নিউজ

জনগণের প্রতি সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমানের খোলা চিঠি

মেয়র নাকি লিডারশিপ: গণভোট নিয়ে সরগরম টাওয়ার হ্যামলেটস

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ১২ মার্চ – ‘মেয়র নাকি লিডারশীপ’ — গণভোট নিয়ে সরগরম হয়েছে ওঠেছে টাওয়ার হ্যামলেটস। পূর্ব লণ্ডনের এই বারায় নির্বাহী মেয়র পদ্ধতি বহাল থাকবে নাকি আগের লিডারশিপ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে— তা নিয়ে গণভোট হবে আগামী ৬ মে। এই গণভোটকে সামনে রেখে চাঙ্গা হয়ে উঠছে টাওয়ার হ্যামলেটসের রাজনীতি। ইতিমধ্যে দুটি গ্রুপ গড়ে উঠেছে। কমিউনিটি কোয়ালিশন নামে একটি গ্রুপ মেয়রাল পদ্ধতি বহাল রাখার পক্ষে প্রচারেও নেমেছে। এ গ্রুপের নেতৃত্বে আছেন মূলত সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমান এবং তাঁর সমর্থকগোষ্ঠী। আর লিডিং টুগেদার নামে অপর পক্ষ লিডারশিপ পদ্ধতির পক্ষে প্রচার চালাচ্ছে — লেবার, কনজারভেটিভ, লিডডেম এবং গ্রিন পার্টি। এই চারটি দল মিলে গঠন করেছে এই লিডিং টুগেদার ক্যাম্পেইন। তারা বর্তমানের মেয়রাল পদ্ধতির বদলে লিডারশিপ পদ্বতি ফিরিয়ে আনতে চায়।
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আগামী ৬ মে লণ্ডন মেয়র নির্বাচনের দিনই এ গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। আর টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২২ সালে। ফলে এই গণভোটেই ঠিক হবে সেই নির্বাচনে নির্বাহী মেয়র ব্যবস্থা বলবত থাকবে নাকি লিডারশিপ ব্যবস্থা ফিরে আসবে।

এদিকে, সাবেক মেয়র লুৎফুর রহমানের উপর থেকে কোর্টের নিষেধাজ্ঞা চলে যাবার পর তিনি আবার যে রাজনীতিতে ফিরবেন তা নিয়ে গুঞ্জন ছিলো। বাস্তবিকই তিনি আবার রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন। মেয়রাল পদ্ধতিতে ফিরে যাবার পর বারার প্রথম এবং বিপুল ভোটের ব্যবধানে দুইবারের নির্বাচিত সাবেক এই মেয়র আবার সক্রিয় হয়েছেন। প্রবর্তিত মেয়রাল পদ্ধতির পক্ষে তিনি জনরায়ের জন্য ইতোমধ্যে ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন।
টাওয়ার হ্যামলেটসের ১ম নির্বাচিত নির্বাহী মেয়র লুৎফুর রহমান মেয়র সিস্টেমের পক্ষে একটি জনগণের সমর্থন চেয়ে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। চিঠিতে তিনি কী কারনে-এই সিস্টেম বহাল থাকা দরকার তার পক্ষে কিছু যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, নির্বাচিত মেয়র মানে জনগনের কাছে ক্ষমতা। জনগন যাকে ইচ্ছে ভোট দিয়ে মেয়র নির্বাচিত করতে পারবেন। পছন্দ না হলে বা কমিউনিটির জন্য কাজ না করলে সেই মেয়রকে বাদ দেয়ার ক্ষমতা রাখবেন জনগণ। নিজেকে তিনি নির্বাচিত মেয়রাল সিস্টেমের উজ্জল উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। নিচে তার চিঠি হুবহু তুলে ধরা হলো:

