নিউজ

লকডাউন শিথিলের রোডম্যাপ ঘোষণা: ব্রিটিশ জনজীবনে আশার আলো

হসপিটালিটি খাতে চাঙ্গাভাব, সামার হলিডে বুকিংয়ের হিড়িক
কাজ করছে ভ্যাকসিন, ১ম ডোজের পর হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি ৯৪% হ্রাস
স্কটল্যাণ্ডে ২৬ এপ্রিল থেকে খুলছে সবকিছু

।। সুরমা প্রতিবেদন ।।
লণ্ডন, ২৭ ফেব্রুয়ারী – পর্যায়ক্রমে লকডাউন শিথিলের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তবে ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী সবকিছু স্বাভাবিক হতে আরো প্রায় ৪/৫ মাস সময় লেগে যাবে। গত ২২ ফেব্রুয়ারী, সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় টেন ডাউনিং স্ট্রিটের সংবাদ সম্মেলনে লকডাউন শিথিলের রোডম্যাপ ঘোষণা করেন বরিস জনসন। বহুল প্রত্যাশিত তাঁর এই ঘোষণার পর ব্রিটিশ জনজীবনে আশার আলো ফুটতে দেখা যাচ্ছে। হসপিটালিটি খাতে ইতোমধ্যে চাঙ্গা ভাবের সূচনা লক্ষ্য করা গেছে। দীর্ঘ লকডাউনে থেকে হাঁপিয়ে ওঠা ব্রিটিশরা সামার হলিডে বুকিংয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। হলিডে পরিচালনাকারী সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্যানুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরপরই প্রায় রাতারাতি ৬শ’ শতাংশ হলিডে বুকিং বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে, বিশ্বের প্রথম ভ্যাকসিনেশন শুরু করা দেশ বৃটেনে ভ্যাকসিনে কাজ হচ্ছে বলেও মনে করছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজের পর হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি ৯৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে বলেও জানা গেছে।
চার ধাপে বিভক্ত লকডাউন শিথিলের প্রথম ধাপে স্কুল খুলে দেওয়ার বিষয় রয়েছে। অতঃপর পর্যায়ক্রমে দোকানপাট, রেস্টুরেন্ট-পাব ও হসপিটালিটি খাত খুলে দেওয়াসহ সর্বশেষ চতুর্থ ধাপ— ২১ জুন থেকে সামাজিকতার ক্ষেত্রে সব ধরনের আইনী বাধ্যবাধকতা তুলে নেওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। তবে চতুর্থ ধাপে যাবার আগে মিনিস্টাররা বিষয়টি ভালো করে রিভিউ করে দেখবেন যে, তা করা যায় কী না। সব ঠিক থাকলে তখন থেকে ওয়েডিং ও ফিউনারেল থেকেও সবধরনের বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হবে।
এদিকে, স্কটিশ ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজানও লকডাউন শিথিলের তারিখ ঘোষণা করেছেন। ঘোষণা অনুযায়ী স্কটল্যাণ্ডে ২৬ এপ্রিল থেকে সবকিছু খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে ওয়েলস সরকারের পক্ষ থেকে এখনো লকডাউন শিথিলের কোনো তারিখ ঘোষণা করা হয়নি।
উল্লেখ্য, গতবছর ২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়ার করোনাভাইরাসের মারাত্মক প্রাদর্ভাবে বৃটেন এযাবত তিন দফায় লকডাউনের শিকার হয়। সর্বশেষ চলতি বছর ২০২১ সালের ৫ জানুয়ারী মধ্যরাত থেকে ৬ সপ্তাহের জন্য তৃতীয়বারের মতো ইংল্যা-ে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করা হয়।

পর্যায়ক্রমিক রোডম্যাপ:
১ম ধাপ: ৮ মার্চ ও ২৯ মার্চ। ৮ মার্চ থেকে সব স্কুল খুলবে। একই সঙ্গে ঘরের বাইরে ভিন্ন পরিবারের দুজন দেখা স্বাক্ষাত করতে পারবে। ২৯ মার্চ থেকে রুলস অব সিক্স চালু হবে। অর্থাৎ দুই পরিবারের সদস্যরা আউটডোর মিলিত হতে পারবেন। একই সঙ্গে আউটডোর খেলাধুলার ফ্যাসিলিটি খুলে দেওয়া যাবে।
দ্বিতীয় ধাপ: ১২ এপ্রিল থেকে ইংল্যাণ্ডে দোকানপাট, সেলুন, জিম, জু তথা চিরিয়াখানা, থীম পার্ক এবং আউটডোর হসপিটালিটি সেক্টর খুলে দেওয়া হবে।
তৃতীয় ধাপ: ১৭ মে থেকে সামাজিকতার ক্ষেত্রে বেশীরভাগ বিধি নিষেধ তুলে নেওয়া হবে। স্বাভাবিক মেলামেশার সুযোগ আরো বাড়িয়ে দেওয়া হবে।
চতুর্থ ধাপ: ২১ জুন থেকে সামাজিকতার ক্ষেত্রে তুলে নেওয়া হবে সব ধরনের আইনী বাধ্যবাধকতা।

