নিউজ

মুশতাকের রাষ্ট্রীয় হত‍্যাকাণ্ডে উত্তাপ: ১৩ দেশের রাষ্ট্রদূতের বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ

পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদল ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ
২৬ মার্চের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী
‘মুশতাকের মৃত্যু রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড’: ৫১ বিশিষ্ট নাগরিক
কার্টুনিস্ট কিশোরের জামিন লাভ
ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে: ওবায়দুল কাদের

।। সুরমা ডেস্ক ।।
লণ্ডন, ৩ মার্চ – কারাগারে লেখক মুশতাকের মৃত্যু এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। ইতোমধ্যে পুলিশ ও প্রতিবাদকারী ছাত্রজনতার মধ্যে রাজধানী ঢাকায় কয়েক দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। বিএনপিও উক্ত ইস্যুতে সোচ্চার হয়েছে। মুশতাক মৃত্যু, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং দলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি রাষ্ট্রীয় খেতাব কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ডাকা সমাবেশকে ঘিরে পুলিশ ও তাদের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুলিশী তা-বে সমাবেশ পণ্ড হয়ে গেলেও পুলিশের প্রতি মারমুখী হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলতে দেখা যায় তাদের। এছাড়া সাধারণ ছাত্রজনতার প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। ৩ মার্চ, বুধবার বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২৬ মার্চের মধ্যে বাতিলের দাবি জানিয়েছে নাগরিক সমাজ। সমাবেশ ও পদযাত্রা থেকে এই দাবি জানিয়ে বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে দাবী পূরণ না হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অবরোধ করা হবে। তাদের পদযাত্রাও বার বার পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে।

সাপ্তাহিক সুরমার প্রিণ্ট ভার্সন ইমেজ

কারাগারে থাকা অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় শোক ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ওইসিডি ভুক্ত ১৩টি দেশের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতরা। এছাড়া মুশকাকের মৃত্যুকে ‘রাষ্ট্রীয় হত্যাকা-’ হিসেবে মন্তব্য করে এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের অর্ধশতাদিক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এক বিবৃতিতে তারা মুশতাকের মৃত্যুর প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের হামলা, মামলার প্রতিবাদ এবং গ্রেফতারকৃত সবাইকে অবিলম্বে মুক্তির পাশাপাশি ডিজিটাল আইন বাতিলের দাবী জানান। আর বিষয়টিকে সরকার দেখছে রাজনীতি হিসেবে। সরকারের সেতু মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মুশতাকের মৃত্যু নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে বলে মন্তব্য করেছেন।

এদিকে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (আইসিটি) মামলায় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে ছয় মাসের জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। ৩ মার্চ, বুধবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
উল্লেখ্য, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে গত বছর মে মাসে আটক হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারী, বৃহস্পতিবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি মারা যান।

ছয়বারের আবেদনেও জামিন দিলে না মুশতাকের অবশেষে জামিন ছাড়াই মুক্তি, চিরমুক্তি ঘটে। কারাগারেই মারা যান লেখক মুশতাক আহমেদ। তার পরিচিতি ছিল উদ্যোক্তা হিসেবে, লেখক হিসেবে। নিজস্ব পরিমণ্ডলে তিনি যেভাবেই পরিচিত থাকুন না কেন তাঁর পরিচয় প্রকাশ পায় ‘রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে গ্রেপ্তারের পর। এই অভিযোগ করেছিল র‌্যাব। মুশতাকের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি, অভিযোগের পর্যায়েই থেকে গিয়েছিল। তার আগেই মুশতাক মারা গেছেন।

২৯৭ দিনের কারাবাসের এই সময়ে একই অভিযোগে গ্রেপ্তার অন্যেরা জামিন পেলেও মুশতাককে জামিন দেননি আদালত। একে একে ছয়-ছয়বার জামিন চেয়েছেন তার আইনজীবীরা, কিন্তু আদালত সেই আবেদন গ্রহণ করেননি। সর্বশেষ গত ২৪ ফেব্রুয়ারী, বুধবার মুশতাকের অসুস্থতা সত্ত্বেও জামিনের আবেদন বিচারকের মানবিকতাকে স্পর্শ করতে পারেনি, তাই সেদিনও আগের মতো জামিন নামঞ্জুর করেন আদালত।

