স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী ও একজন জিয়াউর রহমান

।। মুজতবা খন্দকার ।।

মেজর জিয়াউর রহমান।একটি বিশেষ মুহূর্তে … ধূমকেতুর মতো তাঁর আগমন । কোনারকম রাজনৈতিক প্রস্তুতি ছিল না, তিনি পাকিস্তান থেকে ছুটে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন নি, কর্নেল তাহের বা মঞ্জুর যেমনটা দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যখন যোগ দিয়েছেন তখন কাজটা করেছেন সর্বান্তঃকরণে। নিজের নাম গোপন করেননি, পরিচয়ও নয়, যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
তার এই ঘোষণা বেতারে শোনা গেছে। বহু লোক স্বকর্নে শুনেছে। ঢাকা ছেড়ে পদ্মা পাড়ি দেবার সময় তাজউদ্দীন আহমদও শুনেছেন।ওই ঘোষণায় জিয়া বলেছেন যে তিনি, মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির কমান্ডার ইন চিফ, স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন। এই ঘোষণার সেদিন দরকার ছিল। সাধারণ মানুষ এবং সেনাবাহিনীর, ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা নানা জায়গা থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইতিমধ্যেই বের হয়ে এসেছিল বা আসা শুরু করেছিল, প্রতিরোধ আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল, জিয়ার ওই বেতার ভাষণ শুনে লোকে উদ্দীপ্ত হয়েছে, জেনেছে যে বিক্ষিপ্ত প্রতিরোধ একটা সংঘবদ্ধ যুদ্ধের রূপ নিতে যাচ্ছে। ৩০ মার্চ জিয়া আরেকটি বক্তব্য দেন, বেতারে। এটিতে জাতিসংঘ ও বৃহৎশক্তির প্রতিনিধিদের সরেজমিনে এসে বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলছে তা দেখে যেতে অনুরোধ করেন। এই বেতার ঘোষণাগুলো বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো কাজ করেছে, যেমন বিচ্ছুরণের গতিতে তেমনি সজীবতা সৃষ্টিতে। (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী/ বাঙালীর জাতীয়তাবাদ ॥ [ইউপিএল – ২০১১ । পৃ: ২৬০-৬৩]
জিয়াউর রহমান যখন স্বাধীনতার ঘোষণা যে সময়টাতে দেন, মনে রাখতে হবে সময়টা বিংশ শতাব্দির শেষ ভাগ। স্নায়ু যুদ্ধের সেই সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে-বিপক্ষে ক্রিয়াশীল তখন বহু অক্ষ শক্তি। যদি কোনো কারণে যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন একটি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে ব্যর্থ হতো, তবে জিয়াকে সামরিক শৃঙ্খলা ও দেশ ভাঙ্গার অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে কোর্ট মাশালের মুখোমুখি হতে হতো। কিন্তু তিনি ছিলেন, অকূতভয় আর দেশ মাতৃকার জন্য নিবেদিতপ্রাণ একজন সৈনিক। সংগতকারনে তিনি এসব আগ-পাছ ভাবেননি, কিম্বা ভাবার মতন সময়ও তিনি পাননি। তিনি কেবল ভেবেছেন, অর্ধশতাব্দি ধরে বাঙলার মানুষ যে শোষণ বৈষম্যের স্বীকার হয়ে আসছে তা থেকে তাদের মুক্তির কথা। আর তাই তার সেই এক ঘোষণা। শুধু ঘোষনাই ছিলোনা, ছিলো..বাঙলার মানুষের মুক্তির বার্তা।
জিয়া তাই আমাদের মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক।বাংলাদেশের ইতিহাস লিখতে গেলে অনিবার্যভাবে চলে আসবে মেজর জিয়ার নাম। চাইলেও কেউ তা এড়িয়ে যেতে পারবে না।
ইতিহাসে হাতে গোনা যে দু একজন সামরিক অফিসার দেশের জন্য দু’দুটি পূর্নাঙ্গ যুদ্ধে লড়াই করার গৌরব অর্জন করেছেন এবং জেনারেল পদে উন্নিত হয়েছেন জিয়া তাদের অন্যতম।
তিনি ১৯৬৫ পাক-ভারত যুদ্ধে এবং ১৯৭১ সালে মাতৃভুমি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম জিয়াই ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে বিদ্রোহ করেন ।এর মাধ্যমে চট্গ্রামে তার অধিনস্থ অফিসারদের নিয়ে যুদ্ধ শুরু করেন তিনি। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তিনি অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের জুন পর্যন্ত ১ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক এবং পরে জেড ফোর্সের প্রধান হিসেবে দু:সাহসি সেনানায়কেরএকটা আলাদা পরিচয় অর্জন করেন জিয়া এবং বীর উত্তম খেতাব লাভ করেন। প্রফেসর রেহমান সোবহান লিখেছেন: “ I spent the night of 27 march in my new refuge. That night we truned in on the radio and heard a faint broadcast by Major Ziaur Rahaman, proclaiming the independence of Bangladesh.” ( Rehman Sobhan,Untranquil Recollections; The years of Fullfilment, Sage Publications, New Delhi, 2016, p347.