হসপিটালিটি খাতে চাঙ্গাভাব, সামার হলিডে বুকিংয়ের হিড়িক:
লকডাউন শিথিলের ঘোষণার হসপিটালিটি খাতে চাঙ্গাভাব লক্ষ্য করা গেছে। হলিডে ফার্ম এবং এয়রলাইন্স প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে আর্জাতিক ভ্রমণের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সংবাদের পর বুকিং বেড়ে গেছে। জুলাই মাসে গ্রীস, সাইপ্রাস, মেক্সিকো, তুরস্কের মতো দেশগুলোর জন্য বুকিং বন্যা বয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বৃটেনের সবচেয়ে বড় হলিডে ব্যাবস্থাপনা ফার্ম টুই। তাদের ওয়েবসাইটে ট্রাফিক ১০০% বেড়ে গেছে। ২২ ফেব্রুয়ারী, সোমবার বিকালেই প্রধানমন্ত্রীর লকডাউন শিথিলের ঘোষণার পর এটি বেড়ে যায়। বরিস জনসন সোমবার পর্যায়ক্রমিক ঘোষণায় বলেন, বৈশ্বিক ভ্রমণ টাস্কফোর্স ১২ এপ্রিলের মধ্যে একটি প্রতিবেদন পেশ করবে কিভাবে আন্তর্জাতিক ভ্রমণে ফিরে যাওয়া যায়। তারপর আন্তর্জাতিক ভ্রমণের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে, কিন্তু তা ১৭ মে’র আগে নয় বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
বৃটেনভিত্তিক হলিডে ফার্ম হোসিজনস হলিডে ডটকম মালিক বলেছেন, হলিডে বুকিং রেকর্ড ১০,০০০ ছাড়িয়াছে এক রাতেই। হোসিজনস প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সাইমন আলথাম বলেন, গত বছর একই ধরণের ঘোষণার পর প্রতি ১১ সেকে-ে বুকিং সর্বোচ্চ পর্যায়ে দেখা গেছে , কিন্তু এবার চাহিদা প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশী এবং এরই মধ্যে সব রেকর্ড ভেঙ্গেছে।
বিমান সংস্থাও একই তথ্য জানিয়ছে। ইজিজেট বিমান জানিয়েছে ফ্লাইট বুকিং ৩৩৭% বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আলিকান্তে, মালাগা, পালমো, ফারো এবং ক্রিটের মতো স্থানের জন্য হলিডে বুকিং ৬৩০% বেড়েছে।

কাজ করছে ভ্যাকসিন, প্রথম ডোজের পর হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি ৯৪% হ্রাস:
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ভ্যাকসিন কাজ করছে বলে ইতোমধ্যে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) টিকার কার্যকারিতা স্পষ্ট হচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত টিকার প্রথম ডোজ দেওয়ার চার সপ্তাহের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি কমে ৯৪ শতাংশ। ফাইজার ও বায়োএনটেকের উদ্ভাবিত টিকা এই ঝুঁকি কমায় ৮৫ শতাংশ। এই দুই টিকাই গুরুতর সংক্রমণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর।
এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। গত সোমবার এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে স্কটল্যা-ের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা। গবেষণায় পুরো স্কটল্যাণ্ডের ৫৪ লাখ জনসংখ্যার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এতে দেখা গেছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকার প্রথম ডোজ দেওয়ার চার সপ্তাহের মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি যথাক্রমে ৯৪ ও ৮৫ শতাংশ কমিয়েছে।
এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউশার ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আজিজ শেখ ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, গবেষণায় যে ফল পাওয়া গেছে তা অত্যন্ত উৎসাহব্যঞ্জক এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার দারুণ কারণ হতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, তিনি যে ফলাফলের কথা বলছেন, তা প্রাথমিক তথ্যনির্ভর। তবে আশার কথাও শুনিয়ে তিনি বলেছেন, আমি অত্যন্ত উৎসাহ পেয়েছি। টিকা যে কোভিড-১৯ সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দিতে পারে, এর যাবতীয় প্রমাণ এখন আমাদের কাছে আছে।
আজিজ শেখ বলেন, অন্য দেশগুলো এখন একই রকম দুই টিকা ও একই রকম কৌশল গ্রহণ করবে বলে আশা করছেন।
স্কটল্যাণ্ডে টিকার কার্যকারিতা নিয়ে গবেষণার জন্য গত ৮ ডিসেম্বও থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ সময়ের মধ্যে দেশটিতে ১১ লাখ ৪ হাজার মানুষকে টিকা প্রয়োগ করা হয়। এর মধ্যে স্কটল্যা-ের ২১ শতাংশ জনগণ টিকার প্রথম ডোজ নেন। এতে দেখা যায়, সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ৮০ বছরের বেশী বয়সীদেও ক্ষেত্রে টিকা নেওয়ার চার সপ্তাহ পরে হাসপাতালে ভর্তি ৮১ শতাংশ কমে গেছে। এক্ষেত্রে অবশ্য দুটি টিকার ফলাফলই একত্র করে হিসাব ধরা হয়েছে।
স্কটল্যাণ্ডের জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা জিম ম্যাকমেনামিন বলেন, গবেষণায় যে ফল পাওয়া গেছে, তা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমরা এখন টিকা থেকে প্রত্যাশার পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেতে শুরু করেছি।
উল্লেখ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ পর্যন্ত তিনটি টিকার অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যে সবার আগে ফাইজারের টিকার অনুমোদন দেওয়া হয়। সর্বশেষ অনুমোদন পেয়েছে অক্সফোর্ডের টিকা। অনুমোদন পাওয়া অন্যটি হলো মার্কিন কোম্পানি মডার্নার উদ্ভাবিত করোনার টিকা।