২৬ মার্চের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবী:
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২৬ মার্চের মধ্যে বাতিলের দাবি জানিয়েছে নাগরিক সমাজ। ৩ মার্চ, বুধবার এক সমাবেশ ও পদযাত্রা থেকে এই দাবি জানিয়ে বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে দাবী পূরণ না হলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অবরোধ করা হবে।
কারাগাওে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর বিচার এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবীতে বুধবার বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন এবং শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্য দেওয়ার কথা থাকলেও তাঁরা উপস্থিত হতে পারেননি। তাদের দেওয়া একটি লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনানো হয়। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, এই সরকারের শক্তি আছে, অনেক ক্ষমতা আছে। পুলিশ বাহিনী তাদের হাতে, আমলারা হাতে। তার চেয়েও বেশী শক্তি হলো তারা নির্লজ্জ। কেউ হাঁচি দিলেও তারা থামাতে চায়। এই নিপীড়ক সরকার আছে বলেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আছে। এটি বাতিলের দাবিতে প্রকাশ্যে সবাইকে রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় নেই।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, এই আইনটাই (ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন) স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী। সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করতে হলে এই আইন বাতিল করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল বিশেষজ্ঞদের নিয়ে নতুন আইন করতে হবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন নাগরিক সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের দিকে পদযাত্রা করে। সম্মুখভাগে হুইলচেয়ারে ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন সংগঠন নাগরিক সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের দিকে পদযাত্রা করে।
সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা শুরু হয়। মিছিলটি প্রথমে প্রেসক্লাবসংলগ্ন কদম ফোয়ারার সামনে পুলিশের দেওয়া ব্যারিকেডে বাধা পড়ে। বাধা উপেক্ষা করে মিছিলটি মৎস্য ভবনের সামনে এলে আবারও ব্যারিকেডে পড়ে। সেখান থেকে শাহবাগ এলাকায় এলে সেখানেও ব্যারিকেডের মুখে পড়ে। তবে এসব ব্যারিকেড পেরিয়ে মিছিলটি সামনে এগিয়ে যায়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে এলে সেখানে শক্ত ব্যারিকেডে আটকা পড়ে মিছিলটি।
পরে সেখানে বক্তব্য দেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, ২৬ মার্চের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জুনায়েদ সাকী বলেন, এই সময়ের মধ্যে বাতিল করা না হলে পুলিশের ব্যারিকেড তো ভাঙা হবেই, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অবরোধ করা হবে।

মুশতাকের মৃত্যু রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড: ৫১ বিশিষ্ট নাগরিক
কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের মামলা, হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৫১ বিশিষ্ট নাগরিক। গ্রেপ্তারকৃতদের অবিলম্বে মুক্তি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলসহ পাঁচ দফা দাবী জানিয়েছেন তারা। রোববার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, গত ২৫ ফেব্রুয়ারী নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তারকৃত লেখক মুশতাক আহমেদ দীর্ঘ ২৯৫ দিন কারাবাসের পর অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কারাগারে আটক অবস্থায় লেখক মুশতাকের এই মৃত্যুকে আমরা রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড বলে মনে করি।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সভা-সামাবেশ ও আন্দোলন চলাকালীন সময়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় সংগঠনগুলোর মশাল মিছিলে পুলিশ ন্যাক্কারজনকভাবে আক্রমণ চালায়। এসময় কমপক্ষে ৩০ জন আন্দোলনরত অধিকার কর্মীকে আহত এবং সাত জন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপরদিকে, খুলনার পাটকল শ্রমিক নেতা ও শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা ঐক্য পরিষদের সমন্বয়ক রুহুল আমিন এই আন্দোলনের পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ কর্মসুচি ঘোষণা করলে খুলনার ডিবি পুলিশের একটি দল রাতে তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। গত ২৭ ফেব্রুয়ারী রুহুল আমিনের নামে অন্যায্য, অসমীচীন ও নিবর্তনমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করা হয় এবং খুলনা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাকে দুই দিনের রিমাণ্ড দেন।