স্বাধীনতাযুদ্ধের নয়টি মাস কি প্রত্যয় নিয়ে জিয়াউর রহমান যুদ্ধ করেছিলেন, তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন, বীর বিক্রম শমসের মোবিন চৌধুরী : পরিবারকে ফেলে রেখে জিয়া স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহন করলে তাঁর স্ত্রী আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। তখন চট্টগ্রামে যে বাড়ীতে বেগম খালেদা জিয়া ও তাঁর দুই ছেলে থাকতেন তার পাশ দিয়ে একদিন জিয়া তাঁর সেনাদল নিয়ে যাওয়ার সময় লেফটেন্যান্ট শমসের মোবিন তাঁর কাছে জানতে চান, তিনি পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান কি না। সঙ্গে সঙ্গে জিয়া উত্তর দিয়েছিলেন, আমার অধীনে থাকা ৩০০ সৈনিক যদি তাঁদের পরিবার ত্যগ করে আসতে পারে, তাহলে আমি আমার পরিবারকে নিয়ে যেতে পারি না। (প্রেসিডেন্ট জিয়া, মাহফুজ উল্লাহ পৃষ্ঠা-২৯)
যুদ্ধের সময় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বেশ উদ্ধিগ্ন ছিলেন জিয়া। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রফেসর মুহম্মদ শামসুল হক লিখেছেন: “দীর্ঘ নয় মাস ধরে যখন তাঁর স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে ঢাকা সেনা নিবাসে বন্ধি করে রাখা হয়েছিলো তখন তিনি ধৈর্য্য ও সাহসের সঙ্গে গভীর মানসিক যন্ত্রণা ও কষ্ট সহ্য করে গেছেন তা আমাকে বেশী অভিভূত করেছে। শত্রু বাহিনী তাঁকে একের পর এক চরমপত্র দিয়ে যাচ্ছিল আত্মসমর্পনের জন্য। পরিবারের নিরাপত্ত্বা নিয়ে একদিকে যেমন তাঁর গভীর মর্মবেদনা এবং অন্যদিকে দেশপ্রেমিক হিসেবে কর্তব্যের ডাক- এই দুইয়ের মাঝখানে পড়ে তাঁকে নিদারুনভাবে কষ্ট পেতে হয়েছিলো। কিন্তু বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি সাহসিকতার সঙ্গে লড়ে গেছেন।
সেই সময় ঢাকায় দায়িত্ব পালনরত পাকিস্তানি সামরিক অফিসার মেজর জেনারেল জামশেদকে ২১ আগষ্ট ১৯৭১ একটি চিঠি লেখেন জিয়া। পাঞ্জাব রেজিমেন্টে কর্মরত থাকাকালে জেনারেল জামশেদ তাঁর অধিনায়ক ছিলেন। জামশেদকে তিনি লেখেন, Dear General Jamshed, My wife Khaleda is under your custody,If you do not her with respect, I would kill you someday. Major Zia.” চিঠিটি তিনি মেজর সাফায়াত জামিলকে দিলেন দেশের অভ্যন্তরে কাউকে দিয়ে ডাক বাক্সে ফেলার জন্য। দেওয়ানগঞ্জে পোষ্ট করা চিঠি সত্যিই জেনারেলের জামশেদের হাতে পৌঁছেছিলো পরবর্তীকালে।
জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছিল যুদ্ধের সময় থেকেই। যুদ্ধের সময় জেড ফোর্সের অবস্থান কোথায় হবে তা নিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে জিয়ার মতবিরোধ ঘটে। তখন উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় তাঁর বাহিনীকে এমন অবস্থানে রাখা হয়েছিলো যার ফলে পাকবাহিনীর আত্ম সমর্পনের দিন অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তিনি ঢাকায় উপস্থিত হতে পারেননি। স্বাধীনতাযুদ্ধে জেড ফোর্স অনন্য বীরত্ব প্রদর্শন এবং ব্যাপক ত্যগ স্বীকার করে। ( প্রেসিডেন্ট জিয়া- পৃষ্ঠা ২৫-২৭)
দুই.
স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব সরকার জিয়াউর রহমানের প্রতি খুব একটা প্রসন্ন ছিলেন না। জিয়াউর রহমানকে উচ্চভিলাসী সামরিক কর্মকর্তা মনে করতেন শেখ মুজিব। আর তাছাড়া স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে সেনাবাহিনীতে জীয়উর রহমানের একটা আলাদা কদর ছিলো। সৈনিকরা তাকে পছন্দ করতো। তিনি জনপ্রিয়তায় তার সমসাময়িক অফিসারদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। এই জন্য শেখ মুজিব সহ অন্যান্যরা তাকে ঈর্ষার চোখে দেখতেন। ভিশনারী হওয়া কারো জন্য দোষের কিছু হতে পারে না। বরং ভিশনারী না হওয়াটাই একজন মানুষ নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন।
এ বিষয়ে সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ লিখেছেন: স্বাভাবিক নিয়মে জিয়াকেই সেনাপ্রধান নিয়োগ করা উচিৎ ছিল। কিন্তু এই পদে নিযুক্তির ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি সর্বদা চূড়ান্ত বিবেচ্য বিষয় নয়, বরং এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত নিয়োগদাতার মনোভাব ও ব্যক্তিগত বিবেচনার ওপর নির্ভর করে, যিনি আগেভাগে ধারণা পেতে চান যে, কার সঙ্গে কাজ করতে তিনি স্বস্তি ও নিরাপদ বোধ করবেন— এক্ষেত্রে বিবেচনাটি হচ্ছে ‘কে আমার কথামত ভালভাবে কাজ করবে’।জিয়াকে সেনাবাহিনী প্রধান না বানানোর আরো কারণ ছিলো। ‘ তাঁকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করা হয়নি, কারণ স্বাধীনতা ঘোষনার অনন্য কৃতিত্ব ছিল তাঁর। তার ওপর, শেখ মুজিবের বোনের ছেলে এবং আওয়ামী লীগের তাত্বিক হিসেবে পরিচিত শেখ ফজলুল হক মনি চেয়েছিলেন সেনাপ্রধানের পদে শফিউল্লাহকে বসানো হেক, যিনি পেশাগত যোগ্যতায় জিয়ার চেয়ে খাটো ছিলেন। ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদ মনে করেন: শফিউল্লাহ ছিলেন জিয়ার তুলনায় বশংবদ। অপর কারনটি হতে পারে,শেখ সাহেব জিয়াকে একজন প্রতিদ্বন্দি হিসেবে দেখেছিলেন। তাঁর মধ্যে গরহাজির নেতৃত্বের মানসিকতা কাজ করতো। শেখ মুজিব শফিউল্লাহকে ব্যক্তিগতভাবে ও রাজনৈতিক দিক থেকে অনুগত মনে করতেন। মুজিব জিয়াকে মনে করতেন উচ্চাকাঙ্খী। আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, স্বাধীনতা ঘোষনার কারণে ‘মুজিব জিয়ার প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন এবং মনে করতেন, এই তরুণ অফিসার তার কতৃত্বের সীমা লঙ্ঘন করেছে, যার ফলে সেনাপ্রধানের পদের জন্য স্বাভাবিক প্রার্থী হওয়া সত্ত্বেয় তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু ১৫ আগষ্ট ১৯৭৫ ভোর রাতে ধানমন্তির বত্রিশ নম্বরের বাড়ি আক্রান্ত হলে মুজিব যখন শফিউল্লাহর কাছে সহায়তা চান তখন শফিউল্লাহ যে ভূমিকা পালন করেন তা প্রশ্ন বিদ্ধ থেকে গেছে।