প্রিয় বাসিন্দা,
আমার সালাম এবং শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন। আপনারা আমাকে দুই বার মেয়র নির্বাচিত করেছেন। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের প্রথম নির্বাচিত মেয়রের সম্মান দিয়েছেন এই সমর্থনের জন্য আপনাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আদায় করছি মহান আল্লাহর শুকরিয়া।
আপনাদের একটু সময় চাইবো, যাতে মনোযোগ দিয়ে আমার এই খুব জরুরী চিঠি পড়েন। টাওয়ার হ্যামলেটসে আগামী ৬ মে-এর নির্বাচন ও রেফারেণ্ডামের ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই। আপনাদের ক্ষমতা আপনাদের হাতে রাখা এবং নির্বাচিত মেয়রকে জবাবদিহী করার যে সিস্টেম সেটির ব্যাপারে সচেতন করতে চাই।
আপনারা জানেন, একজন নির্বাচিত মেয়র জনকল্যাণে বড় বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা রাখেন। কারণ তিনি বিশাল ভোট নিয়ে এবং জনগণের কাছে আগাম প্রতিশ্রুতির তালিকা দিয়েই নির্বাচিত হন। কোনো প্রজেক্ট বা ভালো কাজ বাধার মুখে পড়লে মেয়র প্রয়োজনে আইনি চ্যালেঞ্জের মাধ্যেমে কাজটি নিশ্চিত করার ক্ষমতা রাখেন। নির্বাচিত মেয়রকে আপনি সামনা সামনি দেখতে পাবেন। তিনি জনগণের কাছে জবাব দেন, তাদের দরজায় যান। আর আপনি যদি মনে করেন, নির্বাচিত মেয়র সমাজ-কমিউনিটির দিকে ভালো করে নজর দেননি, তাকে নির্বাচনের মাধ্যমে সরিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু মেয়র সিস্টেমটা রাখতে হবে, যাতে সেই মেয়র নির্বাচনের ক্ষমতা আপনার হাতে থাকে। কিন্তু লিডারশীপ সিস্টেমে সামান্য কিছু নেতা, পার্টি বা কাউন্সিলারকেই খুশী করতে হয়। টাউন হলে বসে ব্যক্তি বিশেষের রাজনীতি করতে হয়। কিন্তু মেয়রের অগ্রাধিকার হয় সকল জনগণ।

প্রিয় ভাই-বোনেরা,
আপনারা দেখেছেন চার বছরের জন্য নির্বাচিত মেয়রের ম্যানেফেস্টো বা প্রতিশ্রুতি কাউন্সিলের এজেণ্ডা হিসেবে বাস্তবায়ন হয়। এই মেয়র পদ্ধতি কমিউনিটির যে কাউকে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে রাজনীতি এবং নির্বাচনে আগ্রহী করে। এ কারণে ১০ বছর আগে আপনারা প্রায় ৬২ হাজার ভোট দিয়ে এই সিস্টেম এনেছিলেন। কোভিড নাইনটিনের এই কঠিন সময়ে ৩৫০ হাজার পাউণ্ড খরচ করে এই সিস্টেম নিয়ে আবারো প্রশ্ন তুলে রেফারেণ্ডাম দেয়ার কোনো যুক্তি নেই। যেখানে কাউন্সিল অনেক জরুরী সেবা দিতে পারছেনা।
আপনারা অনেকে জানেন, আবার অনেকেই জানেননা, কাউন্সিল এই বিপর্যয়ের সময়ে আপনাদের উপর এই বাড়তি দায়িত্ব দিয়েছে। কোভিডের কারণে এবং প্রচারণার অভাবে আমরা বেখেয়ালে যদি এই গুরুত্ত্বপূর্ন দায়িত্ব পালনে সচেতন না থাকি, তাহলে বারায় নির্বাচিত মেয়র সিস্টেম হাত ছাড়া করবো। এর মানে হচ্ছে, যাকে ইচ্ছে মেয়র নির্বাচিত করার দায়িত্ব আর আপনাদের হাতে থাকবে না। টাউন হলে বসে কিছু কাউন্সিলার গোপনে একজন লিডার বানাবেন, তিনিই চালাবেন বারা।
৬ মে-ও রেফারেণ্ডামে আপনাকে ভোট দিতে হবে — আপনি কী মেয়রাল সিস্টেমের পক্ষে, যেটি বর্তমান সিস্টেম, যেখানে মেয়র এবং ক্যাবিনেট কাউন্সিল পরিচালনা করেন। না, আপনি লিডারশীপ মডেলের পক্ষে— যেখানে লিডার এবং ক্যাবিনেট কাউন্সিল চালান। আমি জোরালো ভাষায় বলতে চা — ভোটের মাধ্যমে একজন মেয়র নির্বাচিত করার সিস্টেম জারি রাখুন। মনে রাখবেন, ভোট আপনার জন্য একটি আমানত।