এছাড়া, ঢাকার শাহবাগে মশাল মিছিল থেকে আটককৃত ৭ শিক্ষার্থীর নামে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে একটি নিবর্তনমূলক মামলা শাহবাগ থানায় করা হয় এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১০০-১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই ঘটনায় আমরা সাধারণ নাগরিকবৃন্দ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। আমরা এই মামলা হামলার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বিবৃতিদাতারা ঔপনিবেশিক শাসন আমলের অপরাধ আইন দ-বিধি-১৮৬০ ও নিপীড়নমূলক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো দানবীয় আইন ব্যবহার করবার পরিপ্রেক্ষিতে, নাগরিক সমাজ প্রতিনিধিরা তীব্র প্রতিবাদের সাথে পাঁচটি দাবী পেশ করেছেন।

বিবৃতিতে সই করেন— জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ, মানুষের জন্য ফাউণ্ডেশনের প্রধান নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, লেখক রেহনুমা আহমেদ, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) এর প্রধান নির্বাহী ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, শিক্ষক ও অধিকার কর্মী সি আর আবরার, সামাজিক কর্মী, নারীবাদী এবং পরিবেশবাদী খুশি কবীর, নারী অধিকার আন্দোলন কর্মী ফরিদা আক্তার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মির্জা তাসলিমা সুলতানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌভিক রেজা, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আদিলুর রহমান খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, অধিকারকর্মী নাসিরুদ্দিন এলান, মানবাধিবার কর্মী নুর খান প্রমুখ।

পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদল ও বিএনপি নেতা-কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ:
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দী অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর প্রতিবাদ ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের খেতাব বাতিলের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশ প- হয়ে গেছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গত ২৮ ফেব্রুয়ারী, রোববার সমাবেশটি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সমাবেশ শুরুর আগেই পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদল ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ বাধে। এতে বিক্ষোভ সমাবেশটি প- হয়ে যায়।
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ওইদিন সকাল ১০টার দিকে ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাব ও তার আশপাশের এলাকায় জড়ো হতে থাকেন। বেলা ১১টার পর নেতা-কর্মীদের একটি অংশ প্রেসক্লাবের ভেতর থেকে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করে। তাদের বাধা দেয় পুলিশ। একপর্যায়ে ছাত্রদলের কয়েকজন নেতা-কর্মী বেরিয়ে সড়কে বসে পড়েন। এ সময় পুলিশ তাদের লাঠিপেটা করে তুলে দেয়। তারপরই এলাকায় উপস্থিত ছাত্রদল ও বিএনপির নেতা-কর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল ছোড়েন। আশপাশে ভাঙচুরও করেন। তাঁদের ধাওয়া করে পুলিশ। যাকে সামনে পায়, তাকে লাঠিপেটা করে। বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ ফাঁকা গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশের ধাওয়ার মুখে বিএনপি-ছাত্রদলের কিছু নেতা-কর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের ভেতরে ঢুকে পড়েন। সেখানে ঢুকে নেতা-কর্মীদের লাঠিপেটা করে পুলিশ। পুলিশের ধাওয়া খেয়ে কিছু কর্মী বিএমএ ভবনের কোনায় অবস্থান নেন। তারা সেখান থেকে স্লোগান দিতে থাকেন। পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় কয়েকজন আহত হন। তাঁদের মধ্যে ছাত্রদল-বিএনপির নেতা-কর্মী, পুলিশ ও সাংবাদিক রয়েছেন। ছাত্রদলের এই সমাবেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আসার কথা ছিল। এ ছাড়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। ছাত্রদলের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ফজলুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ইশবাল হোসেন, ঢাকা দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক এম এ গাফফারসহ সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভ সমাবেশ শুরুর আগেই তা পণ্ড হয়ে যায়।