সেনাপ্রধানের পদ থেকে জিয়ার বঞ্চিত হওয়ার অনেক ব্যাখা রয়েছে। লে.কর্নেল আবদুল লতিফ খান অব. বলেন, ভারতীয়রা চেয়েছিল শফিউল্লাহ কে সেনাপ্রধান নিয়োগ করা হোক এবং ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে জিয়ার ভূমিকার জন্য তারা তাঁকে পছন্দ করতো না।
জেনারেল ওসমানী অব. এর অধিনায়কত্বে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও তিনি জিয়াকে পছন্দ করেতন না। কিন্ত পরবর্তীকালে দায়িত্বপালনের সময় জিয়া কখনো তার প্রাক্তন অধিনায়কের প্রতি কোন রকম অসম্মান প্রদর্শন করেন নি। যদিও শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিয়োগে জেনারেল ওসমানীর একটা ভূমিকা ছিল। ওসমানি এবং জিয়া উভয়ের ঘনিষ্টভাবে পরিচিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রথম প্রধান ক্যাপ্টেন নুরুল হক অব. বলেছেন, জেনারেল ওসমানি জিয়াকে পছন্দ করেতন না এবং শেখ মুজিবকে তিনি বোঝান যে জিয়াকে সেনাপ্রধান করা ঠিক হবে না, কারণ তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এটা জিয়াকে খানিকটা হতাশ করে। তবে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে জিয়াই সেনাপ্রধান হতেন।
ওসমানী এও জানতেন যে, জিয়া ছিলেন কঠিন পাত্র আর সেনাহিনীর ওপর মুজিবের কোনো আস্থা ছিলো না, কারণ তিনি মনে করতেন বাংলাদেশ সেনাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীরই একটি নতুন সংস্করণ।
(মাহফুজ উল্লাহ/ প্রেসিডেন্ট জিয়া/ রাজনৈতিক জীবনী/ ॥ [অ্যাডর্ন প্রকাশনি/ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬ । পৃ: ৩১-৩৩]
অন্যদিকে, ব্যক্তিগতভাবে জিয়ার দেশপ্রেম, সততা, ঐকান্তিকতা ছিল সব সন্দেহের উর্ধ্বে। যদিও কর্নেল তাহেরের বিচার নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি ও ধুম্রজাল রয়েছে। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর ভেতরে যেভাবে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিলেন,সেটা ছিল এক ঘৃণ্য অপরাধ। অনেক নিরীহ মানুষকে তাঁর বিপ্লবী সংস্থা হত্যা করেছে। নিহতদের কেউ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীতে দুর্নীতির কোন অভিযোগও ছিল না। অন্যদিকে জনগণের মধ্যে কর্নেল তাহেরের কোন ভিত্তি ছিল না। জাসদের যে গণবাহিনী ছিল, তারা বিভ্রান্তিকর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের স্লোগান দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে…।
…তাহেরের কাজটি কোনো মূল্যবোধের পর্যায়ে পড়ে না। এটা কোন ধরনের দর্শন হতে পারে না। ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাতে তাঁর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা স্লোগান দিয়েছে, ‘অফিসারের রক্ত চাই/সুবেদারের ওপরে অফিসার নাই।’ অর্থাৎ এটা প্ল্যানটেড কোন স্লোগান। বিদেশ থেকে আমদানি করা স্লোগান, যাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শক্ত ভিতের ওপর গড়ে উঠতে না পারে, । সেনাবাহিনী যদি গড়ে উঠতে না পারে, তাহলে যারা সুবিধাটা নেবেন, তাঁরাই এই কাজ করিয়েছিলেন। এ কারনেই জিয়া তাঁদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত এ্যাকশনে চলে যান। সেনাবাহিনীতে ডিসিপ্লিন বরখেলাপ করে যখনই কেউ কাজ করবে, ডিসিপ্লিন ভঙ্গের যে ধারাগুলো আছে, সেটা তাঁর ওপর বর্তাবে। সুতরাং বিচারে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। কেউ তাঁকে জোর করে মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে না। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণেই বিচার। সেটা সংক্ষিপ্ত আকারেও সেনাবাহিনী করতে পারে। কোর্ট মার্শাল যেটা হয়, সেটা বৈধ এবং আইনগতভাবে এটার বৈধতা আছে।
জিয়ার বিরুদ্ধে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা প্রায়শ; একটি অভিযোগ করেন জিয়াউর রহমান দেশে প্রথম সামরিক শাসন জারি করেছিলেন। অভিযোগটা নির্জলা মিথ্যে।
… মূলতঃ এরশাদই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সামরিক আইনের মাধ্যমে দেশ শাসন করেছিলেন। এর আগ পর্যন্ত সামরিক আইনের মাধ্যমে কেউ দেশ শাসন করেননি। জিয়া সামরিক আইন জারি করেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক ক্ষমতায় এসে সামরিক আইন জারি করেন। জিয়া তাঁর অধীনে ছিলেন। পরে তিনি সায়েমের অধীনে ছিলেন। পরে যদিও জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি নিজে কোন ফরমান জারি করেননি। … জিয়া দ্রুত সামরিক আইন প্রত্যাহার করে গণতন্ত্রে ফিরে গিয়েছিলেন।
(১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন/আমীন আহম্মেদ চৌধুরী/পৃষ্ঠা-১৭২,১৭৪,১৭৬/প্রথমা প্রকাশন/ তৃতীয় সংস্করণ/ চতুর্থ মুদ্রণ/২০১৬)