আপনারা চারদিকে দেখুন, একজন নির্বাচিত মেয়র স্ব স্ব এলাকার জন্য অনেক ভালো কাজ করতে পারেন। বড় বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তার যথার্থ ক্ষমতা থাকে। ল-ন সিটি, ল-নের চারটি বারাসহ ম্যানচেষ্টার, লিভারপুল এবং বড় বড় সিটি যেমন নিউ ইয়র্ক, প্যারিস কিংবা ঢাকা সবখানে রয়েছেন নির্বাচিত মেয়র। নির্বাচিত মেয়র মানে-জনগণের ক্ষমতা। আপনারাই সিদ্ধান্ত নেবেন কে হবে আপনাদের মেয়র। কাউকে পছন্দ না হলে তাকে আপনারা বাদ দেবেন, কিন্তু সিস্টেমটা রাখবেন।
২০০৮ ও ২০০৯ সালে লেবার পাটি থেকে আমি কাউন্সিল লিডার ছিলাম। প্রথবার মাত্র ১৫ জন এবং দ্বিতীয়বার ১৮/১৯ জন কাউন্সিলার আমাকে সমর্থন করেন। আমি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পার্টি এবং কাউন্সিলারদের কাছে দায়বদ্ধ ছিলাম। কিন্তু ২০১০ সালে আমি প্রথমবার মেয়র নির্বাচিত হই প্রায় ২৫ হাজার ভোটে আর ২০১৪ সালে প্রায় ৩৮ হাজার ভোটে। এতেই প্রমাণিত হয়, নির্বাচিত মেয়র কতো বিশাল জনসমর্থন নিয়েও দায়-দায়িত্ব নিয়ে নির্বাচিত হন। আর এ কারণে তাকে সব সময় জনগনের আশা আকাঙক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হয়। আমিও আমার কাউন্সিলার এবং ক্যাবিনেট মেম্বারদের সহযোগিতায় বেশী হাউজিং নির্মাণের জন্য দেশ সেরা হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিলাম। এডুক্যাশনে ইউকের মধ্যে অনন্য ভূমিকা ছিলো আমাদের টিমের। ড্রাগ এবং ক্রাইমের বিরুদ্ধে লড়তে সব সময় অতিরিক্ত পুলিশ নিয়োগ করেছি আমরা। ছিলো আরো নানা কল্যাণকর কাজ। এই সাফল্য ছিলো শুধুমাত্র নির্বাচিত মেয়র হিসেবে আলাদা কিছু ক্ষমতা থাকায়। প্রধানতম কিছু সাফল্যের তালিকা আপনারা এখানে আলাদাভাবে পড়তে পারবেন।

প্রিয় বাসিন্দা,
এই নির্বাচিত মেয়র সিস্টেম কোনো একজনের জন্য নয়। এটা এই বারার সব মানুষের জন্য। এই সমাজ-কমিউনিটির ভবিষ্যত প্রজন্মের নেতৃত্বের জন্য। ব্যক্তিগত বিষয়ে একটু বলতে চাই, জীবনে কাউন্সিলার, লিডার এবং দু’বারের মেয়রসহ মোট ৮টি নির্বাচন করেছি। সবগুলোতেই বিজয়ী হয়েছি স্ব যোগ্যতা এবং সবার সমর্থন-দোয়ায়। কিন্তু ২০১৪ সালে ৩৮ হাজার ভোটে ২য় বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হলেও- কতিপয় ব্যাক্তির মামলা এবং মাত্র একজন ডেপুটি জাজের (সিভিল/ ইলেকশন ট্রাইবুনালের কমিশনার) রায়ে আমাকে কীভাবে মেয়র পদ থেকে সরতে হয়, তা আপনারা খুব ভালো জানেন। শেষ পর্যন্ত চার চারটি পুলিশি তদন্তে কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রায় ৩ বা ৪ মিলিয়ন পাউণ্ড খরচ এবং খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখে-পুলিশ বিশাল বিবৃতি দিয়ে বলেছে, তারা আমার বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়ার মতো কেনো প্রমাণ পায়নি এবং সব তদন্ত বাতিল করেছে। আমি নীতিবান সব কর্মকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ।

এতো চ্যালেঞ্জ এবং বিপদের পরও সমাজ-কমিউনিটির আন্তরিক সমর্থনে একটুও কমতি হয়নি। বরং বেডেছে। এ কারণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি Ñ জনগণের সাথেই থাকবো। আপনারাই আমাকে শক্তি ও সাহস দিচ্ছেন। আপনাদের অনুপ্রেরণা থাকার পরও কিছু মানুষের অপতৎপরতার কারণে আমি থেমে যেতে পারিনা। আমি ইতিমধ্যে মেয়র সিস্টেমের পক্ষের ক্যাম্পেইনে সক্রিয় হয়েছি। এতে বিভিন্ন পর্যায়ের সাধারণ মানুষ এবং নেতারা যোগ দিচ্ছেন। ইয়েস ফর মেয়র ক্যাম্পেইনে আপনাদেরও সমর্থন আশা করছি।
আসুন, ৬ মে সবাই মিলে মেয়র সিস্টেম রক্ষা করি। ভবিষ্যতে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব আবারো ফিরিয়ে আনি।
— আপনাদের লুৎফুর রহমান

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close