মুক্তচিন্তা

ড. কে এম মালিক: জাতীয়তাবাদের এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর

।। মোস্তফা সালেহ লিটন ।।

লেখক: সাংবাদিক ও সংবাদ বিশ্লেষক।

সৃষ্টিকর্তার ডাকে সারা দিয়ে নশ্বর পৃথিবী থেকে একদিন সবাইকে চলে যেতে হবে। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর মাপকাঠী নির্ণয় করা মানবজাতির পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। তাই কিছু কিছু মৃত্যু তার নিজস্ব গণ্ডির বাহিরেও অন্যান্য মানুষকে ভীষণ কষ্ট দেয়। এমন মৃত্যুকে মেনে নেয়াটা সত্যিই কঠিন।

ড. খলিফা আব্দুল মালিক। যিনি ড. কেএম আব্দুল মালিক নামে সবার কাছে পরিচিত। একজন বড় ভাই। একজন শিক্ষক। একজন ব্যক্তিত্যসম্পন্ন সর্বজন স্বীকৃত সাদা মনের মানুষ। যার মৃত্যু আমাদেরকে কাঁদিয়েছে। যার মৃত্যুতে তাঁর প্রিয় শহর কার্ডিফ ছিলো মেঘে ঢাকা কালো অন্ধকার। এই শহরের প্রিয় মানুষটির বিদায়ে সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে যেনো শোকের বার্তা দিচ্ছিল। এইতো মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো ফোনে যখন কথা হয়েছিলো তখন কতো আদরের সুরে বলেছিলেন “করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই কার্ডিফে আসবো।” আমাকে না দেখে যাবেন না। না, কখনো তিনি আমাকে না দেখে যাননি। গতবারও যখন এসেছিলেন সন্ধ্যার পর কাস্তুরী রেষ্টুরেন্টে বসে কয়েক ঘন্টা যে কিভাবে আলাপচারীতায় কেটে গেলো টেরই পাইনি। এমন মধুমাখা সর্স্পকই ছিলো মালিক ভাইয়ের সাথে। স্নেহ ভালোবাসার কোনো কমতি ছিলো। একেবারে নিখাঁদ ছিলো সেই সর্স্পক।

মালিক ভাই যে এভাবে আমাদেরকে ছেড়ে চল যাবেন তা কল্পনায়ও ভাবতে পারেনি। কত আশা কতো স্বপ্ন কতো পরিকল্পনা যে এখনো বাকী ছিলো? দারুণ আশাহত হয়েছি। তিনি আপাদামস্তক জাতীয়বাদের একজন খাঁটি মানুষ ছিলেন । সত্যিই আমরা জাতীয়তাবাদের একজন বিশ্বস্থ দেশপ্রেমিককে হারালাম। জাতীয়তাবাদের আদর্শে বিশ্বাসী অসংখ্য নেতা-কর্মীরা একজন অভিবাবককে হারালাম। জানিনা এই বিলেতে মালিক ভাইয়ের শূন্যস্থান পূরণ হবে কিনা? তবে তার রেখে যাওয়া গণতন্ত্রহীন বাংলাদেশ ঠিকই একদিন আলোর মুখ দেখবে।

আজ মালিক ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে হবে এমনটা কখনো ভাবিনি কিন্তু নিয়তি এমনটাই রূঢ় বাস্তবিক যেখানে কারো জীবনের কোনো ঘটনা প্রবাহের দিন ক্ষণ তারিখ নির্ধারিত থাকে না। স্বাধীন বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যখন বর্বর হায়েনার যাতাকলে পিষ্ট, গণতন্ত্র যেখানে পুলিশের বুটের নিচে পিষ্ট, বিরোধী মত দমনে সরকারী বাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন, গুম খুনের অভয়ারণ্যে যখন পরিণত হয়েছে গোটা দেশ তখন মালিক ভাইয়ের মতো একজন দেশপ্রেমিকের কন্ঠস্বর এবং লিখনি ছিলো বুন্দুকের গুলীর চাইতেও শক্তিশালী। প্রতিবাদী কন্ঠের এক মহীরূহ
ব্যক্তি ছিলেন ড. মালিক।

প্রায় দুই যুগের উপরে এই মহান ব্যক্তিটিকে একবারে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিলো আমার। একসাথে অনেক কাজ করেছি সময়ে অসময়ে। উনার কাছ থেকে সমসাময়ীক রাজনীতি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক কিছুই আমার জানার ও বুঝার সুযোগ হয়েছিলো। জ্ঞান-গরীমায় সমৃদ্ধ এই মানুষটি ব্যক্তি জীবনে ছিলেন একবারে সাদা মাটা একজন মানুষ। অহংবোধ কখনো তাকে প্রকাশ করতে দেখিনি। নিরহংকার এই মানুষটি চলনে বলনে কখনো কাউকে মনে কষ্ট দিতেও দেখিনি। স্মৃতির মানষপটে আজ বার বার মালিক ভাইয়ের কথাই মনে পড়ছে।