সাদা মাটা সরল জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন জিয়া। বাংলাদেশের রাজনীতিকরা সাধারণত আড়ম্বরপূর্ন জীবন যাপন করতে ভালবাসেন কিন্তু জিয়া ছিলেন ঠিক তার বিপরীত একজন নেতা। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। ছিলেন স্বল্পাহারীও । এ প্রসঙ্গে প্রয়াত সাংবাদিক এবিএম মূসাও সে কথাই বলেছিলেন: একবার জিয়া আমাকে তাঁর সঙ্গে বঙ্গভবনে দুপুরের খাবার খেতে বললেন। খাবার টেবিলে আমার জন্য অপার বিস্ময় অপেক্ষা করছিলো। একজন প্রেসিডেন্টের টেবিলে এমন সাধারণ মানের খাবার থাকতে পারে ভাবাও যায় না।
শুধু তাই নয় কাজপাগল একজন প্রেসিডেন্ট ছিলেন জিয়া। জিয়া প্রায়শঃ গভীর রাতে মন্ত্রীদের ঘুম থেকে জাগিয়ে সরকারী কাজের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে জানতে চাইতেন।
প্রতিদিন সকাল সাতটায় শুরু হতো তাঁর কাজ। একজন কাজপাগল মানুষ হলেও কখনো কোনো ওয়াক্তের নামাজ তিনি আদায় করতে ভুল করতেননা। ১৯৭৯ সালে পৃথিবীর স্বল্পসংখ্যক মুসলীম রাষ্ট্রপ্রধানদের একজন হিসেবে তিনি পবিত্র কাবাঘর পরিস্কার করার কাজে অংশগ্রহন করেন। সাধারণত: বছরে দুবার সৌদি বাদশাহর নেতৃত্বে কাবাঘরের ভেতরটা পরিস্কার করা হয়ে থাকে। সেই সুযোগ সবাই পায়না। হাতে গোনা কয়েকজন মুসলিম প্রেসিডেন্ট তখন পর্যন্ত কাবা ঘরের ভেতরে ঢোকার বিরল সুযোগ পেয়েছিলেন। জিয়া তাদের একজন। ( হেদায়েত হোসেন মোর্শেদ, একজন জিয়া-পৃষ্ঠা ৬৮)
জিয়ার সততা ছিলো অতুলনীয় ও কিংবদন্তিতুল্য। পাছে দুর্ণিতির সূত্রপাত ঘটে এ কারণে তিনি , বিশেষ করে ক্ষমতায় থাকাকালে,আত্মীয়স্বজনদের নিরাপদ দুরত্বে রাখতেন।
এ প্রসঙ্গে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে: জিয়া ছিলেন একজন মৃদুভাষী সামরিক ব্যক্তি, কঠোর পরিশ্রমী ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুর্ণিতির উর্ধ্বে; আর নতুন জাতিকে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে প্রয়োজনীয় কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহনে তিনি ছিলেন পারঙ্গম । (The New york times,30 May1981) বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আলেকজান্ডার স্টোরার সাংবাদিক সৈয়দ কামাল উদ্দীনকে বলেছিলেন: তোমাদের প্রেসিডেন্টকে দেখো। তাকে কোনোভাবেই ঘুষ দেয়া যায় না। তিনি কঠিন টাস্কমাষ্টার যা দুর্নীতিতে নিরুৎসাহিত করে।( মাহফুজ উল্লাহ, প্রেসিডেন্ট জিয়া- পৃষ্ঠা ৪১)
জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের একমাত্র প্রেসিডেন্ট, একমাত্র জাতিয় নেতা যিনি ব্যক্তিগত সম্পদের তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করেছিলেন।
জিয়া রাজনীতিক হিসেবে গ্রামকে সবসময় গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনে করতেন, গ্রামের উন্নতি না হলে দেশকে উন্নত করা কঠিন। নিউ ইয়র্ক টাইমস ১৯৭৬ সালে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়: ‘জিয়াউর রহমানের দৃঢ় বিশ্বাস গ্রামাঞ্চল থেকেই দেশের অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হবে। তাঁর নির্দেশ বেসামরিক কর্মকর্তাদের অবশ্যই গ্রামে গিয়ে সময় দিতে হবে। সেখানে গিয়ে মাটি সংলগ্ন হতে হবে। জিয়া বলেছেন, আমি নির্দেশ দিয়েছি সবচেয়ে সিনিয়র কর্মকর্তাদের ৫ দিন জুনিয়র কর্মকর্তাদের ১৫ দিন গ্রামে কাঁটাতে হবে।’
সৈনিক জীবনে প্রচুর হেটেছিলেন জিয়াউর রহমান। প্রেসিডেন্ট হবার পরও তিনি সেটা ত্যাগ করেননি। তিনি চালু করেছিলেন জানার জন্য হাটা কর্মসূচী। ১৯৭৭ সালের জানুয়ারীতে তিনি সিলেটের হাওড় অঞ্চলের ২২ মাইল পথ পায়ে হেটে পাড়ি দেন। এরপর তিনি সে বছর ফেব্রুয়ারীতে তিনদিনে কুষ্টিয়ার গ্রাম গুলিতে ৪০ মাইলে পায়ে হাটেন। বহুদিন তিনি গ্রামের ধুলো মলিন রাস্তা পায়ে হেটে হেটে গ্রামের মানুষদের সাথে কথা বলেছেন, তাদের সঙ্গে মিশেছেন। তাদের কষ্টের কথা শুনেছেন। গ্রমে মাইলের পর মাইল হেটে মানুষের সমস্যার কথা শুনেছেন, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়ে জনপ্রিয়তার একটি ব্যাপক ভিত্তি তৈরী করেন জিয়াউর রহমান। যোগ্যতাকে উর্ধ্বে স্থান দিয়ে তিনি মুজিব অনুসৃত স্বজনপ্রীতির অবসান ঘটিয়েছিলেন। এতে হয়তো কাউকে কাউকে তার প্রতি বৈরী করে তুলেছিলেন, কিন্তু দিনশেষে ন্যয়নুগতার তিনি অর্জন করেছিলেন প্রভূত সুনাম। মুজিব যা করেছিলেন তার বিপরীতে তিনি আইনকে সম্মান করতেন। জিয়া বলতেন, বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের অনেকগুলো তিনি দেখেছেন। যেগুলো দেখা হয়নি চাইতেন সেগুলোর মধ্যেও তিনি হেটে যাবেন। তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নেতা যিনি দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন। যা তাঁকে দিয়েছিলো আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা।
বাংলাদেশের কোন কোন রাজনৈতিক নেতা মনে করতেন বা করেন আমার দেশ আমার জনগন। তাদের মতো না করে জিয়া বলতেন আমাদের দেশ, আমাদের জনগন।
অদম্য আশাবাদি জিয়া ছিলেন বাংলাদেশের সত্যিকারের স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। তার নেতৃত্বের গুনাবলী ছিলো। তিনি নেতৃত্ব দিতে জানতেন। পারতেন মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার একটি স্বপ্ন ছিলো। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের বহু নেতার মত তিনি ছিলেন একজন নিঃসঙ্গ শেরপা,একজন একক যোদ্ধা। (Ambassador William B. Milam,Bangladesh & Pakistan: Filirting with Failure in South Asia, Harst & Company, London 2009, p54. মাহফুজ উল্লাহ , প্রেসিডেন্ট জিয়া পৃষ্টা -৪৫-৪৭)
তিন.