স্কটল্যাণ্ডে ২৬ এপ্রিল থেকে খুলছে সবকিছু:
স্কটল্যা- সরকারও লকডাউন থেকে বের হওয়ার ‘সতর্ক’ পথ উন্মোচনের ঘোষণা দিয়েছে। দোকান, বার, রেস্টুরেন্ট, জিম এবং হেয়ারড্রেসারসহ স্কটল্যাণ্ডের অর্থনীতির পুনরায় খোলার বিষয়টি ২৬ এপ্রিল থেকে পুনরায় খোলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন স্কটিশ ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজন। তিনি বলেন, আশা করা হয়েছিলো যে ৫ এপ্রিল দেশটির ‘স্টে এট হোম’ বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা যেতে পারে। ১৫ মার্চ থেকে দুই পরিবারের চারজনকে বাইরে বাইরে দেখা করতে দেওয়া হবে। সমস্ত প্রাইমারি স্কুল ছাত্র এবং এস৪ থেকে এস৬ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা সেই তারিখ থেকে স্কুলে ফিরে আসতে পারে। তবে সেকে-ারি স্কুলের প্রথম তিন বছরে শিক্ষার্থীরা ইস্টার ছুটির পরেও ফিরে আসার সম্ভাবনা কম। স্টারজেন বলেন, স্কটিশ সরকারের কৌশলগত কাঠামোতে এই পর্যায়ে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে সতর্কতা’ অবলম্বন করা হচ্ছে।
তবে আসন্ন সপ্তাহগুলিতে, যদি ডেইটা অনুমতি দেয় এবং ইতিবাচক প্রবণতা অব্যাহত থাকলে আমরা বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার বিষয়টি ত্বরান্বিত করার চেষ্টা করব বলে উল্লেখ করেন তিনি।
স্কটিশ বিরোধী দলগুলি বলেছে যে ফার্স্ট মিনিস্টারের বিবৃটিটি প্রত্যাশার চেয়েও কম এবং এর ‘চূড়ান্ত লক্ষ্য’ সম্পর্কে স্পষ্টতার অভাব রয়েছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী নেতারা বিষয়টি সম্পর্কে আরও বিশদ বর্ণনার আহ্বান জানিয়েছেন।

গত ২২ ফেব্রুয়ারী, সোমবার, প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ঘোষণা করেন যে ইংল্যাণ্ডের দোকানপাট, হেয়ারড্রেসার, জিম এবং আউটডোর হসপিটালিটি ১২ এপ্রিল পুনরায় চালু হতে পারে। লকডাউনটি সহজ করার জন্য চার ধাপের পদক্ষেপের পরিকল্পনার আওতায় কঠোর শর্ত মেনে চললে ২১ জুনের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের সমস্ত আইনি সীমা উত্তোলন করা যেতে পারে।
এক্ষেত্রে মিসেস স্টারজেন বলেছেন যে, এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ থেকে স্কটল্যাণ্ডের লক্ষ্য ছিল পুরো স্তরের নিষেধাজ্ঞা এক স্তর ব্যবস্থায় পুরোপুরি ফিরিয়ে নেওয়া।

Sheikhsbay

Related Articles

Back to top button
Close
Close