খুব সম্ভবত ৯৬সালে হবে। আমি তখন কার্ডিফ শহর থেকে প্রায় ১০মাইল দুরবর্তী একটি টেইকওয়েতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ করে দেখি সেখানে উপস্থিত কার্ডিফের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক একাউনটেন্ট ফারুক ভাই। সাথে এসেছেন মালিক ভাই। উনার সাথে ঐদিনই ফারুক ভাই আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন। উনারা কার্ডিফের মিউজিয়াম হলে প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী মান্নাদের গানের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সহযোগীতার কথা বলতে এসেছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর মালিক ভাই বললেন অনুষ্ঠানের ঝামেলা শেষ হলেই আমরা একসাথে বসব। প্রথম পরিচয়েই উনাকে আমার বেশ আপন আপন মনে হয়েছিল। সেই যে পথ চলা শুরু হলো, অন্তহীন সেই পথটির পরিসমাপ্তি হলো গত ১৯ শে ফেব্রুয়ারী ২০২১ এ। কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পাশাপাশি স্থানীয় কমিউনিটির জীবন মান-উন্নয়নে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।

বিশ্বদ্যিালয়ে শিক্ষকতা কালীন সময় তিনি দেশ থেকে আসা অসংখ্য ছাত্রছাত্রীকে বিভিন্নভাবে সহযোগীতা করেছেন। কার্ডিফে তিনিসহ আরো কয়েকজন কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব মিলে তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ এডুকেশনাল কালচারাল সোসাইটী গঠন করেন এবং আফটার স্কুল হেল্পের মাধ্যমে স্থানীয় জিসিএসই ও এ লেভেলের ছাত্রছাত্রীদেরকে কোচিং দেয়ার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশ এসাসিয়েশনের একজন সাধারণ সদস্য হিসাবে তিনি এসোসিয়েশনকে সর্বাত্মক সহযোগীতা করতেন। ৯৬ সালে আওয়ামী দুঃশাসনের প্রতিবাদে তিনি ছিলেন একজন বলিষ্ট কন্ঠস্বর। সেই সময়ের ভয়াবহ কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৯৭ সালে মরহুম প্রফেসর এমাজ
উদ্দীন স্যারের সংগঠন শতনাগরিক যুক্তরাজ্য কমিটি গঠন করে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। মহান এই ব্যক্তির সাথে এই কমিটির সাধারণ সস্পাদকের দায়িত্ব পালন করায় আজও নিজেকে গর্বিত মনে হয়। কঠোর পরিশ্রমী এই মানুষটির সাথে অসংখ্য সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিলো। ওয়েলস বিএনপি ও অন্যান্য সংগঠনের বিভিন্ন সভাগুলোতে তিনি সব সময় বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন এবং তার ভাষায় এটাকে তিনি অখ- স্বাধীনতা হিসাবে উল্লেখ করতেন এবং এর যথাযথ কারণও ব্যখ্যা করতেন।

সত্যিই মালিক! ভাই আপনি যেই স্বাধীনতার কথা বলতেন সেই স্বাধীনতা এখনো সাধারণ জনগণ পায়নি। আপনার এই অখ- স্বাধীনতার সঠিক মর্মার্থ এখন জনগণ হারে হারে টের পাচ্ছে। কার্ডিফ থেকে ল-নে মুভ হয়েছেন হাতেগোনা কয়েক বছর হবে কিন্তু উনার মন প্রাণ সবকিছুই যেনো পড়ে থাকতো উনার প্রিয় শহর কার্ডিফেই। ফোন করে এখানকার পরিচিতজনদের খোঁজ নিতেন প্রায়ই। উনার মৃত্যুর মাস খানেক আগেও অনেকক্ষন ফোনে আলাপ হয়েছে। দেশের রাজনীতির যে কোনো দুঃসংবাদ পেলেই তিনি আমাকে ফোন করে বলতেন সভা করে প্রতিবাদ করার জন্য। এতটাই বিচলিত থাকতেন মাঝে মাঝে বলতেন এই স্বৈরশাসকের পতন দেখে যেতে পারবো কিনা জানিনা।
প্রায় সময়ই ফোনে আলাপ করার সময় ভাবী পাশে থাকতেন। তিনিও আমার কথায় উত্তর দিয়ে বলতেন তোমার ভাইকে বলো — এসব লিখে টিকে হাসিনাকে সরানো যাবে না। বিএনপি নেতা-কর্মীরা রাস্তায় না নামলে কিছুই হবে না। মালিক ভাই শুনতেন এবং হাসতেন। না বললেই নয় যে, মালিক ভাইয়ের রাজনীতির ও লিখালিখির সাথে ভাবীও যেনো আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে আছেন। তিনিও জাতীয়বাদের একজন বলিষ্ট সহযোগী হিসাবে সব সময় পাশে থেকে ভাইকে উৎসাহ দিয়ে যেতেন। উনি হাসপাতালে যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে অনেকক্ষণ আলাপ হলো। তিনিই আমাকে ফোন দিয়ে কার্ডিফে উনার পরিচিত বেশ কয়েকজনের করোনা আক্রান্তের খবরাখবর নিলেন। আমাকেও সাবধানে থাকতে বললেন।