বাংলাদেশের জনগনকে একটি স্বতন্ত্র পরিচয় দিয়েছিলেন জিয়া। বাংলাদেশের নাগরিকরা বাঙালীর পরিবর্তে বাংলাদেশী হিসেবে পরিচিত হবেন এই মর্মে জিয়া যে সাংবিধানিক পরিবর্তন এনেছিলেন, সে সম্পর্কে এক শ্রেনীর রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা সত্তেয় পরবর্তীতে কোনো সরকারই নাগরিকদের এই পরিচয়ে আর পরিবর্তন আনেননি। এমনকি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর পরেও এই পরিচয় অব্যাহত আছে। এর কারন তাত্বিক বিচারে বাংলাদেশের নাগরিকদের বাংলাদেশী পরিচয়ই একদম সঠিক । আর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার পেছনেও নিজের নিজস্ব একটি চিন্তাধারা ছিলো।
তিনি বলেন:এখন প্রশ্ন হলো: জাতীয়তাবাদ কি? ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, এ বিশ্বে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছে। ‘ রেসিয়াল বা জাতি ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা এ প্রসঙ্গে সর্ব প্রথম এসে যায়। আর ব ও জার্মান জাতীয়তাবাদ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।..এরপর আসে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা। বাঙালী জাতীয়তাবাদের শ্লোগান এ ধ্যানধারণা থেকে উৎসারিত। এ কারণে আওয়ামী লীগাররা বাঙালী জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে এখনো বিভোর রয়েছে। আবার মুসলীম লীগ, আইডিএল এবং জামায়াতিরা বলে থাকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা।
সত্য করে বলতে গেলে বলতে হয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কায়েম করতে গিয়ে বাংলাদেশকে শোষন ও শাসন চালানো হলো। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নামে ‘ পলিটিকস অব এক্সপ্লয়েটেশন’ পাকিস্তানকে এক রাখতে পারলো না। প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একটি অঞ্চলকে ভিত্তি করেও রাজনীতি চলতে পারে, গড়ে উঠতে পারে এক নতুন জাতীয়তাবাদ। তাই আমরা বলি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিক জাতীয়তাবাদ।
আমাদের আছে জাতিগত গৌরব, রয়েছে সমৃদ্ধশালী ভাষা এবং আছে ধর্মীয় ঐতিহ্য। ভৌগলিক অবস্থান হিসেবে আমরা এক গুরুত্বপূর্ন অঞ্চলের বাসিন্দা। আমাদের আছে নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার স্বপ্ন। আর এসব রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনায় অবগাহিত। একটা জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে এ উপাদানের সমাবেশ ইতিপূর্বে আর দেখা যায়নি।
তাই যদি কেউ যদি বলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধর্মকে অবলম্বন করে হচ্ছে না, তবে ভুল হবে। ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থাকা বাংলাদেশী জাতির এক মহান ও চিরঞ্জীব বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা আছে: ‘লা ইক্করা ফিদ্বীনে’, অর্থাৎ ধর্মের ব্যাপারে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। সুতরাং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয়, তেমনি আবার ধর্মবিমুখও নয়। এ জাতীয়তাবাদ প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে কেউ যদি বলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবদ কেবল ভাষা ভিত্তিক, তবে সেটাও ভুল বলা হবে। আবার কেউ যদি বলে আমাদের কেবল একটা অর্থনৈতিক কর্মসূচী রয়েছে। কিন্ত কোনো দর্শন নেই , সেটাও ভুল। আমাদের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ফিলোসফিতে এবজরশন পাওয়ার আছে। এলবো রুমও রয়েছে। যদি কোথাও ঘাটতি থাকে, অন্যটি থেকে এনে পুরো করে দিতে পারবেন। আমাদের অলটারনেটিভ আছে। সেকারণেই আমরা টিকে আছি। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করছে।….
জাতীয়তাবাদের টার্গেট হবে জনগন। কারণ জনগনই সকল শক্তির উৎস। এ জন্যই আমরা গ্রামে গ্রামে সংগঠন করছি। প্রতিষ্ঠা করেছি সামাজিক- অর্থনৈতিক স্বনির্ভর গ্রাম সরকার।
প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক জাতির একটা স্বপ্ন থাকে। তেমনি আমাদের মনেও রয়েছে অনেক স্বপ্ন। সে স্বপ্নই হলো দর্শন। এ দর্শন দিয়েই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাস্তবায়িত করতে হবে। আমরা স্বপ্ন দেখছি একটা শোষনমুক্ত সমাজ গঠনের। সম্পদের সুষম বন্টনের মাধ্যমে সকলের অধিকার নিশ্চিত করার।…
দুনিয়ার প্রত্যেকদিন একই থাকে না। আল্লাহ তায়ালা যখন নেচারই চেঞ্জ করছেন, তখন আপনার টার্গেট গুলো চেঞ্জ করবেন না কেন? আপনার চাহিদার ক্ষেত্রেও তো রদবদল হয়েছে।… খালি পেটে দর্শন হয়না, কাজও করা যায় না। রাজনীতি তো করা যায়ই না। তাই সর্বক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি আমাদের দর্শনের মধ্যে ধর্মীয় দর্শনও অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত আছে।….. আমরা মানুষকে যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শন দিতে যাচ্ছি,তাতে তিন ধরনের খোরাক আছে। যেমন (১) ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য অন্নের সংস্থানের জন্য উৎপাদন বৃদ্ধির আহবান, (২) স্বাবলম্বী জীবনযাপনের জন্য অনুপ্রেরণা এবং (৩) পারলৌকিক জগতের জন্য প্রস্তুতিগ্রহনের মাধ্যমে আত্মার শান্তি অর্জনের প্রচেষ্টা। এ কারণেই আমরা বলছি,ধর্মের এলিমেন্ট যদি রাজনীতিতে না থাকে, তবে সেটাও ভুল হবে। ‘সেক্যুলার স্টেট” বলে অনেক দেশের পরিচয় দেওয়া হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসাবে ইংল্যান্ডের কথাই ধরা যাক। ’৭৭ সালে গিয়েছিলাম কমনওয়েলথ সিলভার জুবিলি উৎসবে। কথায় কথায় বাইবেল। কোনো কিছুই শুরু হয় না বাইবেল ছাড়া। তারা সেক্যুলার হলো তাহলে কোথায়? এরপর আসুন প্রতিবেশী ভারতের কথায়। সারা দুনিয়ার ‘সেক্যুলার স্টেট’ বলে সে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু আসলে কি তাই? না, আমার মতে ভারত সেক্যুলার নয়। একজন ভারতীয় সাংবাদিককে বলেছিলাম এ কথা। বলেছিলাম ভারতে উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে সর্বক্ষেত্রেই হিন্দু ধর্মমত প্রতিপালিত হচ্ছে। অন্য ধর্মালম্বীদের যথার্থ মর্যাদা দেওয়া যায় না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রতিবছর কতশত সংখ্যালঘু মারা যায়। এতে উক্ত সাংবাদিক রুষ্ট হলেন। কিন্তু রুষ্ট হলে কী করা যাবে? আমাদের সাধারণ মানুষের চেয়ে ভারতীয়দের অবস্থা ভালো না হলেও তারা এটম বোম,ট্যাংক বানিয়ে চলছে। আমাদের কথা হলো , মানুষরে হাত-পা বেঁধে কিছু করতে চাই না।