১৩ দেশের রাষ্ট্রদূতের বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ:
কারাগারে থাকা অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় শোক ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ওইসিডি ভুক্ত ১৩টি দেশের ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূতরা। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে গত বছর মে মাসে আটক হওয়া লেখক মুশতাক আহমেদ কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। গত ২৫ ফেব্রুয়ারী, বৃহস্পতিবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পর হাসপাতালে নেয়া হলে তিনি মারা যান।
এক যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রসহহ ১৩ দেশের রাষ্ট্রদূতরা কী পরিস্থিতিতে মুশতাক আহমেদের মৃত্যু ঘটেছে Ñ তার দ্রুত, স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, নেদারল্যাণ্ডস, ডেনমার্ক, নরওয়ে, স্পেন, সুইডেন, সুইৎজারল্যা- ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতবৃন্দ, এবং যুক্তরাজ্য ও ক্যানাডার হাইকমিশনাররা। মুশতাক আহমেদের বিরুদ্ধে ফেইসবুকে একটি বিদ্রুপাত্মক কার্টুনের ক্যাপশন দেয়া এবং সরকারের বিরুদ্ধে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে মামলা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সরকার বলছে, মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর কারণ যাই হোক Ñ তা তদন্ত করে দেখা হবে। রাষ্ট্রদূতরা বিবৃতিতে আরো বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টের ধারাসমূহ এবং তার বাস্তবায়ন, ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনসমূহের সাথে এর সঙ্গতিবিধান নিয়ে তাদেও যে বৃহত্তর উদ্বেগগুলো রয়েছে— তা নিয়ে তারা বাংলাদেশের সরকারের সাথে কাজ করে যাবেন। এছাড়া, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচও এক বিবৃতিতে মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর স্বচ্ছ ও স্বাধীন তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে।

মুশতাকের মৃত্যু নিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা চলছে: ওবায়দুল কাদের
কারাগারে লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যু নিয়ে একটি কুচক্রী মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেছেন, লেখক মুশতাক আহমেদের কারাগারে মৃত্যুর বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। এ বিষয়ে ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্তের মাধ্যমে লেখক মুশতাকের মৃত্যুর রহস্য উন্মোচিত হবে। এরপরও বিষয়টি নিয়ে একটি কুচক্রী মহল ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) আয়োজিত সেবা সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এই মন্তব্য করেন।

কার্টুনিস্ট কিশোরের জামিন:
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (আইসিটি) মামলায় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোরকে ছয় মাসের জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট। ৩ মার্চ, বুধবার বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন।
এরআগে, ২০২০ সালের ৫ মে র‌্যাব-৩, সিপিসি-১ এর ওয়ারেন্ট অফিসার মো. আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে মিনহাজসহ ১১ জনের নামে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা করেন। এছাড়াও মামলায় অজ্ঞাত আরও ৫/৬ জনকে আসামি করা হয়। ওই রাতে করোনাভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে কার্টুনিস্ট কবির কিশোর ও লেখম মুশতাক আহমেদকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৩। পরে রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা র‌্যাবের মামলায় তাদের গ্রেফতার দেখানো হয়। গত ১৩ জানুয়ারী এ মামলায় কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, রাষ্ট্রচিন্তার সদস্য দিদারুল ভূঁইয়া ও লেখক মুশতাক আহমেদকে (কারাগারে সদ্য প্রয়াত) অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করে রমনা থানা পুলিশ। যেখানে জুলকারনাইন খান ওরফে সামিসহ অন্য আট জনকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়।

অব্যাহতির সুপারিশপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক মিনহাজ মান্নান, জার্মান প্রবাসী ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিন, নেত্র নিউজের সম্পাদক ও সুইডেন প্রবাসী তাসনিম খলিল, হাঙ্গেরি প্রবাসী জুলকারনাইন শায়ের খান ওরফে সামি, আশিক ইমরান, স্বপন ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক সাহেদ আলম ও ফিলিপ শুমাখার।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close