নিয়তি কতটা নিষ্টুর! শেষবারের মতো সবার খবর নিয়ে তিনিই করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাদে ছেড়ে চলে গেলেন। ঐদিনই তিনি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে উনার বই প্রকাশনার কথা বললেন। আমাকে বললেন এখনতো আমার কাছে বইটির আর কোনো কপি নেই যদি সম্ভব হয় আমাজন থেকে যেনো সংগ্রহ করি। মালিক ভাই আপনি যে কতো বড় মনের মানুষ তা এভাবে আমি হয়তো ঘন্টার পর ঘন্টা লিখেও বুঝাতে পারবো না।

মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপস্থিতিতে একটি বিশাল সভা হচ্ছিল ল-নে। এই সভায় মালিক ভাই বিশেষ অতিথির বক্তব্য দিচ্ছিলেন। আমিসহ কার্ডিফ বিএনপির নেতৃবৃন্দ সেই সভায় উপস্থিত হয়ে শেষের সারিতে বসার সুযোগ হয়েছিলো। হঠাৎ করে মালিকে ভাইয়ের চোখ পড়ে আমাদের দিকে সাথে সাথে কোনকিছুর তোয়াক্কা না করেই এই ভরা মজলিশে আমাকে ডেকে তারেক রহমানের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, লিটন অত্যান্ত পরিশ্রমী সাবেক ছাত্রদল নেতা, কার্ডিফ বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। আমিতো অনেকটাই হতবাক হয়ে যাই। একি করলেন মালিক ভাই! এও কি সম্ভব? হ্যাঁ, তিনি পারেন কারন তিনি জানেন কিভাবে একজন মানুষকে মূল্যায়ন করতে হয়। ভাই আপনার এই ঋণ হয়তো কখনো শোধ করতে পারবো না তবে মহান আল্লাহ পাকের কাছে দু’হাত তুলে আপনার জন্য দোয়া করবো সব সময়।

জাতীয়তাবাদের রাজনীতিই যেনো উনার জীবনে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, কথায় কথায় একদিন উনাকে প্রশ্ন করে ফেলি — ভাই আপনি আমাদেরকে ছেড়ে কেনো ল-নে চলে যাচ্ছেন? বললেন আমিতো এখন অবসর, অফুরন্ত সময় হাতে রয়েছে। এখানে থেকে দলের জন্য কিছুই করতে পারছি না। তাছাড়া ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জাতীয়বাদের রাজনীতির জন্য আমার এখনো অনেক কাজ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। এখান থেকে এতটা পথ ড্রাইভ করে ল-নে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই বাড়ী বিক্রী করে ওখানে চলে যাচ্ছি। প্রায়ই আমাকে বলতেন লিটন এই বয়সে আমার আর কিইবা চাওয়া পাওয়ার আছে। সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য যদি কিছু করে যেতে পারি তাতেই আমি সন্তুষ্ট।

এমন একজন গুনী মানুষকে আমরা হারিয়েছি, যার সঠিক মূল্যায়ন আমরা করতে পারিনি কিংবা আমরা উনাকে ঠিক মতো বুঝতে পারিনি। সময়ই একদিন বলবে ড. কেএম আব্দুল মালিক কতবড় একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন। কতো বড় একজন কলমযোদ্ধা ছিলেন। অন্ধকারে আলোর দিশারী মালিক ভাই-ই হচ্ছেন আমাদের একজন সত্যিকার অভিবাবক। যিনি আমাদের মতো তরুণ ও যুব প্রজন্মকে দেখিয়ে গেছেন কিভাবে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করে যেতে হয়। সবচেয়ে কষ্ট পাই যখনিই মনে হয় তিনি বলতেন ভাইরে দেশে যাওয়ার প্রচণ্ড ইচ্ছা, অনেক কাজ রয়েছে দেশে কিন্তু যেতে পারছি না, যদি আমাকে ওরা শেষ করে দেয়।
মালিক ভাই আমাদেরকে ক্ষমা করবেন। আমরা পারিনি। আপনার প্রিয় মাতৃভূমিতে একদিন ঠিকই স্বৈরাচার মুক্ত হবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি। আপনি অপারে শান্তিতে ঘুমান।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

Back to top button
Close
Close