জিয়া তার বক্তৃতা বিবৃতিতে প্রায়ই উন্নয়নের রাজনীতি’র কথা বলতেন। তনি এটাও মনে করতেন যে জাতীয়তাবাদ কেবল একটা ধারণাগত বিষয় নয়, এটা এমন একটা প্রণোদনা,যা মানুষকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। ১৯৮১ সালে তিনি মার্কাস ফ্রান্ডাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, এটা আমাদের আমাদের ভূমি।…. আমাদের ভূমি অনেক বিজেতা এসে নষ্ট করেছে। এখন সুযোগ এসেছে আমাদের এই ভূমি চাষাবাদ করি এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াই। শিল্প গড়ে তুলি এবং মর্যাদার সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াই। আমাদের আস্থা রাখতে হবে নিজেদের শক্তিতে… কোনো বিদেশীবাদ নয়। (মহিউদ্দিন আহমদ/ বিএনপি: সময়-অসময় ॥ [প্রথমা প্রকাশন : ফেব্রুয়ারী, ২০১৬ । পৃ: ১২৯-১৩১]
চার:
মার্কিন ষোড়শ প্রেসিডেন্ট Abraham Lincoln বলেছিলেন: Nearly All men can stand adversity, but if you want to test a man’s character, give him power. প্রায় সব মানুষই প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে পারে , কিন্তু কারো চরিত্র যাচাই করতে চাইলে তাকে দাও ক্ষমতা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় হয়। সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল ছিলো স্বাধীনতা। কিন্ত অল্প দিনের মধ্যে স্বাধীনতা আনন্দ মিলিয়ে যায় । হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে জাতি। পরিবর্তনের জন্য ব্যকুল হয়ে পড়ে গোটা জাতি। বাংলার ইতিহাসের গতি পরিবর্তনের নায়ক শেখ মুজিব অচীরেই হয়ে ওঠেন দেশ পরিচালনায় ব্যর্থতার এক খল নায়ক। ১৯৭২-৭৫ শেখ মুজিবের শাসন ছিলো মানুষের কাছে একটা তীক্ত অভিজ্ঞতা। দুর্ভোগে ক্লান্ত দিশেহারা জনগন দেখে দুর্ভিক্ষ, একশ্রেনীর মানুষের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুন্ঠন, বিরোধীদের ওপর নির্য়াতন, রক্ষীবাহিনীর বিচারবর্হিভূত গুপ্ত হত্যা, গণমাধ্যমের কন্ঠরোধ, মৌলিক অধিকার হরণ, ৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে নজিরবিহীন কারচুপি। এ সময় শ্লোগান তৈরী করা হয়েছিলো এক নেতা-এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। আইনের শাসন নয়, মুজিবের শাসন চাই। মুজিববাদ নামে নতুন একটা মতবাদ প্রতিষ্ঠারও চেষ্টা চলে। ফলে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেশের মানুষের মনে দেখা দেয় অজানা শংকা ও অনিশ্চয়তা। জাতীয় সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই ২৫ শে জানুয়ারী ১৯৭৫ সালে মাত্র ১১ মিনিটে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী কার্যকর করার মাধ্যমে দেশের সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ মানে বাকশাল কায়েম করা হয়। একদলীয় শাসনের অধিনে নিয়ে আসা হয় দেশকে। রচিত হয় স্বাধীনতা ও গণত্ন্ত্রের সমাধি।
পচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর, প্রেসিডেন্ট জিয়া ক্ষমতায় এসে ফিরিয়ে দেন বহুদলিয় গণতন্ত্র, ফিরিয়ে দেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও। শুধু তাই নয় জিয়াউর রহমান মনোযোগ দেন দেশগড়ার কাজে। পাশপাশি আধুনিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে মনোনিবেশ করেন কুটনতিক তৎপরতা। ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা পেতে জিয়া তৎপর হয়ে পড়েন। জিয়া গঙ্গার পানির ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৩ জানুয়ারি ১৯৭৬ সাল, বাংলাদেশের জীবনে একটি অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনই প্রথম বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের উপর ফারাক্কার বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা বিশ্ব দরবারে তুলে ধরা হয়। বলিষ্ঠ কন্ঠে জিয়াউর রহমান ইসলামী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে বললেন, “উই মাস্ট গেট রাইটফুল শেয়ার অব গ্যানজেন্স ওয়াটার’। কনফারেন্স হল স্তব্ধ বিস্ময়ে শুনলো এক জাতীয়তাবাদী নেতার যুক্তিপূৰ্ণ শক্ত-বাঁধুনী বক্তব্য। তিনি সমগ্র মুসলিম বিশ্বের কাছে আবেদন জানালেন, তাঁরা যেন এরকম একটি অতি জরুরী ও গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে সাহায্য ও সহযোগিতা করেন। তাঁর বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশ সীমান্তে পার্শ্ববতী রাষ্ট্রের উস্কানিমূলক তৎপরতার কথাও বললেন। সমুদ্র আইন সংক্রান্ত নিউইয়র্ক সম্মেলনে জলসীমারেখা নির্ধারণের ব্যাপারে বাংলাদেশের ভূমিকার সমর্থন দানের জন্যে জেনারেল জিয়া মুসলিম দেশসমূহের নেতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। জেনারেল জিয়ার বক্তৃতা সম্মেলনে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়। মুসলিম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের জনগণের ন্যায্য দাবি-দাওয়া পূরণে বাংলাদেশের দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের উল্লেখ করে বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়া তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।
এর পরের দিন অর্থাৎ ১৪ মে ফারাক্কা সম্পর্কে ওআইসি’র ভূমিকা সম্পর্কে আমার এক প্রশ্নের উত্তরে সম্মেলনের মুখপাত্ৰ গিনির থিরনো নবিকা ডিয়ালো বললেন, বাংলাদেশের এ দুর্দিনে মুসলিম বিশ্ব নীরব থাকতে পারে না। আবদুর রহিম (সাংবাদিক) / সুপ্রভাত বাংলাদেশ ॥ [ ননী প্রকাশনী – ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫ । পৃ: ৭৪-৭৭ ]
