাথে বাংলাদেশের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই, বাংলাদেশ কখনো ইসরাইলকে সমর্থন করেনি এবং বাংলাদেশের পাসপোর্টে ‘এই পাসপোর্টটি ইসরাইল বাদে পৃথিবীর সব দেশের জন্য বৈধ’ – বাক্যটি ৭২ সাল থেকেই সন্নিবেশিতও ছিলো। কিন্তু হঠাৎ বাংলাদেশের ই-পাসপোর্টে ‘ইসরাইল বাদে বিশ্বের সব দেশ ভ্রমণ করা যাবে’ বিষয়টি তুলে নিয়েছে বর্তমান সরকার। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সর্বত্র তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের সূত্রপাত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সচেতন নাগরিকরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। ইসরাইলকে খুশি করার জন্য তা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে সরকারের এমন সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
বিষয়টিতে ইসরাইল খুশি হলেও মুক্তিকামী নির্যাতিত ফিলিস্তিনীদের মর্মাহত করেছে। ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপমহাপরিচালক গিলাড কোহেনের সন্তোষ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে ইসরাইলের খুশি হওয়ার বিষয়টিই ফুটে উঠেছে। আর ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের নতুন পাসপোর্টের এই পরিবর্তনকে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেছেন।
এদিকে, বিভিন্নভাবে বিরূপ মন্তব্য ও নিন্দা প্রকাশের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসরাইল ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে এবং ইসরাইলের প্রতি বাংলাদেশের অবস্থান বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের সা¤প্রতিক হামলার নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসঙ্ঘের রেজ্যুলেশন অনুযায়ী দুই রাষ্ট্র নীতির প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন অব্যাহত রয়েছে। তবে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী এমনটি হওয়ার ফলে পাসপোর্ট আন্তর্জাতিক মানের হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন। মন্ত্রীদের এমন মন্তব্যও সমালোচিত হয়েছে।
বিভিন্ন সংগঠনের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ: বাংলাদেশের বেশকটি রাজনৈতিক সংগঠন বিষয়টির তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। ইসরাইলের পক্ষে সরকারের অন্যায় পদক্ষেপের সমালোচনা করে সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ অবিলম্বে তা সংশোধনের দাবী জানিয়েছেন।
জামায়াত :
বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরাইল বাদে’ কথাটি বাদ দেয়ার সরকারী সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারী জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার গণমাধ্যমসমূহে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে রহস্যজনকভাবে ‘ইসরাইল বাদে’ কথাটি বাদ দেয়া হয়েছে। কোন অদৃশ্য কারণে সরকার এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে তা বোধগম্য নয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তে দেশের মানুষ হতবাক হয়েছে। আমরা সরকারের এ সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক মানদ- বজায় রাখার অজুহাত দেখিয়ে হঠাৎ করে বাংলাদেশের পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরাইল বাদে’ কথাটি বাদ দিয়ে সরকার কাকে সন্তুষ্ট করতে চায় দেশের মানুষ তা জানতে চায়। অবিলম্বে এ অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশ পাসপোর্টে ‘ইসরাইল বাদে’ কথাটি সংযুক্ত করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট মহলের প্রতি আহ্বান জানান।
খেলাফত মজলিস : বাংলাদেশের নতুন পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরাইল বাদে পৃথিবীর সব দেশের জন্য বৈধ’ কথাটি থেকে ‘ইসরাইল বাদে’ শব্দ দু’টি বাদ দিয়ে অবৈধ রাষ্ট্র ইহুদিবাদী ইসরাইলের পক্ষে সরকারের অন্যায় পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে বাংলাদেশের ই-পাসপোর্টে করা পরিবর্তন সংশোধন করে আগের মতো ‘ইসরাইল বাদে পৃথিবীর সব দেশের জন্য বৈধ’ কথাটি লিপিবদ্ধ করার দাবী জানিয়েছে খেলাফত মজলিস। এক বিবৃতিতে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক বলেন, অবৈধ ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল দীর্ঘ ছয়-সাত দশক ধরে ফিলিস্তিনী মুসলমানদের ওপর অকথ্য জুলুম নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। লাখো ফিলিস্তিনী নারী-পুরুষ-শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। দেশের পাসপোর্টে ‘ইসরাইল বাদে’ কথাটি ছিল স্বাধীনতাকামী মজলুম ফিলিস্তিনী জনগণের পক্ষে এ দেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনের স্মারক। কিন্তু স¤প্রতি হঠাৎ করে সরকার কোন স্বার্থের বিনিময়ে নতুন পাসপোর্টে অবৈধ ইসরাইলকে এ ছাড় দিয়েছে জাতি তা জানতে চায়। আন্তর্জাতিকমান নিশ্চিতের জন্য পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরাইল বাদে’ কথাটি বাদ দেয়া হয়েছে বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দেয়া ব্যাখ্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ :
সংগঠনের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পাসপোর্ট থেকে ইসরাইলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়ায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এক বিবৃতিতে চরমোনাই পীর বলেন, সরকার পাসপোর্ট থেকে ইসরাইলে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে মুসলমানদের চেতনায় আঘাত করা হয়েছে। জায়নবাদী ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইলকে খুশী করতেই সরকার পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরাইল বাদে’ উঠিয়ে দিয়েছে। যা ইসরাইলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উপমহাপরিচালক গিলাড কোহেনের সন্তোষ প্রকাশ করার মধ্য দিয়ে তা ফুটে উঠেছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনী মুক্তিকামী মানুষের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের চিন্তাচেতনা, বোধ-বিশ্বাসের পরিপন্থী। এ ধরনের সিদ্ধান্ত দেশে নতুন করে সংশয় ও সন্দেহ সৃষ্টি করবে, যা কখনোই কারো কাম্য নয়।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম :
বাংলাদেশী পাসপোর্ট থেকে ‘ইসরাইল বাদে’ শব্দ দুটি এ মুহূর্তে বাদ দেয়া প্রকারান্তরে মজলুম ফিলিস্তিনীদের বিপক্ষে অবস্থান নেয়ার শামিল বলে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ। এক বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, সারা বিশ্বের মুসলিম মজলুম ফিলিস্তিনীদের পাশে আছে। বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ ফিলিস্তিনীদের পাশে আছে। এ মুহূর্তে পাসপোর্ট আন্তর্জাতিকমান করার অজুহাতে ‘ইসরাইল বাদে’ তুলে দেয়ায় বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের অন্তরে চরম আঘাত পেয়েছে।
ইসলামী ঐক্য আন্দোলন : পাসপোর্ট থেকে ইসরাইল ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ায় তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছেন ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মোস্তফা তারেকুল হাসান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই জনগণ নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ দেশের সব সরকারই ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণের পক্ষে ছিলেন। সরকারের কাছে দেশের জনগণ জানতে চায়, কোন অদৃশ্য শক্তির ইশারায় সরকার ইসরাইলের সাথে গোপন সম্পর্কের পাঁয়তারা করছে যা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন করবে।
বাংলাদেশের পাসপোর্টে পরিবর্তন অগ্রহণযোগ্য: ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রদূত
বাংলাদেশের নতুন পাসপোর্টের এই পরিবর্তনকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে উল্লেখ করেছেন ঢাকায় ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান। তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও অ্যাম্বাসেডর-অ্যাট-লার্জ মোহাম্মদ জিয়াউদ্দিনের সাথে বৈঠকের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।
ইউসুফ এস ওয়াই রামাদান বলেন, ‘আমরা পাসপোর্টের পরিবর্তন সম্পর্কে অবগত আছি। সব সার্বভৌম দেশের পাসপোর্ট বা অন্যান্য বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আছে। এগুলো মেনে নিয়েই বলছি, এ সিদ্ধান্ত আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।’
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, বাংলাদেশের পাসপোর্ট যেন ‘আন্তর্জাতিক মানের’ হয় সে জন্যই এ পরিবর্তন আনা হয়েছে।
এ প্রেক্ষিতে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আপনি কি বলছেন যে গত ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশী পাসপোর্ট আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখেনি। ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশ যারা পাসপোর্টে ইসরাইলের ওপর নিষেধাজ্ঞা উল্লেখ করছে তাদের পাসপোর্ট কি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নয়?’
এ সময় সম্প্রতি ফিলিস্তিনীদের ওপর ইসরাইলী হামলায়, ফিলিস্তিনীদের প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন ও সহায়তার প্রশংসা করেন রামাদান।