শষ্য বিপ্লবে জিয়াউর রহমান যেসব উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার সেসব উদ্যোগ দেশবিদেশে যথেষ্ট সুনাম কুড়িয়েছিল। এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম শামসুল হুদা লিখেছেন: “… আমি ১৯৮১ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে এসেছি। অত্যন্ত মেধাবী, উন্নয়ন প্রশাসনে অভিজ্ঞ ও লক্ষ্য অর্জনে দুর্বার ও দৃঢ়চিত্ত আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ খান আমার সচিব। প্রশাসন পরিচালনায় তার স্টাইল ছিল তার পছন্দের ও আস্থার ব্যক্তিদের বিভিন্ন পদে সমাসীন করে তাদের হাতে প্রশাসনের খুঁটিনাটি ছেড়ে দিয়ে নীতিনির্ধারণী বিষয়ে মনোনিবেশ করা। কিছুদিন গেলে দেখি যে অন্য অনেক সচিবের মতো অধিকাংশ নথি তিনি পরে দেখবেন বলে ধরে রাখতেন না। ফাইল খুলে দ্রুত স্বাক্ষর করে নথি নিষ্পত্তি করে দিতেন। তার বুদ্ধিমত্তা এত প্রখর ছিল যে কোন বিষয়গুলো তাকে ভালোভাবে দেখতে হবে, তা তিনি জানতেন এবং সেই নথিগুলো তিনি রেখে যেতে বলতেন।
একদিন একটা নথি আমার হাতে দিয়ে সচিব বললেন, যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় আদেশ ও বিজ্ঞপ্তিগুলো জারি করো। আমার অফিসকক্ষে ফিরে নথি খুলে বিস্ফারিত চোখে দেখি, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের আধুনিকায়নের জন্য তাদের লোকবল সংখ্যা বহুগুণ বাড়িয়ে একটা বিরাট অর্গানোগ্রাম তৈরি করা হয়েছে, যেখানে শুধু পদসংখ্যাই বাড়ানো হয়েছে, তাই-ই নয়, অনেক নতুন নতুন পদও সৃষ্টি করা হয়েছে এবং বিদ্যমান পদের মান উন্নীত করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে মহাপরিচালকের একটি পদ সৃষ্টি করে তাকে সচিবের বেতন স্কেল প্রদান করা হয়েছে, যা তখন শুধু বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা পরিষদের নির্বাহী ভাইস-চেয়ারম্যান ছাড়া বাংলাদেশ সরকারের আর কোনো বিভাগীয় প্রধানের জন্য প্রযোজ্য ছিল না। মোট ৩২ হাজার পদসংবলিত এই অর্গানোগ্রামের শেষ পাতায় তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সবুজ কালিতে লেখা এরকম একটি অনুমোদন ছিল : “নথিতে রক্ষিত প্রস্তাবসমূহ অনুমোদন করা হল। সংস্থাপন এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতির কোন প্রয়োজন নাই।”
কৃষি সম্প্রসারণের সঙ্গে জড়িত পাঁচটি স্বতন্ত্র বিভাগকে একক নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই এই উদ্যোগ। এ ধরণের একীভূতকরণের জন্য ইতিমধ্যে অনেক সমীক্ষা হয়েছে এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্বব্যংকও এ কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করার তাগিদ দিয়ে আসছিল।
প্রস্তাবটির যৌক্তিকতা এবং যথার্থতা নিয়ে কোনো সন্দেহ কিংবা বিতর্কের অবকাশ নেই। সমস্যা হচ্ছে এর প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি নিয়ে। সরকারের রুলস অব বিজনেস অনুযায়ী যেকোনো প্রশাসনিক সংস্কার প্রস্তাব কিংবা অর্গানোগ্রামের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন কিংবা বিয়োজন প্রথমে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় কর্তৃক ব্যাপক পরীক্ষা-নিরোক্ষার পর তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। এদের পরীক্ষা শেষ হলেই কেবল নথি রাষ্ট্রপতির কাছে তার চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়। তবে এই দুটি মন্ত্রণালয় সম্পর্কে আমলাতান্ত্রিক মহলের ধারণা যে, এরা অত্যন্ত রক্ষণশীল এবং বর্তমান যুগের চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য দৃষ্টিভঙ্গির যে প্রসারতা ও কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য যে সাহস দরকার, তা তাদের নেই। এরা দুইকে বাড়িয়ে বড়জোর চার করতে পারে; কিন্তু চারশ করার মতো সাহস এদের নেই। এসব শুনেই হয়তো রাষ্ট্রপতি ওই দুই মন্ত্রণালয়কে বাদ দিয়েই তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন।
রাষ্ট্রপতির আদেশ সত্ত্বেও, আমি জানি, সংস্থাপন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি ছাড়া এ আদেশ জারি করা যাবে না। তা করলে মহাহিসাব রক্ষক এদের বেতন-ভাতা দেবেন না। আমি যুগ্ম সচিব পর্যায় পর্যন্ত চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে আমার সচিবের কাছে ফিরে গিয়ে বললাম, স্যার, সংস্থাপন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি ছাড়া এ বিজ্ঞপ্তি জারি করা যাবে না। নিচের পর্যায়ে কথা বলে ব্যর্থ হয়েছি। আপনি অর্থসচিবের সঙ্গে কথা বলুন। ওবায়দুল্লাহ খান অর্থসচিব গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে কথা বললে তিনি সব কাগজপত্র নিয়ে পরের দিন তার দপ্তরে আমাকে হাজির হতে বললেন। পাকিস্তান অডিট এন্ড একাউন্ট সার্ভিসের অন্যতম সদস্য গোলাম কিবরিয়া তার প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও জটিল বিষয় দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আমলাতান্ত্রিক মহলে বহুল আলোচিত ছিলেন। তিনি খুব দ্রুত বিষয়টি অনুধাবন করতে পারলেন এবং তার সরাসরি হস্তক্ষেপে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনকৃত অর্গানোগ্রামটি ঠিক যেভাবে তিনি অনুমোদন করেছিলেন, সেভাবেই বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হই। দেশের স্বাধীনতাকালে প্রায় ৯০ লাখ হেক্টর জমিতে বাংলাদেশ ৭০ লাখ টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করেছিল। কৃষিযোগ্য সেই জমির পরিমাণ বর্তমানে অনেক হ্রাস পেলেও এখন বাংলাদেশ ৩ কোটি টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করছে। অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে ১৯৮১ সালের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের আধুনিকায়ন কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে॥”
( এ টি এম শামসুল হুদা (সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার) / ফিরে দেখা জীবন ॥ [ প্রথমা প্রকাশন – ফেব্রুয়ারী, ২০১৪ । পৃ: ১৪৬-১৪৭ ] জিয়ার শাসনামলে বর্হিবিশ্বের সাথে বাংলাদেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক অন্যমাত্রা পায়। এ প্রসঙ্গে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ফারুক চৌধুরী লিখেছেন:
‘..বেলজিয়ামের রাজদম্পত্তি ২০ মে ১৯৮১ তিনদিনের সফরে ঢাকা এলেন। নৃপতির সফর সাধারণত আনুষ্ঠানিক হয়। কিন্তু রাজার বিশেষ ইচ্ছায় এবং প্রচেষ্টায় তার সহযাত্রীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলেন বেলজিয়ামের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ক্ষেত্রের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। বেলজিয়াম ক্ষুদ্র দেশ। সেই দেশের সাহায্য-ক্ষমতা সীমিত। তবু সেই সফরকালে বেলজিয়াম বাংলাদেশকে পরবর্তী পাঁচ বছর সাহায্যের একটি অন্ক অঙ্গীকার করলো। অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে স্বাক্ষরিত হলো গোটা দুই চুক্তি।
সফরকালে রাজা আর রানীর জলছত্র কুষ্ঠ হাসপাতাল পরিদর্শন করার কথা আমার মনে আছে। তাঁরা বেশ কিছু সময় কাঁটিয়েছিলেন সেই হাসপাতালের কুষ্ঠ রোগিদের সান্নিধ্যে। বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউট পরিদর্শন করে রাজা অত্যন্ত প্রীত ছিলেন। বলেছিলেন আপনাদের দেশের শ্যামল উর্বরতা আর আধুনিক প্রযুক্তির মিলনে বাংলাদেশ একটি খাদ্য রফতানিকারক দেশ হতে পারে। নৌবিহারে অধিকাংশ সময় তিনি কাঁটিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সমস্যাদি সম্পর্কে আলোচনায়।
রাজা বঁদোয়া আর রানী ফ্যাবিওলা তাঁদের বাংলাদেশ সফর শেষে থাইল্যান্ড ও চীনের পথে ঢাকা ত্যগ করলেন ২৩ মে ১৯৮১ সালে। রাজদম্পত্তি বিদায়ের পরে প্রেসিডেন্ট জিয়া আমাকে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর আমার প্রতি তাঁর সর্বশেষ উক্তি, “আই উইল সি ইউ লেইটার।‘ সেই দেখা আর হলো না। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়ার নির্মম হত্যা ইতি টানলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এক কর্মময় অধ্যায়ের। ঢাকা স্টেডিয়ামে এক বৃষ্টি স্নাত দিনে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের অন্য আরেক কর্মীর সঙ্গে উপচে পড়া মানুষের গায়েবানা জানাযায় যোগ দিলাম। যখন অবশেষে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মরদেহ খুঁজে পাওয়ার পর চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এনে জানাজার জন্য সংসদ ভবনে রাখা হলো, তখন লোকে লোকারন্য সেই এলাকায় পৌছাই ছিলো অসম্ভব। ৩০ মে রাজা বঁদোয়া চীনে বসে পেলেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুসংবাদ। অত্যন্ত দু:খভারাক্রান্ত হৃদয়ে তিনি চীনে তাঁর সহগামী,বেলজিয়ামের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক ও জাপানে সেদেশের বর্তমান রাষ্ট্রদূত ব্যরন প্যাট্রিক নথোম্বকে তাৎক্ষনিক ঢাকা পাঠালেন তাঁর ব্যক্তিগত দুত হিসেবে। তাঁর শোকবানী নিয়ে । প্যাট্রিক নথোম্ব সত্তর দশকের শেষে ঢাকায় বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদুত ছিলেন। আমাদের বহুদিনের পরিচয় বন্ধুত্বের। তার মুখে প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুতে বেলজিয়ামের রাজদম্পত্তির শোকানুভুতির কথা শুনেছি।
ফিরে যেতে হবে কর্মস্থলে ব্রাসেলসে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যায় যে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার মুখোমুখি হব কিভাবে? ইউরোপিয় অর্থনৈতিক কমিশনের বেলজিয়াম,হল্যান্ড আর লুক্সেমবুর্গের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ে, এবং এসব দেশের কুটনৈতিক মহলের প্রশ্নের কী উত্তর দেব? ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের পৈশাচিক হত্যার ছয় বছরের কম সময়ের মধ্যে আরও একজন রাষ্ট্রপতি হত্যায় বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তী অবশ্যই ভূলুণ্ঠিত, কিন্তু তার সন্তোষজনক কারণ ব্যাখা করা সম্ভব নয়। বিদায় নেয়ার সময় ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সাত্তারকে আমি প্রশ্নটি করলাম।তাঁকে বললাম কোন মুখ নিয়ে আমি ব্রাসেলমে আমার কর্মস্থলে ফিরে যাব? তিনি বললেন যে, ভবিষ্যতে অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে, তবে আমি এইটুকু বলতে পারি যে প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যার পর সংবিধান অনুযায়ীই ভাইস প্রেসিডেন্ট তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন এবং সংবিধান প্রদত্ত সময়মীমার মধ্যেই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। আর যা-ই হোক, ব্রাসেলসে ফিরে প্রশ্নবাণে মুখোমুখি হওয়ার জন্য বিশ্বাসযোগ্য অথবা না হোক, একটা উত্তর তো পাওয়া গেল।
কিন্তু ব্রাসেলসে আমি যেন বাংলাদেশ সম্মদ্ধে হতাশার একটি নগরে ফিরে গেলাম। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার সময়ে বাংলাদেশ সন্মদ্ধে যে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছিলো, তা পুরোপুরিই বিলুপ্ত।-(ফারুক চৌধুরী/ জীবনের বালুকা বেলায়/ পৃষ্ঠা ২৯৯- ৩০০১।)
পাচ:
দেশ এখন পা দিয়েছে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে। মহাকালের হিসেবে এই সময়টা হয়তো বড় কোনো সংখ্যা নয়। কিন্তু একটি স্বাধীন দেশের জন্য পঞ্চাশ আবার খুব একটা কম সময়ও নয়। এর চেয়ে কম সময়ে বিশ্বের অনেক জাতি, জ্ঞান বিজ্ঞান উন্নয়নে অনেক অগ্রসর হয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সঠিক এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাবে আমরা এখনো পিছিয়ে আছি অনেক দেশের চেয়ে। তবে প্রেসিডেন্ট জিয়া দেশকে উন্নত ,সমৃদ্ধ আধুনিক রাষ্ট্রগঠনের জন্য যে ধরনের কর্মসূচী এবং যে ধরনের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর আর কোনো সরকারই সেরকম ভিশন নিয়ে এগোনোর কথা ভাবেনি। জিয়া ছিলেন একজন ক্ষনজন্মা নেতা। আজ তিনি বেঁচে থাকলে দেশ নিশ্চই আরো উন্নত আরো সমৃদ্ধ আরো আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত হতো। তার মৃত্যুর পর দৈনিক দেশ অম্লান তাঁর আদর্শ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখে : যে মানুষকে আমরা দেখেছি শাসনের রাশ হাতে নিয়েও নাগরিক অধিকারের পবিত্রতাকে লঙ্ঘন করেননি, দেশকে লক্ষভ্রষ্ট হতে দেননি।জাতীয় স্বকিয়তা, স্বাতন্ত্র,ঐতিহ্যকে জানিয়ে গেছেন, আজ হয়তো তিনি নেই। কিন্তু তাঁর পথ আছে,পথের দিশা আছে,আছে জনগন এবং এক অম্লান আদর্শ। আমাদের তাই পথভ্রষ্ট হওয়া চলবে না। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নির্দেশিত পথই আমাদের পথ।